মাথাভাঙ্গা মনিটর: রাশিয়ার তেল আমদানি সীমিত করার ঘোষণা দিয়েছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন। অন্যদিকে, তেলের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হলে ইউরোপে গ্যাস সরবরাহ বন্ধ করে দেয়া হতে পারে বলে সতর্ক করে দিয়েছে রাশিয়া। রাশিয়ার ওপর নিষেধাজ্ঞার আওতা বাড়াতে ইউক্রেনের আহ্বানের পর রাশিয়ার তেল, গ্যাস ও কয়লা আমদানির ওপর পূর্ণাঙ্গ নিষেধাজ্ঞার ঘোষণা দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। যুক্তরাজ্য ঘোষণা দিয়েছে, পর্যায়ক্রমে রাশিয়ার তেল নির্ভরতা থেকে চলতি বছরের শেষের দিকেই বেরিয়ে আসবে তারা। ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ) তার গ্যাস আমদানি দুই-তৃতীয়াংশ কমিয়ে আনছে। ব্রিটিশ সরকার বলেছে, তেল ও গ্যাসের বিকল্প সরবরাহ উৎস খুঁজে পেতে হাতে এখন যথেষ্ট সময় আছে। রাশিয়ার উপপ্রধানমন্ত্রী আলেকজান্ডার নোভাক বলেছেন, ‘রাশিয়ান তেল প্রত্যাখ্যান করা হলে তা বিশ্ব বাজারে ‘বিপর্যয়কর পরিণতি’ ডেকে আনবে।’ ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে বিশ্বজুড়ে ইতোমধ্যে তেল ও গ্যাসের দাম আকাশ ছুঁতে শুরু করেছে। রাশিয়া যদি রপ্তানি বন্ধ করে দেয়, তাহলে তা আরও বাড়তে পারে। তবে এই সংকট কেবল জ্বালানির মধ্যে সীমিত থাকবে না। বরং বিশ্বজুড়ে মানুষের জীবনযাত্রার মানে ব্যাপক প্রভাব ফেলবে এবং বিশ্ববাজারে পণ্যের দাম আরও বেড়ে যাবে। বিশ্বে তৃতীয় সর্বোচ্চ তেল উৎপাদন করে রাশিয়া। দেশটির আগে আছে কেবল যুক্তরাষ্ট্র ও সৌদি আরব। রাশিয়া প্রতিদিন প্রায় ৫০ লাখ ব্যারেল অপরিশোধিত তেল রপ্তানি করে; যার অর্ধেকেরও বেশি যায় ইউরোপে। যুক্তরাজ্যের মোট তেলের চাহিদার প্রায় ৮ শতাংশ রাশিয়া থেকে আমদানি করা হয়। তবে যুক্তরাষ্ট্র কিছুটা কম নির্ভরশীল রাশিয়ার ওপর। ২০২০ সালে মোট আমদানির মাত্র ৩ শতাংশ তেল রাশিয়া থেকে নিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। জ্বালানি নীতি গবেষণা বিশ্লেষক বেন ম্যাক উইলিয়ামস বলেছেন, গ্যাসের তুলনায় বিকল্প তেল সরবরাহকারী খুঁজে পাওয়াটা সহজ হতে পারে। কারণ এটার জন্য এত বেশিসংখ্যক পাইপলাইন লাগে না। কিছু তেল রাশিয়া থেকে আসছে। তবে অন্য উৎস থেকেও প্রচুর চালান পাওয়া যেতে পারে। তেলের উৎপাদন বৃদ্ধি করার জন্য সৌদি আরবের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। কিন্তু দেশটি এর আগে তেলের দাম কমানোর কারণে উৎপাদন বাড়ানোর মার্কিন অনুরোধ প্রত্যাখ্যান করে। বিশ্বের শীর্ষ তেল রপ্তানিকারকদের সংগঠন ওপেকের বৃহত্তম তেল উৎপাদনকারী সৌদি আরব। আন্তর্জাতিক বাজারে মোট অপরিশোধিত তেলের প্রায় ৬০ শতাংশই সরবরাহ করে দেশটি। রাশিয়া ওপেকের সদস্য না হলেও ২০১৭ সাল থেকে সংগঠনটির সঙ্গে সমন্বয় করে তেল উৎপাদন করছে; যাতে উৎপাদনকারীদের তেলের আয়ে কোনো প্রভাব না পড়ে। ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে যুক্তরাষ্ট্র এখন ভেনেজুয়েলার তেল নিষেধাজ্ঞা শিথিলের বিষয়ে চিন্তা-ভাবনা করছে। এক সময় যুক্তরাষ্ট্রের অন্যতম প্রধান তেল সরবরাহকারী ছিলো দেশটি। সম্প্রতি ভেনেজুয়েলা তার তেলের বৃহৎ একটি অংশ চীনের কাছে বিক্রি শুরু করেছে। এর প্রভাব পড়বে গ্যাসের দামে। যা ইতোমধ্যে বৃদ্ধি পেয়েছে। এমনকি তা আরও বাড়বে। ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) প্রাকৃতিক গ্যাস আমদানির প্রায় ৪০ শতাংশই রাশিয়ান। সরবরাহ বন্ধ হয়ে গেলে তা ইতালি ও জার্মানিকে বিশেষভাবে ঝুঁকিতে ফেলবে। কাতার অথবা আলজেরিয়া ও নাইজেরিয়ার মতো গ্যাস রপ্তানিকারকদের দিকে মুখ ঘুরিয়ে নিতে পারে ইউরোপ। কিন্তু দ্রুত উৎপাদন বৃদ্ধি করার ক্ষেত্রে মাঠ পর্যায়ে নানা ধরনের প্রতিবন্ধকতা রয়েছে। যুক্তরাজ্যের মোট গ্যাস আমদানির প্রায় ৫ শতাংশ আসে রাশিয়া থেকে। অন্যদিকে, যুক্তরাষ্ট্র রাশিয়া থেকে গ্যাস আমদানি করে না। তারপরও সরবরাহ ঘাটতির কারণে ইতোমধ্যে যুক্তরাজ্য ও যুক্তরাষ্ট্রে উল্লেখযোগ্য পরিমাণে দাম বৃদ্ধি পেয়েছে। একেবারে খুব সহজে পাওয়া যাবে— এমন কথা বলা যাচ্ছে না। ম্যাক উইলিয়ামস বলেন, ‘গ্যাসের বিকল্প সরবরাহ পাওয়া কঠিন। কারণ আমাদের কাছে বড় বড় পাইপ আছে, যেগুলো রাশিয়ান গ্যাস ইউরোপে নিয়ে যাচ্ছে।’ রাশিয়া যদি ইউরোপে গ্যাস সরবরাহ বন্ধ করে দেয়, তাহলে ইউরোপ সম্ভবত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে আরও বেশি তরল প্রাকৃতিক গ্যাস (এলএনজি) আমদানি করতে পারে বলে ভবিষ্যদ্বাণী করেছে থিঙ্ক ট্যাঙ্ক প্রতিষ্ঠান ব্রুগেল। আর এটি জ্বালানি শক্তির অন্যান্য উৎসের ব্যবহারও বাড়াতে পারে। কিন্তু তা খুব দ্রুত অথবা সহজে করা যাবে না। গবেষণা বিশ্লেষক সিমোন ট্যাগলিয়াপিত্রা বলেছেন, ‘নবায়নযোগ্য জ্বালানিতে সময়ের দরকার হয়। যে কারণে স্বল্প মেয়াদে এটির সমাধান সম্ভব নয়।’ ‘তাই আগামী শীতে যা একটি পার্থক্য তৈরি করতে পারে তা হলো জ্বালানির পরিবর্তন, যেমন কয়লা চালিত বিদ্যুৎ কেন্দ্র চালু করা। ইতালি ও জার্মানির জরুরি পরিস্থিতিতে এটি করার পরিকল্পনা আছে।’ ২০৩০ সালের আগেই ইউরোপকে রাশিয়ার জীবাশ্ম জ্বালানি নির্ভরতা থেকে বের করে আনার একটি পরিকল্পনা প্রস্তাব করেছে ইউরোপীয় ইউনিয়ন। এই পরিকল্পনার মধ্যে গ্যাস সরবরাহে বৈচিত্র্যকরণ এবং তাপ ও বিদ্যুৎ উৎপাদনে গ্যাসের বিকল্প প্রতিস্থাপনের ব্যবস্থার কথা রয়েছে। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের ফলে ভোক্তারা ক্রমবর্ধমান বিদ্যুৎ ও জ্বালানির বিল বৃদ্ধির মুখোমুখি হবে। যুক্তরাজ্যে গৃহস্থালির জ্বালানি বিল কিছুদিন আগেই বৃদ্ধি করা হয়েছে। আগামী এপ্রিলে আবারও ৭০০ পাউন্ড থেকে ২ হাজার পাউন্ড পর্যন্ত বৃদ্ধি পেতে পারে। চলতি শরতে আবার বাড়ানো হলে তা প্রায় ৩ হাজার পাউন্ডে পৌঁছাবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। ব্রিটেনে পেট্রোল ও ডিজেলের দাম ইতোমধ্যে বেড়েছে। যুদ্ধ অব্যাহত থাকলে পেট্রোলের দাম বেড়ে প্রতি লিটার ১ পাউন্ড ৭৫ পেন্স হতে পারে বলে আশঙ্কা করছেন দেশটির বিশেষজ্ঞরা। ২০০৮ সালের পর যুক্তরাষ্ট্রে পেট্রোলের দাম সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছেছে। আমেরিকান অটোমোবাইল এসোসিয়েশন বলেছে, গত সপ্তাহে দেশটিতে পাম্প পেট্রোলের দাম ১১ শতাংশেরও বেশি বৃদ্ধি পেয়েছে। ম্যাক উইলিয়ামস বলেন, ‘আমি মনে করি, আমরা যদি এমন একটি বিশ্বে বসবাস করি, যেখানে রাশিয়ান তেল ও গ্যাসের সরবরাহ ইউরোপে বন্ধ হয়ে যাবে, তাহলে আমাদের রেশনিং ব্যবস্থার প্রয়োজন হবে।’ ‘এখন আলোচনার বিষয় হলো, আমরা কি পরিবারগুলোকে তাদের থার্মোস্ট্যাট এক ডিগ্রি কমিয়ে দিতে বলতে পারি, যা গ্যাসের একটি উল্লেখযোগ্য অংশ বাঁচিয়ে দেবে?’