বেকার জীবনের যন্ত্রণা অসহনীয়। শিক্ষিত হয়ে কোনো ধরনের জীবিকার উৎস না পাওয়া আরো বেশি কষ্টকর। প্রতিনিয়ত এ দেশের যুবকরা বিপদসঙ্কুল পথে উন্নত দেশে পাড়ি জমাতে গিয়ে প্রাণ হারাচ্ছে। অবৈধ পথে ইউরোপ ও আমেরিকা পাড়ি দেয়া তরুণদের মধ্যে বাংলাদেশ এখন বিশ্বে একেবারে প্রথম কাতারে। দক্ষিণ আফ্রিকা ও পশ্চিম ইউরোপেও অভিবাসী হতে প্রাণপণ চেষ্টা চালাচ্ছে এ দেশের বহু যুবক। ভূমধ্যসাগরে সলিল সমাধি হলেই তার বড় একটি অংশ বাংলাদেশী। এ ছাড়া আদমব্যাপারি সিন্ডিকেটের কবলে পড়ে নিঃস্ব হয়ে যাওয়া যুবকের সংখ্যা বহু। শুধু তাই নয়, অনেকে তাদের হাতে পণবন্দী হচ্ছে। মোটা অঙ্কের বিনিময়ে ছাড়া পাচ্ছে। অনেকে মুক্তিপণের টাকা পাঠিয়েও মুক্তি পাচ্ছে না। দেশে থাকা শেষ সম্বল ভিটেবাড়ি বিক্রি করে সর্বস্বান্ত হচ্ছে। এ অবস্থায়ও বেকারদের হতাশা দূরীকরণের কোনো আন্তরিক প্রচেষ্টা নেই।
বেকারের সংখ্যা নির্ধারণে সঠিক হিসাবটাও করে না সরকার। সরকারের কাছে এটি রাজনীতির একটি অংশ। যেমন সর্বশেষ আদমশুমারি নিয়ে ব্যাপক বিতর্ক উঠেছে। মাথাপিছু আয়সহ মোটাদাগে জাতীয় অর্থনৈতিক সূচকগুলোকে বাড়িয়ে দেখানোর জন্য এর মধ্যেও কারসাজি করা হয়েছে বলে সন্দেহ করা হচ্ছে। ২০১৭ সালে প্রণীত বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো-বিবিএসের সর্বশেষ শ্রমশক্তি জরিপে বেকারের সংখ্যা দেখানো হচ্ছে মাত্র ২৬ লাখ ৮০ হাজার। তাদের হিসাব অনুযায়ী, দেশে কর্মক্ষম ব্যক্তির সংখ্যা পাঁচ কোটি ৬৭ লাখ। এদের মধ্যে কর্মে নিয়োজিত রয়েছেন পাঁচ কোটি ৪০ লাখ ২০ হাজার। শ্রমশক্তি জরিপ এখনো চলমান রয়েছে। পরবর্তী পরিসংখ্যান প্রকাশ করা হবে ২০২৪ সালে। সরকারের এ পরিসংখ্যানকে কেউ আস্থায় নিচ্ছে না।
আন্তর্জাতিক লেবার অর্গানাইজেশন-আইএলওর একই সময়ের তথ্যানুযায়ী, বাংলাদেশে বেকারের সংখ্যা তিন কোটি। তাদের পূর্বাভাস অনুযায়ী আগামী কয়েক বছরের মধ্যে সেটি দ্বিগুণ হয়ে ছয় কোটিতে দাঁড়াবে, যা মোট জনসংখ্যার ৩৯ দশমিক ৪০ শতাংশ হবে। এ ব্যাপারে সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ-সিপিডির এক ফেলোর মন্তব্য দিয়েছে একটি সহযোগী দৈনিক। তিনি বলছেন, ‘এ দেশে বেকারত্বের যে হার দেখানো হয়, সেটি সঠিক নয়, এ মুহূর্তে ১৮ থেকে ২৮ বছর বয়সী যুবকদের এক-তৃতীয়াংশ বেকার। শিক্ষিত বেকার হয়তো দু’জনে একজন।’
দেশে চলমান বেকারত্বের দৃশ্যমান বাস্তবতা বিবিএসের হিসাবকে কোনোভাবে সমর্থন করে না। সহযোগী দৈনিকটি বেকারত্ব নিয়ে যুবকদের চরম হতাশার একটি খবর প্রকাশ করেছে। তাতে তারা কিছু আলামত প্রকাশ করেছে। দেখা যাচ্ছে, কর্মসংস্থান না পেয়ে শিক্ষিত যুবক প্রকাশ্যে তাদের শিক্ষা সনদ ছিঁড়ে টুকরো টুকরো করে ঝাল মেটাচ্ছে। যারা চাকরি পাচ্ছে তারা নিজেদের যোগ্যতার চেয়ে অনেক ছোট চাকরি পাচ্ছে। দেখা গেল, নামকরা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ার বিষয়ে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর পাস করে কাজ করছে কম্পিউটার অপারেটরের। এ পদটি সরকারি চাকরিতে তৃতীয় শ্রেণীভুক্ত। তার জন্য প্রযোজ্য ছিল প্রথম শ্রেণীর চাকরি। যারা এর প্রকৃত দাবিদার তাদের করতে হচ্ছে হয়তো পিয়ন কিংবা ঝাড়–দারের চাকরি। এভাবে আমাদের মেধার চরম অপচয় হচ্ছে।
এর মধ্যেই আমরা শুধু হতাশার খবর পাচ্ছি। বিদেশগামী তরুণদের রাস্তাও বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। যারা বাইরে পড়তে যেতে চায় ডলার সঙ্কটের কারণে তাদের বাইরে যাওয়াও সীমিত হয়ে গেছে। যারা বাইরে পড়ছে তাদের জন্য একই কারণে অর্থ পাঠাতে পারছেন না অভিভাবকরা।
আমরা এমন একটা সময় অর্থনৈতিক ধসের মধ্যে পড়লাম যখন আমাদের ক্ষমতাসীনরা উন্নয়নের বাগাড়ম্বর করে বেড়াচ্ছিল। অথচ অর্থনীতির সব সূচক এবং মানুষের জীবনযাপন অত্যন্ত কঠিন অবস্থায় রয়েছে। বেকারত্বের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হিসেবে সমাজে সন্ত্রাস, চাঁদাবাজি, নারী নির্যাতন, কিশোর গ্যাং, মাদক গ্রহণ, মাদকের চোরকারবার এমনকি ছিনতাইসহ সব ধরনের অপরাধের চিত্র ঊর্ধ্বমূখী। সামনে অর্থনৈতিক অবস্থা আরো শোচনীয় হবে। সুতরাং বেকারদের জন্য আপাতত কোনো সুখবর নেই। তাই সামাজিক অস্থিরতাও বাড়বে। কিন্তু এমন দুর্যোগময় অবস্থা অব্যাহত চলতে পারে না। দেশের ভেতরের অনিয়ম-দুর্নীতি সবাই মিলে ঐক্যবদ্ধ হয়ে ঠেকাতে হবে। আমাদের রাজনীতি-অর্থনীতিকে সুস্থ ধারায় ফেরাতে হবে। তাহলে হয়তো অদূর ভবিষ্যতে বেকারত্ব দূরীকরণ নিয়ে আমরা কাজ করতে পারবো।