মাথাভাঙ্গা মনিটর: ভয়াবহ ভূমিকম্পে তুরস্ক ও সিরিয়ায় নিহতের সংখ্যা ১৯ হাজার ছাড়িয়েছে। দুই দেশের সরকার ও হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ নিহতের এ সংখ্যা জানিয়েছে। তবে মৃতের সংখ্যা আরও অনেক বাড়বে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। বৃহস্পতিবার রাত ১০টায় এই প্রতিবেদন লেখা পর্যন্ত তুরস্কে নিহত হয়েছেন কমপক্ষে ১৬ হাজার ১৭০ জন। আর সিরিয়ায় নিহতের সংখ্যা তিন হাজার ১৬২। এদিকে, সময় যত যাচ্ছে, প্রাণহানি ততই বাড়ছে। এখনো বহু মানুষকে ধ্বংসস্তূপ থেকে উদ্ধার করা যায়নি। ফলে তুরস্ক-সিরিয়ার বাতাসে এখন লাশের গন্ধ ভেসে আসছে। এখনো কত মানুষ আটকা পড়ে আছেন বা মারা গেছেন তা কেউ বলতে পারছেন না। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডবিস্নউএইচও) কর্মকর্তারা আগেই আভাস দিয়েছিলেন, নিহত মানুষের সংখ্যা ২০ হাজারে পৌঁছাতে পারে। তুরস্কের দুর্যোগ ও জরুরি ব্যবস্থাপনা বিষয়ক কর্তৃপক্ষ আফাদ জানিয়েছে, ভূমিকম্পে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে গাজিয়ানতেপ শহর। ভূমিকম্পের পর শতাধিক আফটারশক (পরাঘাত বা ভূমিকম্পের পরের কম্পন) রেকর্ড করা হয়েছে। গত সোমবার তুরস্কের স্থানীয় সময় ভোর ৪টা ১৭ মিনিটে ৭.৮ মাত্রার ভয়াবহ ভূমিকম্প আঘাত হানে। তখন বেশিরভাগ মানুষই গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন। ফলে বহুতল ভবন ধসে পড়ে ঘুমন্ত মানুষের ওপর। মোমের মতো ধসে পড়েছে একাধিক ভবন। ভয়াবহ এই ভূমিকম্পে তুরস্ক ও সিরিয়ার বিস্তীর্ণ এলাকা মাটির সঙ্গে মিশে গেছে। হমিসর, লেবানন ও সাইপ্রাস থেকেও কম্পন অনুভূত হয়েছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও) জানিয়েছে, ‘তুরস্ক-সিরিয়ায় আঘাত হানা ভূমিকম্পে বিপুলসংখ্যক মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারেন।’ ডব্লিউএইচও’র শীর্ষ কর্মকর্তা অ্যাডেলহেইড মার্শাং বলেন, ‘ভূমিকম্প যেসব অঞ্চলে আঘাত হেনেছে, তার মানচিত্র অনুসারে বলা যায়, দুই কোটি ৩০ লাখ মানুষ এতে ক্ষতিগ্রস্ত হবেন। এদের মধ্যে ৫০ লাখ মানুষ অরক্ষিত অবস্থায় আছেন। তিনি আরও বলেন, তুরস্ক এবং উত্তর-পশ্চিম সিরিয়ার ভূমিকম্প কবলিত অঞ্চলে বেসামরিক অবকাঠামো ও স্বাস্থ্য সেবার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট অবকাঠামোগুলোর ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। জেনেভায় ডব্লিউএইচও’র নির্বাহী কমিটিকে মার্শাং বলেছেন, ‘ডব্লিউএইচও মনে করে, সিরিয়ায় তাৎক্ষণিকভাবে বিভিন্ন জরুরি পণ্যের অভাব দেখা দেবে। এমনকি দেশটিতে মধ্য মেয়াদি সময়ের জন্য আরও এমন সমস্যা দেখা দিতে পারে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ওই অঞ্চলে কয়েক সপ্তাহ থেকে কয়েক মাস পর্যন্ত আফটারশক হতে পারে। ভূকম্পনের বৈশিষ্ট্যের কারণে আফটারশক পরের কয়েক সপ্তাহ, এমনকি কয়েক মাস পর্যন্তও অনুভূত হতে পারে। সময় ফুরাচ্ছে, কমছে আশা বাতাসে লাশের গন্ধ এদিকে, সময় যত যাচ্ছে, ধ্বংসস্তূপে আটকে পড়াদের বাঁচার আশা ততই ক্ষীণ হয়ে আসছে। তারপরও জীবিতদের উদ্ধারের আশায় উদ্ধারকর্মীরা আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। অর্ধশতাধিক দেশ থেকে উদ্ধারকারীরা তুরস্ক ও সিরিয়ার কার্যক্রমে যোগ দিয়েছেন। বৈরী আবহাওয়া, সড়ক ধসেপড়া এবং ভারী যন্ত্রপাতির অভাবে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত এলাকায় পৌঁছানো ও সেখানে উদ্ধারকাজ চালাতে হিমশিম খাচ্ছেন তারা। অর্ধ লক্ষাধিক উদ্ধারকর্মী দিনরাত চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। ভয়াবহ ভূমিকম্পে তুরস্কের ১০টি শহরের এক কোটি ৩০ লাখ মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। অন্যদিকে, সিরিয়ায় উদ্ধার অভিযানে সমস্যা বাড়তে শুরু করেছে। রাস্তাঘাট ধ্বংস হয়ে যাওয়ায় তুরস্ক থেকে সেখানে জাতিসংঘের জরুরি সাহায্য পাঠানোর পথ বন্ধ হয়ে গেছে। এছাড়া এসব এলাকায় অক্ষত থাকা বাড়িঘরেও বাসিন্দাদের প্রবেশ না করতে নির্দেশনা দিয়েছে প্রশাসন। কারণ আশঙ্কা- আবারও বড় ভূমিকম্প হতে পারে। প্রচন্ড ঠান্ডায় সহায় সম্বল হারানো যেসব মানুষ রাস্তায় বা গাড়িতে রাত কাটাচ্ছেন, তাদের পরিস্থিতিও অনেক মানবেতর। তুরস্কের ওসমানিয়া শহর, যেটি ভূমিকম্পের কেন্দ্রস্থলের কাছেই। বৃষ্টির কারণে সেখানে উদ্ধার তৎপরতা ব্যাহত হচ্ছে। রাতে শহরটিতে কোনো বিদ্যুৎ ছিলো না। প্রবল শীতের মধ্যে দুর্গতরা খোলা আকাশের নিচে বুধবার রাত কাটিয়েছেন। কয়েকদিন ধরে তুরস্ক ও সিরিয়ার জনগণের চোখে ঘুম নেই। আটকেপড়া ব্যক্তিদের আত্মীয়রা ধ্বংসস্তূপের পাশে অপেক্ষা করছেন। তাদের আশা, স্বজনদের হয়তো জীবিত খুঁজে পাওয়া যাবে। কিন্তু তীব্র শীতের কারণে উদ্ধার প্রচেষ্টা কঠিন হয়ে উঠেছে। গৃহহীনদের দুর্দশা বেড়েছে। বেশিরভাগ এলাকায় বিদ্যুৎ ও জ্বালানি নেই। ইস্তাম্বুলের তুর্কি সাংবাদিক ইব্রাহিম হাসকোলোলু বলেন, ‘লোকজন এখনো ধসেপড়া ভবনের নিচে রয়েছে, তাদের সাহায্যের প্রয়োজন। ধ্বংসস্তূপের নিচ থেকে আটকেপড়া লোকজন তাকে ও অন্য সাংবাদিকদের ভিডিও, ভয়েস নোট এবং তাদের লাইভ অবস্থান পাঠাচ্ছেন। তারা আমাদের বলছেন, তারা কোথায় আছেন এবং আমরা তাদের জন্য কিছুই করতে পারছি না।’ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ধ্বংসস্তূপের নিচে আটকেপড়া লোকদের বের করে আনতে যত দেরি হবে, তাদের জীবিত উদ্ধারের সম্ভাবনা ততই কমে আসবে। তুরস্কের দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা মন্ত্রণালয়ের হিসাবে, জোরালো ভূমিকম্পে সাড়ে ১১ হাজারের মতো ঘরবাড়ি-স্থাপনা ভেঙে পড়েছে। ধ্বংসস্তূপ থেকে এখন পর্যন্ত ৩২ হাজার মানুষকে জীবিত উদ্ধার করা হয়েছে। তাদের প্রাথমিক চিকিৎসা দিতেও হিমশিম খাচ্ছে হাসপাতাল ও স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্রগুলো। এদিকে, উদ্ধারকাজের ধীরগতি নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করছেন নিখোঁজ ব্যক্তিদের স্বজনেরা। ভূমিকম্পের পর প্রাথমিকভাবে যেসব পদক্ষেপ নেয়া দরকার ছিলো, সেসব নিতে দেরি হচ্ছে- এমন অভিযোগ তাদের। তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়্যেপ এরদোয়ানও উদ্ধারকাজে ধীরগতির এসব অভিযোগের কথা স্বীকার করেছেন। বুধবার কাহরামানমারাস শহরে যান এরদোয়ান। তখন সেখানে পুরোদমে উদ্ধারকাজ চলছিল। এ সময় এরদোয়ান সাংবাদিকদের বলেন, উদ্ধার কার্যক্রম চালাতে গিয়ে সমস্যায় পড়তে হচ্ছে। ভূমিকম্পের কারণে সড়ক ও বিমান যোগাযোগ ব্যবস্থা ভেঙে পড়ায় এ সমস্যা হচ্ছে। তবে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে উদ্ধারকাজের গতি বাড়বে। উদ্ধারকাজে ধীরগতির চিত্র দেখা গেছে সিরিয়াতেও। দেশটির উত্তরাঞ্চলের শহর জানদারিসের একটি ভবনে ৩২টি অ্যাপার্টমেন্ট ছিল। এই ভবনের বেশ কয়েকজন বাসিন্দা বেঁচে গেছেন। তারা বলেন, ভূমিকম্পের পর এখান থেকে কাউকে জীবিত উদ্ধার করা সম্ভব হয়নি। উদ্ধারকাজের জন্য যেসব যন্ত্রপাতি দরকার, সেগুলো না থাকায় কাজ ধীরে চলছে। জাতিসংঘে সিরিয়ার রাষ্ট্রদূত বলেছেন, ভয়াবহ এই ভূমিকম্পের পর দ্রুত উদ্ধারকাজ পরিচালনার জন্য তার সরকারের সক্ষমতা এবং প্রয়োজনীয় উপকরণ ও সরঞ্জামের অভাব রয়েছে। এক দশকের বেশি সময় ধরে চলমান গৃহযুদ্ধ ও পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞার আওতায় থাকায় সিরিয়া এই সক্ষমতা অর্জন করতে পারেনি। নিহতদের স্মরণে বাংলাদেশে রাষ্ট্রীয় শোক পালন তুরস্ক-সিরিয়ায় ভয়াবহ ভূমিকম্পে বিপুল প্রাণহানির ঘটনায় বৃহস্পতিবার রাষ্ট্রীয় শোক পালন করেছে বাংলাদেশে। এদিন সকাল থেকে বাংলাদেশের সব সরকারি, আধা-সরকারি ও স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান এবং শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসহ সব সরকারি-বেসরকারি ভবন এবং বিদেশে বাংলাদেশ মিশনে জাতীয় পতাকা অর্ধনমিত রাখা হয়। এছাড়াও নিহতদের আত্মার শান্তির জন্য দেশের সব ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানে বিশেষ প্রার্থনার আয়োজন করা হয়।