ওষুধ সাধারণ কোনো ভোগ্যপণ্য নয়, ওষুধ জীবন রক্ষাকারী পণ্য। কিন্তু বিস্ময়কর হলেও সত্য, নকল, ভেজাল ও মানহীন ওষুধে বাজার সয়লাব- ফের এ রকমই উদ্বেগজনক এক চিত্র উঠে এসেছে শুক্রবার মাথাভাঙ্গায় প্রকাশিত একটি প্রতিবেদনে। দেশের ওষুধের বড় পাইকারি বাজার ঢাকার মিটফোর্ডে নকল ওষুধ বিক্রি হচ্ছে- এই গোপন সংবাদের ভিত্তিতে বুধবার রাতে চকবাজারের একটি কুরিয়ার সার্ভিস থেকে গুরুত্বপূর্ণ কিছু নকল ওষুধ আটক করে লালবাগ বিভাগের ডিবি পুলিশ। নকল ওষুধের চক্রের হোতাসহ দুজনকে গ্রেফতার করা হয়। তাদের দেয়া তথ্যের ভিত্তিতে চুয়াডাঙ্গার দর্শনায় সন্ধান মেলে নকল ওষুধ উৎপাদন কেন্দ্রের। সেখানে উৎপাদিত নামিদামি কোম্পানির নকল ওষুধ সরবরাহ করা হতো মিটফোর্ডে। আমরা জানি, এর আগেও মিটফোর্ডে অভিযান চালিয়ে দফায় দফায় নকল-ভেজাল ও মানহীন ওষুধ আটক করা হয়েছিলো। তাতে বোঝা যায়, জীবন নিয়ে সর্বনাশা জুয়া খেলার জাল কতোটা বিস্তৃত।
নকল-ভেজাল পণ্য নিয়ে অসাধুতা ও ভোক্তাকে ঠকিয়ে জীবন হুমকির মুখে ঠেলে দেয়ার অপ্রক্রিয়া আজকের নয়। কিন্তু ওষুধের মতো এত গুরুত্বপূর্ণ উপাদান নিয়ে যে নৈরাজ্য চলছে, এর শিকড়ও যে অনেক গভীরে প্রোথিত বিদ্যমান বাস্তবতা এরই সাক্ষ্য বহন করে। নকল ও ভেজালের দৌরাত্ম্য সীমিত বৃত্ত থেকে কীভাবে ব্যাপক বিস্তার পেয়েছে এটি এরই একটি খণ্ডিত দৃষ্টান্ত। গত বছর মার্চে অনুসন্ধানে উঠে এসেছিলো, ওষুধ প্রশাসনের দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তাদের যোগসাজশে অপকর্ম করেও পার পেয়ে যাচ্ছে দুস্কর্মকারীরা এবং ছোটখাটো কয়েকটি বৈধ কোম্পানিও নকল ওষুধ উৎপাদন করে! নকল ও ভেজাল ওষুধ উৎপাদন ও বিক্রির বিরুদ্ধে ভ্রাম্যমাণ আদালতের অভিযান, মামলা, কারা ও অর্থদণ্ডের সরকারি কার্যক্রমের পরও থেমে নেই এই গুরুতর অপরাধ। দেশি তো বটেই, বিদেশি নামিদামি কোম্পানির ওষুধও নকল করে উৎপাদন ও বিক্রির সঙ্গে যুক্ত এমন চক্রের মূলোৎপাটনে ব্যর্থতার কারণেই তা ডালপালা ছড়িয়েছে।
জানা গেছে, নকল-ভেজাল ও মানহীন ওষুধ উৎপাদনের মূলে রয়েছে মিটফোর্ডে খোলাবাজারে বিক্রি হওয়া কাঁচামাল। আমরা জানি, ওষধ প্রশাসনের অনুমোদন পাওয়া কোম্পানিই কেবল ওষুধ তৈরির কাঁচামাল আমদানি করতে পারে। এ অবস্থায় প্রশ্ন হচ্ছে, ওষধ প্রশাসন ও সংশ্লিষ্ট দায়িত্বশীল মহলের চোখে ধুলা দিয়ে কীভাবে চলছে জীবন ঝুঁকির মুখে ঠেলে দিয়ে অসাধু, নীতিহীনদের এই দুস্কর্ম? যারা ওষুধের মতো জীবনরক্ষাকারী পণ্য নিয়ে এমন অপকর্ম চালাচ্ছে তারা নিঃসন্দেহে জনশত্রæ। বাংলাদেশের ওষুধ শিল্প যখন উল্লেখযোগ্য অবস্থানে পৌঁছেছে এবং দেশের সিংহভাগ চাহিদা মিটিয়ে বিশ্বের অনেক দেশে ওষুধ রপ্তানি করছে-তখন জনশত্রæদের পকেট সম্ফীত করার সর্বনাশা এ কাণ্ড কিছুতেই মেনে নেয়া যায় না। অসুস্থতা থেকে মুক্তির মুখ্য নিয়ামক ওষুধের বাজারে যে নৈরাজ্য চলছে এর দায় ওষুধ প্রশাসন ও সরকার কোনোভাবেই এড়াতে পারে না।
হুবহু ‘আসল’ মোড়কে নকল ওষুধের উৎপাদন ও বিক্রির মতো গুরুতর অপরাধে যারা জড়িত তাদের অপকর্ম যে টোটকা দাওয়াইয়ে নির্মুল হবে না, প্রকাশিত প্রতিবেদনটি এরই ইঙ্গিত দেয়। ক্ষতিকর ওষুধের বিষাক্ত বাজার বিস্তারের কারণ বহুমুখী। ওষুধের পাইকারি বড় বাজারের অবস্থাই যদি এই হয়, তাহলে এর অপছায়া কতোটা ভয়াবহ সর্বনাশের ক্ষেত্র বিস্তৃত করেছে এরও নতুন করে ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণের প্রয়োজন পড়ে না। এই চিত্র জনস্বাস্থ্যের জন্য যেমন চরম হুমকি, তেমনি স্বাস্থ্য প্রশাসনের দায়িত্বশীল অনেকেরই অদক্ষতা ও দুর্নীতির ডুবো পাহাড়ের চ‚ড়ার আভাস দিচ্ছে। এর গভীরের চিত্রটি কেমন, তা সহজেই অনুমেয়। আমরা মনে করি, সরকার এ ব্যাপারে অনমনীয় অবস্থান নিশ্চিত করলে এই অন্ধকার দূর করা দুরূহ নয়। মুনাফার জন্য যারা জীবনের প্রতি এমন হুমকি সৃষ্টি করে তাদের কোনো ছাড় নয়। ওষধ প্রশাসনে শুদ্ধি অভিযান পরিচালনা এবং একই সঙ্গে এর বিস্তৃতকরণও জরুরি। জনস্বাস্থ্য ও জনস্বার্থ এভাবে দুর্নীতিবাজ, স্বার্থাšে^ষীদের মুঠোবন্দি হয়ে পড়তে পারে না। কঠোর প্রতিকারই এর একমাত্র যথাযথ প্রতিবিধান।