কেঁচো খুঁড়তে গিয়ে বেরিয়ে এসেছে ভয়ঙ্কর বিষধর সাপ। মেডিকেল কলেজের পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁস চক্রের সঙ্গে জড়িত ১২ জনকে গ্রেফতার করেছে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি)। দুঃখজনক হলো ধৃতদের মধ্যে ৭ জনই চিকিৎসক, যাদের মধ্যে আছেন নারীও। তারা সবাই বিভিন্ন স্থানে মেডিকেল ভর্তি কোচিং, নয়তো প্রাইভেট পড়ানোর ছলে প্রশ্নফাঁস করতেন। বিনিময়ে হাতিয়ে নিতেন লাখ লাখ টাকা। স্বাস্থ্য শিক্ষা ব্যুরোর প্রেসের মেশিনম্যানের ভাইও এতে জড়িত। প্রশ্নফাঁস চক্রটি ২০০১ থেকে ২০১৭ পর্যন্ত অন্তত ১৬ হাজার কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে বলে জানতে পেরেছে পুলিশ। বিদেশেও অর্থ পাচার করেছে চক্রটি।
প্রতিবছর ১৫০ জনের মতো শিক্ষার্থী মেডিকেলে ভর্তি করিয়েছে। ফাঁসকৃত প্রশ্নপত্রে ভর্তি দুই হাজারের বেশি চিকিৎসক হয়ে বেরিয়েছেন ইতোমধ্যে, যাদের অধিকাংশই বিত্তবান শ্রেণির। সারাদেশে বিভিন্ন ধরনের পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁস চক্রের অন্তত ৮০ জন সদস্যের নাম পরিচয় জানতে পেরেছে গোয়েন্দা পুলিশ। গ্রেপ্তারের চেষ্টাও চলছে। দেশব্যাপী উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষা সামনে রেখে আবারও সক্রিয় হয়ে উঠেছে চক্রটি।
যে বা যারা প্রশ্নফাঁসের মতো জঘন্য ও নিন্দনীয় কাজের সঙ্গে জড়িত তারা প্রকৃতপক্ষে দেশ ও জাতির শত্রু। তাদের নীতিনৈতিকতা বলে কিছু নেই। কেবল অর্থের বিনিময়ে তারা যা খুশি তা-ই করতে পারে। করেও যাচ্ছে। আসন্ন এইচএসসি পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁসের ঘোষণাও তারা আগাম দিয়েছে। এই চক্রটি, যার সঙ্গে একশ্রেণির প্রশ্নকর্তা, শিক্ষক, সংরক্ষক, সরবরাহকারী, মুদ্রাকর, সর্বোপরি কোচিং সেন্টার, শিক্ষক-শিক্ষার্থী-অভিভাবকরা পর্যন্ত জড়িত প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে, তারা দেশ ও জাতির আগামী প্রজন্মকে ধ্বংসের পাঁয়তারা করছে। এই প্রেক্ষাপটে সাবেক রাষ্ট্রপতি মো. আব্দুল হামিদ ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেছিলেন, প্রশ্নফাঁস ও বিতরণের সঙ্গে জড়িতদের ‘ফায়ারিং স্কোয়াডে’ দেয়া উচিত। রাষ্ট্রপতি প্রকারান্তরে প্রশ্নফাঁসের সঙ্গে জড়িতদের কঠোর শাস্তি দেয়ার কথাই বলেছেন।
সরকার তথা স্বাস্থ্য, শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের শত উদ্যোগ সত্ত্বেও বাস্তবে দেখা যাচ্ছে যে, প্রশ্নপত্র ফাঁস ঠেকানো যাচ্ছে না কিছুতেই। গত কয়েক বছর ধরেই হচ্ছে এসব। পাবলিক পরীক্ষা থেকে শুরু করে বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি, চাকরিতে নিয়োগ পরীক্ষা এমনকি বাংলাদেশ বিমান, পাবলিক সার্ভিস কমিশনের পরীক্ষাসহ প্রায় সব পরীক্ষায় প্রশ্নপত্র ফাঁস যেন নিয়মিত ঘটনায় পরিণত হয়েছে। ইতোপূর্বে সর্বাধিক চাঞ্চল্যের সৃষ্টি হয়েছে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের বার্ষিক পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁস হওয়ায়। এতে স্বভাবতই সরকার, শিল্প মন্ত্রণালয় ও বোর্ডের কর্মকর্তারা বেশ হতাশ, বিব্রত এবং অসহায় হয়ে পড়েছেন। প্রশ্নপত্র ফাঁস ঠেকাতে বেশ কিছু কঠোর পদক্ষেপ নিয়েছে সরকার।
পরীক্ষার আধা ঘণ্টা আগে প্রশ্নপত্রের মোড়ক খোলাসহ পরীক্ষার্থীদের আধা ঘণ্টা পূর্বে কেন্দ্রে প্রবেশ বাধ্যতামূলক করা হয়। সাত দিন আগে থেকে বন্ধের নির্দেশ দেয়া হয় কোচিং ও গাইড সেন্টারগুলোকে। প্রয়োজনে ফেসবুক বন্ধের কথা বলা হলেও পরে এই সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসে সরকার। তবে শেষ পর্যন্ত সকলই গরল ভেল। সংশ্লিষ্ট সকল পক্ষকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে প্রশ্নফাঁসের বিড়ম্বনা ঠেকানো যাচ্ছে না কিছুতেই।
আসলে শিক্ষার সর্বস্তরে, একেবারে উচ্চপর্যায় থেকে নিম্নস্তর পর্যন্ত যদি ‘সর্ষের মধ্যে ভূত’ থাকে তাহলে সেই প্রেতাত্মা তাড়াবে কে? অতঃপর প্রশ্নপত্র ফাঁস প্রতিরোধে উচ্চপর্যায়ের কমিটি প্রধানসহ জড়িতদের ধরিয়ে দিলে ৫ লাখ টাকা পুরস্কারের চিন্তা-ভাবনা চলছে বলে জানা যায়।