স্টাফ রিপোর্টার: করোনাভাইরাস সংক্রমণ প্রতিরোধে জোনভিত্তিক লকডাউন কিভাবে কার্যকর করা হবে তার খসড়া পরিকল্পনা সরকারের হাতে জমা পড়েছে। এর একটি হলো সিটি করপোরেশনের উপযোগী। আর অন্যটি সিটি করপোরেশনের বাইরের এলাকার জন্য। এ পরিকল্পনা বাস্তবায়নে জেলা প্রশাসন, সিভিল সার্জন অফিস, রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ, পুলিশ, সেনাবাহিনী, স্বেচ্ছাসেবক বাহিনীর সম্পৃক্ততার সুপারিশ করা হয়েছে। এ দুটি খসড়া পরিকল্পনা বিচার-বিশ্লেষণ করছেন নীতিনির্ধারকরা। চূড়ান্ত হলেই নির্দেশনা অনুযায়ী কাজ শুরু করবে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ। করোনাভাইরাস সংক্রমণের ঊর্ধ্বগতি ও মৃত্যু বাড়ার পরিপ্রেক্ষিতে গত সোমবার সচিবালয়ে তিন মন্ত্রী এবং ঢাকার দুই সিটি, গাজীপুর ও নারায়ণগঞ্জের চার মেয়র বিশেষ বৈঠক করেন। ওই বৈঠকে জোনভিত্তিক লকডাউনের সিদ্ধান্ত হয়। বৈঠকে সারা দেশকে রেড, ইয়েলো ও গ্রিন জোনে ভাগ করে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেয়ার সিদ্ধান্ত হয়। এরই মধ্যে ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি (আইসিটি) বিভাগ থেকে একটি উচ্চক্ষমতা সম্পন্ন সফটওয়্যার তৈরি করে দেয়া হয়েছে। এতে করোনায় আক্রান্ত রোগীদের মোবাইল নম্বর দিয়ে কোন এলাকায় সংক্রমণ কেমন, তা দেখা সম্ভব হচ্ছে। এসব বিষয় বিশ্লেষণ করে স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা কতটুকু এলাকায় কতজন আক্রান্ত রোগী হলে সেটা রেড, ইয়েলো ও গ্রিন জোন হিসেবে চিহ্নিত হবে তা নির্ধারণের কাজ করছেন। অন্যদিকে জোন ব্যবস্থাপনার জন্য আগে থেকেই প্রস্তুত হয়ে থাকছে মাঠ প্রশাসনসহ সিটি করপোরেশনগুলো।
জনপ্রশাসন প্রতিমন্ত্রী ফরহাদ হোসেন বলেন, ‘জোনভিত্তিক কার্যক্রম পরিচালনার পরিকল্পনা চূড়ান্ত করা হচ্ছে। প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা পেলে মঙ্গল-বুধবারের মধ্যে আমরা বাস্তবায়নে হাত দিতে পারব।’ তিনি বলেন, ‘জোনিংয়ের মূল উদ্দেশ্য হলো, রেড ও ইয়েলো জোনকে যেন গ্রিন জোনে পরিণত করা যায়। অন্যদিকে গ্রিন জোন যেন কোনোভাবেই ইয়েলো বা রেড জোনে পরিণত না হয়, সেটা নিশ্চিত করা। আশা করি, এটা সফল উদ্যোগ হবে।’
নরসিংদীর জেলা প্রশাসক (ডিসি) ফারহানা কাউনাইন গত মাসের মাঝামাঝি সময়েই জোনভিত্তিক লকডাউন নিয়ে ঢাকা বিভাগীয় কমিশনে এসওপি (স্ট্যান্ডার্ড অপারেটিং প্রসিডিউর) জমা দিয়েছিলেন বলে জানা গেছে। তার সেই এসওপির ভিত্তিতে সব জেলায় জোনভিত্তিক লকডাউনের বিষয়টি বিবেচনা করছে সরকার।
ফারহানা কাউনাইন গতকাল বলেন, ‘কেন্দ্রীয় নির্দেশনার অপেক্ষায় আছি। প্রস্তাবিত এসওপিতে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ কিছু যোগ-বিয়োগ করতে পারে। যেভাবেই নির্দেশনা আসুক সেভাবে কাজ করতে প্রস্তুত আছি।’ তিনি আরও বলেন, ‘সব জেলার জন্য হয়তো একই ধরনের নির্দেশনাই থাকবে। তবে সংশ্লিষ্ট জেলা প্রশাসন প্রয়োজন অনুযায়ী অন্য পদক্ষেপও নিতে পারবে।’
রেড জোন: শুধু ফার্মেসি, হাসপাতাল, নিত্যপণ্যের দোকান খোলা থাকবে রেড জোনে। কাঁচাবাজার, রেস্টুরেন্ট, চায়ের দোকান, শপিং মলসহ সব ধরনের বাণিজ্যিক কার্যক্রম বন্ধ থাকবে। জনপ্রতিনিধিদের সম্পৃক্ত করে স্বেচ্ছাসেবক টিমের মাধ্যমে নিয়মিত মনিটরিং করা হবে। আক্রান্ত রোগীদের বাড়িতে খাদ্যসামগ্রী ও অন্যান্য নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যসামগ্রী পৌঁছে দেয়ার জন্য স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী কাজ করবে। আক্রান্ত রোগীকে আইসোলেশনে রাখা এবং আক্রান্ত রোগীর পরিবারকে কোয়ারেন্টিনে রাখাও নিশ্চিত করা হবে। রেড জোনে জনসমাগম রুখতে কাঁচাবাজার বন্ধ রেখে ভ্রাম্যমাণ ভ্যান ও মাথায় ঢুলি নিয়ে চলা ফেরিওয়ালাদের পণ্য বিক্রি করতে দেয়া হবে।
নির্দিষ্ট কয়েক দিনের জন্য, যেমন ১৪-২১ দিনের জন্য লকডাউন করা হবে। লকডাউন পরিপালন হচ্ছে কি না তার জন্য পৌরসভা, ইউনিয়ন ও ওয়ার্ডভিত্তিক মনিটরিং কমিটি করা হবে। রেড জোনে থাকা কেউ যাতে ওই এলাকার বাইরে যেতে না পারে এবং বাইরের লোকজন যাতে সেখানে ঢুকতে না পারে তার জন্য সংশ্লিষ্ট পয়েন্টগুলোতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী অবস্থান নেবে। একবারে বড় ধরনের প্রয়োজন ছাড়া ওই এলাকা থেকে কেউ বের হতে বা ঢুকতে পারবে না। রেড জোনে থাকা বাসিন্দাদের মধ্যে যাদের করোনা উপসর্গ দেখা দেবে তাদের নমুনা সংগ্রহের জন্য সংশ্লিষ্ট এলাকায় থাকা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ব্যবহার করা হবে। রোগী বেশি হলে একাধিক বুথ স্থাপন করা হবে। নমুনা সংগ্রহের জন্য প্রয়োজনীয়সংখ্যক দক্ষ টেকনোলজিস্ট নিয়োগ দেয়া হবে। তাদেরও রেড জোন থেকে বের হতে দেয়া হবে না। নমুনা সংগ্রহ কেন্দ্র বা পাশে থাকা আবাসিক হোটেলে টেকনোলজিস্টদের থাকার ব্যবস্থা করা হবে। প্রয়োজন হলে নির্দিষ্ট সময় কোয়ারেন্টিনে থাকার পর তাঁদের রেড জোন থেকে বের হতে হবে।
ইয়েলো জোন: ইয়েলো জোনে কিছু ক্ষেত্রে ছাড় পাওয়া যাবে। এখানে পুরো এলাকা লকডাউন না করে করোনা আক্রান্ত রোগীদের বাড়িতে লকডাউন নিশ্চিত করা হবে। তবে নির্ধারিত নিয়ম-কানুন কড়াভাবে পালন করতে হবে বাসিন্দাদের। যেমন একসঙ্গে দু-তিনজনের বেশি হাঁটা যাবে না। বাসার বাইরে গেলে অবশ্যই মাস্ক ব্যবহার করতে হবে। যেকোনো ধরনের জনসমাগম রোধে স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী বা ওয়ার্ড কমিটি পর্যায়ক্রমে টহল দেবে। কোনো বিষয় তাদের আয়ত্তের বাইরে থাকলে জেলা প্রশাসনকে অবহিত করবে। প্রয়োজনীয় জায়গায় ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করা হবে। এখানে ফার্মেসি, হাসপাতাল ও কাঁচাবাজার খোলা থাকলেও অন্য সব বাণিজ্যিক কার্যক্রম বন্ধ থাকবে। কুইক রেসপন্স টিমের মাধ্যমে আক্রান্ত রোগীর বাড়ি লকডাউন নিশ্চিত করা হবে।
গ্রিন জোন: গ্রিন জোনেও কিছু বিষয়ে কঠোরতা বজায় রাখা হবে, যাতে করোনা আক্রান্ত কোনো রোগী এই এলাকায় ঢুকতে না পারে তা নিশ্চিত করার চেষ্টা করা হবে। গ্রিন জোনের কেউ আক্রান্ত হলে তাকে প্রাতিষ্ঠানিক আইসোলেশনে রাখা হবে। যাতে এই এলাকার কেউ আক্রান্ত না হয়।