পাঠ্যপুস্তকের নানা ভুল ও অসঙ্গতি নিয়ে আলোচনা-সমালোচনা ও বিতর্কের মধ্যে সরকার মাধ্যমিক পর্যায়ের ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণির দুটি বই প্রত্যাহার করলো। পাঠ্যপুস্তক ও শিক্ষাক্রম প্রণয়নকারী সরকারি সংস্থা জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড (এনসিটিবি) গত শুক্রবার এক বিজ্ঞপ্তিতে বই দুটি প্রত্যাহারের কথা জানায়। ওই বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, ২০২৩ শিক্ষাবর্ষে ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণির জন্য প্রণীত ইতিহাস ও সামাজিক বিজ্ঞান বিষয়ের ‘অনুসন্ধানী পাঠ’ পাঠ্যপুস্তক দুটি পাঠদান থেকে প্রত্যাহার করা হলো। এর আগে বই নিয়ে বিতর্ক ওঠার পর শিক্ষা মন্ত্রণালয় বিশেষজ্ঞদের নিয়ে একটি ও প্রশাসনিক কর্মকর্তাদের নিয়ে আরেকটি কমিটি করেছিলো; কিন্তু সেই কমিটির প্রতিবেদন আসার আগে বই দুটির পাঠদান প্রত্যাহার করা হলো। গত ১ জানুয়ারি প্রথমে ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণিতে নতুন শিক্ষাক্রম শুরু হয়েছে। আগামী বছর থেকে পর্যায়ক্রমে অন্যান্য শ্রেণিতে নতুন শিক্ষাক্রম বাস্তবায়ন হবে। এভাবে পর্যায়ক্রমে ২০২৭ সালে দ্বাদশ শ্রেণিতে নতুন শিক্ষাক্রম চালু হবে। নতুন শিক্ষাক্রমে মূল্যায়ন ব্যবস্থা, পড়ানোর ধরন ও বইগুলো পুরোপুরি বদলে যাচ্ছে। কিন্তু এতো বড় পরিবর্তন হলেও বাস্তবায়নের কাজটিতে যথাযথ প্রস্তুতি নিতে পারেনি শিক্ষা বিভাগ। পর্যাপ্ত প্রস্তুতিতে যেমন হেলাফেলা ছিলো, তেমনি বইগুলোও তাড়াহুড়ো করে বের করতে গিয়ে অসংখ্য ভুলভ্রান্তি ও অসঙ্গতি রয়ে গেছে। অবস্থা এমন যে, পাঠ্যবইয়ে তথ্যগত ভুল ও অসঙ্গতির পাশাপাশি বানান ভুলের ছড়াছড়ি হয়েছে। অন্যান্য বইয়েও এরকম অসংখ্য বানান ভুল রয়েছে।
শিক্ষাবর্ষ শুরুর এক মাসের বেশি সময় পর এভাবে পাঠ্যবই প্রত্যাহারের সিদ্ধান্ত নজিরবিহীন। বই দুুটির পাঠদান প্রত্যাহার করা মানে, দুটি বই কার্যত বাতিল করে দেয়া। এখন বইগুলো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে তুলে নিতে হবে। শেষ পর্যন্ত কেন দুটি বই বাতিল করতে হলো, সে বিষয়ে এনসিটিবির বিজ্ঞপ্তিতে কিছু বলা হয়নি। তবে সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, তথ্যগত ভুলের চেয়েও বই দুটি বাতিল করা হয়েছে মূলত ‘রাজনৈতিক’ কারণে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেও এ নিয়ে নানামুখী আলোচনা-সমালোচনা চলছিলো।
একটি সহযোগী দৈনিককে এ বিষয়ে এনসিটিবির চেয়ারম্যান বলেছেন, পাঠদান প্রত্যাহার করা বই দুটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে তুলে নেয়া হবে। বাকি তিনটি বই (ষষ্ঠ শ্রেণির অন্য দুটি বই এবং সপ্তম শ্রেণির আরেকটি বই) সংশোধন করা হবে। পাঠ্যবইয়ে ভুল থাকার কথা স্বীকার করলেও তা নিয়ে বিভিন্ন ধরনের বিভ্রান্তি ছড়ানো হচ্ছে, সরকারের দিক থেকে এমন বক্তব্য দেয়া হচ্ছিলো। তবে ভুল সংশোধনের বেশ কিছু উদ্যোগও নেয়া হয়েছিলো সরকারের তরফ থেকে। শিক্ষা মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা যায়, বইগুলোর প্রাথমিক পর্যালোচনায় শিক্ষা বিভাগ দেখতে পেয়েছে, ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণির ইতিহাস ও সামাজিক বিজ্ঞান ‘অনুসন্ধানী পাঠ’ বই দুটির অনেক বিষয়বস্তু আছে, যা এ বয়সী শিক্ষার্থীদের জন্য উপযোগী নয়। শিক্ষা একটি জাতির মেরুদ-। এ নিয়ে হেলাফেলা করার কোনো অবকাশ নেই। কিন্তু দেশে এখনো সময়োপযোগী শিক্ষাব্যবস্থা আমরা গড়ে তুলতে পারিনি।
ফলে দেশের শিক্ষার্থীরা সর্বোচ্চ শিক্ষা নিয়েও সমকালীন বিশ্বে প্রতিযোগিতায় টিকতে পারছেন না। শিক্ষা সবসময় সিরিয়াস বিষয়। আবার টেকসই পাঠ্যপুস্তক হচ্ছে শিক্ষার প্রাথমিক ভিত্তি। কিন্তু সেই পাঠ্যবই প্রণয়নে দেশে চলে হেলাফেলা যার প্রমাণ এবারের মাধ্যমিক পর্যায়ে কয়েকটি শ্রেণির পাঠ্যবই রচনায় তথ্যগত ও বানান ভুলের ছড়াছড়ি। পাঠ্যবইয়ে এতো বেশি মাত্রায় ভুলভ্রান্তির কারণ অদক্ষতা ও দায়িত্বহীনতা। যারা বই লেখেন, তাদের সবাই হয়তো সব তথ্য বা বানান সম্পর্কে পুরোপুরি সচেতন না-ও হতে পারেন। সম্পাদনার কাজটি যদি যত্নসহকারে করা হতো তা হলে তথ্যগত এবং বানান ভুল দুই-ই এড়ানো সম্ভব হতো। তা হলে শিক্ষাবর্ষের এক মাস ১০দিন পর এসে পাঠ্যবই বাতিল করতে হতো না। তবু দেরিতে বোধোদয় হওয়ার পরও ভুলেভরা ও বিতর্কিত পাঠ্যবই বাতিল করা হয়েছে; তা মন্দের ভালো। তবে যাদের কারণে পাঠ্যবই প্রণয়নে এতো ভুল হলো তাদের জবাবদিহির আওতায় আনতে হবে। তা না হলে আগামীতেও এমন ভুলের শঙ্কা রয়ে যাবে।