শুভ বুদ্ধপূর্ণিমায় জগতের সকল প্রাণি সুখী হোক

সম্পাদকীয়

আজ শুভ বুদ্ধপূর্ণিমা। বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের প্রধান ধর্মীয় উৎসব গৌতম বুদ্ধের জন্মোৎসব শুভ বুদ্ধপূর্ণিমা। বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের কাছে এটি বুদ্ধপূর্ণিমা নামে পরিচিত। বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের সবচেয়ে বড় ধর্মীয়, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান বুদ্ধপূর্ণিমা। প্রায় আড়াই হাজার বছর আগে এই তিথিতে বৌদ্ধধর্মের প্রবর্তক গৌতম বুদ্ধ জন্মগ্রহণ করেছিলেন নেপালের লুম্বিনি কাননে। এ রাতেই তিনি বোধিজ্ঞান লাভ করেছিলেন ভারতের বিহার রাজ্যের বুদ্ধগয়ায়। এছাড়া গৌতম বুদ্ধের মৃত্যুও হয়েছিল এ রাতেই। আর এ কারণেই এ তিথিকে বলা হয় বুদ্ধপূর্ণিমা।

বলার অপেক্ষা রাখে না, এই দিনটি বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের কাছে একই সঙ্গে শোক ও গৌরবের। যথাযথ ধর্মীয় ভাবগম্ভীর পরিবেশে বৌদ্ধ সম্প্রদায় তাদের এ প্রধান ধর্মীয় উৎসব উদযাপনের লক্ষ্যে নানা কর্মসূচি গ্রহণ করে। বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশেও বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীরা ‘বুদ্ধপূর্ণিমা’ উদযাপন করেন। জাতিসংঘ দিবসটিকে ‘বেশাখ ডে’ হিসেবে পালন করে।

বুদ্ধ ছিলেন অহিংস, ন্যায় ও সাম্যনীতির এক বলিষ্ঠ কণ্ঠ। বুদ্ধবাণীতে বারবার ধ্বনিত হয়েছে অহিংসা, শান্তি ও বিশ্বপ্রেম এবং মহামৈত্রীর কথা। এ ধর্মে সবার সামগ্রিক সুখকে অগ্রাধিকার দেয়া হয়। আর তাই তো মহামতি বুদ্ধের বাণী হলো- ‘সব্বে সত্তা সুখিতা হোন্তু’ অর্থাৎ জগতের সকল প্রাণী সুখী হোক। বৌদ্ধধর্মে জিঘাংসা, যুদ্ধপ্রবণতা, বিদ্বেষ ইত্যাদির কোনো স্থান নেই। বিদ্যমান জাতীয় ও বৈশ্বিক পরিস্থিতিতে বুদ্ধের বাণী এখনো সমকালীন। সমগ্র বিশ্বের বৌদ্ধরা এবং মানবতাবাদী দার্শনিক চিন্তাবিদরাও বুদ্ধের জীবনদর্শনকে গভীরভাবে অনুধাবন করেন।

বৌদ্ধধর্মে অষ্টাঙ্গিক মার্গ বা আটটি বিশুদ্ধ পথের কথা বলা হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে- সৎ বাক্য বলা, সৎ চিন্তা করা, সৎ কর্ম করা, সৎ জীবিকা নির্বাহ করা, সৎ প্রচেষ্টা, সৎ স্মৃতি, সৎ সমাধি করা ইত্যাদি। এছাড়া বৌদ্ধধর্মে বিশ্বাস করা হয়, অষ্টাঙ্গিক মার্গের অনুশীলন ও চর্চায় জীবন সুন্দর, মাধুর্যময় ও পরিপূর্ণ হয়। বৌদ্ধধর্মে অন্য গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে- ‘পঞ্চশীল’। এতে বলা হয়েছে- প্রাণি হত্যা, চৌর্যবৃত্তি, ব্যভিচার না করা, মিথ্যা না বলা এবং মাদকদ্রব্য সেবন না করা। এসব কাজে কাউকে কোনোরকম উৎসাহিত না করার কথাও বলা হয়েছে। মহামতি বুদ্ধের এ পঞ্চনীতি পালনে ব্যক্তি যেমন উপকৃত হয়, নিরাপদে থাকে; তেমনি সমাজ ও দেশের মানুষ সুখে-শান্তিতে অবস্থান করতে পারে। ত্রিপিটকে উল্লেখ আছে, জগৎ অনাচার, পাপাচারে নিমজ্জিত হলে জগতের কল্যাণে এবং মানুষকে জীবনের সঠিক পথ দেখাতে জীবের দুঃখমোচনে সম্যক সম্বুদ্ধের আবির্ভাব ঘটে। ভারতবর্ষে মানুষে মানুষে ভেদাভেদ জাত-পাতের চরম বৈষম্য, ধর্মের নামে প্রাণযজ্ঞ আর হিংসায় মানুষ যখন মেতে উঠলো, মানুষকে আলোর পথ দেখাতে বুদ্ধ ধরায় এসেছিলেন।

প্রসঙ্গত বলা দরকার, এবার বৌদ্ধদের প্রধান ধর্মীয় উৎসব শুভ বুদ্ধপূর্ণিমা এমন এক সময় এসেছে-যখন করোনাভাইরাসের কারণে সৃষ্ট বিপর্যস্ততা কাটিয়ে যখন প্রায় সবকিছু স্বাভাবিক হয়ে আসছিলো, তখন ইউক্রেন-রাশিয়ার যুদ্ধ বিশ্বকে নতুন সংকটের মুখে দাঁড় করায়। এর প্রভাবে খাদ্যদ্রব্য থেকে শুরু প্রায় সবকিছু দাম ঊর্ধ্বমুখী হওয়ায় মানুষ দিশাহারা হয়ে পড়ে। বিশেষ করে নিম্ন আয়ের মানুষের জীবনে নেমে আসে অবর্ণনীয় পরিস্থিতি। জীবনযাপনের ব্যয় মেটাতে যেমন হিমশিম খাচ্ছে মানুষ, তেমনি নানা ধরনের অনিশ্চয়তা সৃষ্টি হয়েছে। সামগ্রিকভাবে যুদ্ধের কারণে সৃষ্ট সংকটসহ নানামুখী অনিশ্চয়তা পরিলক্ষিত হচ্ছে পুরোবিশ্ব জুড়ে। এমন পরিস্থিতিতে এই সংকট দূর হোক এবং মানুষের জীবনযাপন যেন স্বস্তির হয় এমন প্রার্থনা হোক। বাংলাদেশসহ সারা বিশ্বের মানুষ সৃষ্ট পরিস্থিতি কাটিয়ে উঠুক।

সর্বোপরি আমরা বলতে চাই, বিশ্বের মানুষ নানা সংকটে, দুঃখ-কষ্টে জর্জরিত। যুদ্ধকে কেন্দ্র করে সংকট সৃষ্টি হয়েছে, আর এর প্রভাব পড়েছে সারা পৃথিবীতেই-যা উদ্বেগজনক বাস্তবতাকে স্পষ্ট করে। এছাড়া নিত্য নতুন অনিশ্চয়তা, পণ্যদ্রব্যর দাম বৃদ্ধিসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে জীবনযাপনের স্বাভাবিকতা বিঘিœত হচ্ছে। তাই এই শুভ তিথিতে প্রার্থনা হোক পরিত্রাণের। শুভ বুদ্ধপূর্ণিমার আলোয় ‘জগতের সকল প্রাণি সুখী হোক’।

Comments (0)
Add Comment