দ্রব্যমূল্য ক্রমাগত বৃদ্ধির ফলে সাধারণ মানুষের জীবনে যখন হাঁসফাঁস অবস্থা, তখন আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) চাপে ইন্টারনেটসহ ৬৭ পণ্য ও সেবার ভ্যাট ও সম্পূরক শুল্ক বাড়িয়ে বৃহস্পতিবার একটি অধ্যাদেশ জারি করেছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)। ভ্যাট-সম্পূরক শুল্ক বৃদ্ধি করা পণ্যের এ তালিকায় আছে-ওষুধ, এলপি গ্যাস, মিষ্টি, বিস্কুট, আচার, টমেটো সস, ফলের রস, সিগারেট, বার্নিশ ও লেকার, সাবান ও ডিটারজেন্ট, মোবাইল সেবা ও ব্রন্ডব্যান্ড ইন্টারনেট। এছাড়াও টার্নওভারের তালিকাভুক্তি ও ভ্যাট নিবন্ধনের সীমা কমানো হয়েছে। এতে ক্ষুদ্র ও মাঝারি ব্যবসা প্রতিষ্ঠানকেও ভ্যাটের বিধিবিধান পরিপালন করতে হবে, যা ব্যবসার পরিচালন খরচ বাড়াতে পারে। অধ্যাদেশে বলা হয়েছে, বছরে ৩০ লাখ টাকার বেশি টার্নওভার থাকলে ভ্যাটের খাতায় (টার্নওভার করের তালিকাভুক্তি) নাম লেখাতে হবে, যা আগে ছিল ৫০ লাখ টাকা। এতে ছোট ব্যবসায়ীরাও ভ্যাটের আওতায় চলে আসবেন।
এসব সেবা ও পণ্যের ওপর ভ্যাট ও সম্পূরক শুল্ক বৃদ্ধি করায় স্বাভাবিকভাবেই জীবনযাত্রার ব্যয় আরও একদফা বাড়বে। কারণ, ভ্যাট ও সম্পূরক শুল্ক বাড়ানোর ফলে এসব পণ্য ও সেবার দাম আরও বাড়বে। উদ্বেগের বিষয় হচ্ছে, মূল্যস্ফীতির কারণে নাভিশ্বাস ওঠা সাধারণ মানুষের, বিশেষ করে নিম্নমধ্যবিত্তের ওপর এ সিদ্ধান্ত ‘মড়ার উপর খাড়ার ঘা’ হয়ে দেখা দেবে। মূল্যস্ফীতির ঊর্ধ্বমুখী প্রবণতার কারণে অর্থবছরের মাঝামাঝি সময়ে এসে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড ভ্যাট হার বাড়াতে চায়নি। মূলত আইএমএফের শর্ত পূরণ করতেই ভ্যাট বাড়ানোর এ উদ্যোগ নেয়া হয়েছে বলে মনে করছেন অর্থনীতিবিদরা।
উল্লেখ্য, সম্প্রতি ঋণের শর্ত হিসেবে আইএমএফ ভ্যাটের হার ১৫ শতাংশ করার শর্ত দিয়েছে। বোঝা যাচ্ছে, অর্থনীতির বাস্তবতায় সরকারের ওপর দায়দেনার চাপ বাড়ছে। সরকারের অর্থ দরকার। তাই শুধু আইএমএফের শর্ত পালনই নয়, বিভিন্ন পণ্য ও সেবার ওপর ভ্যাট ও শুল্ক বাড়িয়ে রাজস্ব বাড়ানোরও উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। কিন্তু এক্ষেত্রে বর্তমান বাজার পরিস্থিতি এবং জনগণের ক্রয়ক্ষমতার বিষয়টিও অনুধাবন করা উচিত বলে মনে করি আমরা। নিত্যপণ্য ও সেবার দাম ক্রমাগত বেড়েই চলেছে, অথচ মানুষের আয় সেভাবে বাড়ছে না। বহু মানুষ ভোগ ও অন্যান্য ব্যয় কমাতে বাধ্য হচ্ছে। খাবারের খরচ কমানোর ফলে সাধারণ মানুষের একটি বড় অংশের মধ্যে বাড়ছে পুষ্টিহীনতা। এর প্রভাবে মানুষের রোগ-প্রতিরোধ ক্ষমতাও কমে যাচ্ছে। ভ্যাট ও সম্পূরক শুল্ক হার বৃদ্ধির ফলে মূল্যস্ফীতিই যে কেবল বাড়বে তা নয়, ভ্যাটের বিধিবিধান মানতে না পেরে অনেক ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা তাদের ব্যবসা বন্ধও করে দিতে পারেন। সেটি হলে বেকার হয়ে পড়বে অনেক কর্মী, হুমকিতে পড়বে তাদের পরিবার, দেশের অর্থনীতিতেও পড়বে এর বিরূপ প্রভাব। তাই কোনো দাতাসংস্থার শর্ত বা চাপের কাছে নতি স্বীকার না করে জনস্বার্থকে অগ্রাধিকার দেয়া উচিত। সেক্ষেত্রে ঋণের শর্তের বিষয়ে আইএমএফের সঙ্গে আরও জোরালোভাবে দরকষাকষি করা উচিত ছিল। পণ্য ও সেবার ওপর ভ্যাট ও সম্পূরক শুল্ক বাড়ানোর এ সিদ্ধান্ত সরকার পুনর্বিবেচনার চেষ্টা করবে, এটাই কাম্য।