দারিদ্র্য নিরসনে প্রয়োজন জোরদার কর্মসূচি

দুই দিনের ব্যবধানে বিশ্বব্যাংক ও আইএমএফ বাংলাদেশের অর্থনীতি নিয়ে যে ভবিষ্যদ্বাণী করেছে, তাতে বিচলিত হওয়ার যথেষ্ট কারণ আছে। ২৪ এপ্রিল বিশ্বব্যাংকের বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট আপডেট প্রতিবেদনে বলা হয়, এ বছর বাংলাদেশে আরও ৩০ লাখ মানুষ অতি গরিব হওয়ার শঙ্কা আছে। অতি দারিদ্র্যের হার বেড়ে ৯ দশমিক ৩ শতাংশ হবে, যা আগে ছিল ৭ দশমিক ৭ শতাংশ। জাতীয় দারিদ্র্য হার গত বছরে ছিলো ২০ দশমিক ৫০ শতাংশ। ২০২৫ সালে তা বেড়ে ২২ দশমিক ৯ শতাংশ হবে। অন্যদিকে ২২ এপ্রিল আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) চলতি বছরে মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) প্রবৃদ্ধি ৩ দশমিক ৮ শতাংশ হবে বলে পূর্বাভাস দিয়েছে, যা গত দেড় দশকের মধ্যে সর্বনিম্ন। আইএমএফের ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক আউটলুক, এপ্রিল ২০২৫-এ এই পূর্বাভাস দেয়া হয়েছে। আইএমএফ সাধারণত পঞ্জিকাবর্ষ ধরে জিডিপি প্রবৃদ্ধি দিয়ে থাকে। তবে সংস্থাটির মতে, ২০২৬ প্রবৃদ্ধি বেড়ে সাড়ে ৬ শতাংশ হবে। দুই সংস্থার এসব তথ্য ও পূর্বাভাস বাংলাদেশের অর্থনীতির নাজুক অবস্থাই তুলে ধরে। আগামী বছর প্রবৃদ্ধি কতটা বাড়বে কিংবা দারিদ্র্যের হার কতটা কমবে, তার চেয়েও জরুরি হলো অর্থনীতির গতি মন্থর হওয়ার কারণগুলো দ্রুত চিহ্নিত করে কার্যকর ব্যবস্থা নেয়া। জুনে ২০২৫-২৬ অর্থবছরের বাজেট পেশ করা হবে। সেই বাজেটে দারিদ্র্য বিমোচন ও নতুন কর্মসংস্থানের লক্ষ্যে জোরালো কর্মসূচি থাকবে কি না। দারিদ্র্যের হার বেড়ে যাওয়ার অন্যতম কারণ মূল্যস্ফীতি। অর্থাৎ যে হারে নিত্যপণ্যের দাম বাড়ে, সে হারে রোজগার না বাড়লে মানুষ দারিদ্র্যের চক্রে ঘুরপাক খাবে। এই অবস্থার উত্তরণে কর্মসংস্থান ব্যাপকভাবে বাড়াতে হবে। বাস্তবতা হলো আওয়ামী লীগ সরকারের শেষ দিকে যে মূল্যস্ফীতি বেড়ে গিয়েছিল, নতুন সরকার ক্ষমতায় আসার সাড়ে আট মাস পরও সেটা কমানো যায়নি। মূল্যস্ফীতির কারণে দারিদ্র্যের হার বেড়ে চললেও সরকার প্রতিকারে টেকসই কোনো পদক্ষেপ নিতে পারেনি। সীমিত আয়ের মানুষের জন্য সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচিও চলছে ঢিমেতালে। সামাজিক সুরক্ষায় তৈরি কার্ডের তালিকা নিয়েও অনেক সমস্যা দেখা দিয়েছে। স্থানীয় জনপ্রতিনিধি ছাড়া কেবল আমলাদের দিয়ে সেটা করা সম্ভবও নয়। আন্তর্জাতিক পরিসরে ক্রয়ক্ষমতা সমতা (পিপিপি) অনুসারে, দিনে ২ দশমিক ১৫ ডলার আয় করে প্রয়োজনীয় পণ্য ও সেবা কেনার সামর্থ্য না থাকলে অতি দরিদ্র হিসেবে ধরা হয়। বাংলাদেশের জাতীয় দারিদ্র্যসীমার মানদ- হলো খাদ্য ও খাদ্যবহির্ভূত পণ্য ও সেবা কেনার জন্য একজন মানুষের প্রতি মাসে গড়ে ৩ হাজার ৮২২ টাকা খরচ করার সামর্থ্য যদি না থাকে, তাহলে তিনি দারিদ্র্যসীমার নিচে চলে যাবেন বা গরিব হয়ে যাবেন। এখানেও আন্তর্জাতিক মান অনুসৃত হয়নি। বিশ্বব্যাংক ও আইএমএফ যখন এসব শঙ্কার কথা বলছে, তখন অর্থনীতির কোনো খাতেই আশাব্যঞ্জক কিছু ঘটছে না। দেশি বা বিদেশি বিনিয়োগের গতি অত্যন্ত মন্থর। প্রথম আলোর প্রতিবেদন অনুযায়ী তৈরি পোশাক খাতে গত ১৫ মাসে ৭৮ হাজার মানুষের কর্মসংস্থান হলেও বেকার হয়েছেন প্রায় এক লাখ। ৮৬ শতাংশের বেশি কর্মসংস্থান হয় অনানুষ্ঠানিক খাতে, যেখানে ন্যূনতম মজুরির নিশ্চয়তা নেই। এ অবস্থায় দারিদ্র্য কমানো সম্ভব নয়। দেশের অর্থনীতির গতি মন্থর হওয়ার আরেকটি কারণ রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা। আমরা মনে করি, নির্বাচন নিয়ে যে ধোঁয়াশা আছে, সেটি কেটে গেলে ব্যবসায়ীরা বিনিয়োগ করতে আগ্রহী হতে পারেন। সে ক্ষেত্রে কর্মসংস্থানও বাড়বে। অতএব দারিদ্র্যের দুষ্টচক্র থেকে বেরিয়ে আসতে প্রয়োজন জোরদার ও সৃজনশীল কর্মসূচি।