ভার্চুয়াল মিডিয়ার মধ্যে একধরনের মাদকতা রয়েছে। বিশেষ করে ফেসবুক, টুইটার জাতীয় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে। এই মাধ্যমের জনপ্রিয়তা এতো বেশি বৃদ্ধি পেয়েছে যে, একজন মানুষের হাতে স্মার্টফোন ও ইন্টারনেট থাকলে যখনই সময় বা সুযোগ পান, ফেসবুকে একবার ঢুঁ মেরে আসেন। নতুন বের হয়েছে ‘রিল’ নামক ছোট ভিডিও। সেখানে নিজেকে ভাইরাল করতে যা নয়, তাই করছে কিছু কিছু কনটেন্ট নির্মাতা। স্মার্টফোনের ক্যামেরার মাধ্যমে এখন সকলেই কনটেন্ট ক্রিয়েটর। ভাচুর্য়াল জগতের এই বিপ্লবের নিশ্চয়ই ভালো দিক রয়েছে অনেক। খারাপ দিকটি হলো-অবোধ বাচ্চাদের হাতে দিয়াশলাইয়ের বাক্স তুলে দিলে যা হওয়ার আশঙ্কা থাকে, ফেসবুকেও তেমনি যখন-তখন দাবানল লাগতে দেখা যায়। কী করে ফেসবুক ব্যবহার করতে, কী এখানে লেখা উচিত বা উচিত নয়-এ ব্যাপারে স্কুলিং নেই প্রায় কারোই। প্রত্যেকেই নিজস্ব সিভিক সেন্স দিয়া ফেসবুক চালান। সকলের সিভিক সেন্স উন্নত নয়, ফলে ফেসবুকের বুকে ঝগড়া-ফ্যাসাদ-জটিলতাও চলতেই থাকে। সেই যে অনেক পূর্বে কবি শঙ্খ ঘোষ বলেছিলেন‘ মুখ ঢেকে যায় বিজ্ঞাপনে, ফেসবুকেও তেমনি প্রত্যেকেই নিজস্ব আরশিতে নিজের বিজ্ঞাপন করেন, ভাইরাল হতে চান, নিজেকে গুরুত্বপূর্ণ, জ্ঞানী এবং প্রভাবশালী কিংবা প্রভাবশালীর সঙ্গে সুসম্পর্ককারী ব্যক্তি হিসেবে দেখাতে চান।’ এটি যেন এক অসুস্থ প্রতিযোগিতা। মানুষের এই প্রতিযোগিতায় লাভবান হয়েছে ফেসবুকের কোম্পানি-মেটা। ফেসবুক যে ইহার ব্যবহারকারীর ব্যক্তিগত গোপনীয়তা লঙ্ঘন করে থাকে, এটি নিয়েই অনেকবার প্রশ্ন উঠেছে। একাধিকবার জরিমানা গুনেছে ফেসবুক। গত বছর ব্যক্তিগত গোপনীয়তা লঙ্ঘনের অপরাধে করা মামলায় হেরে গিয়ে সাড়ে ৩ কোটি ৭০ লাখ ডলার ক্ষতিপূরণ দিতে হয়েছে ফেসবুকের মূল প্রতিষ্ঠান মেটা কে। যুক্তরাষ্ট্রের ফ্রান্সিসকোর ফেডারেল আদালত সেই সময় জানিয়েছে, অযাচিতভাবে ব্যবহারকারীর অবস্থান বিভিন্ন বহুজাতিক কোম্পানিকে জানিয়ে দেয়ার মাধ্যমে ফেসবুক মানুষের ব্যক্তিগত গোপনীয়তার আইন ভঙ্গ করেছে। ফেসবুকের সবচাইতে বড় সমস্যা হলো ফেকনিউজের দৌরাত্ম্য। এতে এতো বেশি ফেক নিউজ থাকে যে, অনেকেই এটাকে ‘ফেসবুক’ না বলে ‘ফেকবুক’ বলতে চান। ফেসবুকের অতি সামান্য ভাসমান জ্ঞানই অনেকের জ্ঞান আহরণের প্রধান ক্ষেত্র, ফেসবুকের ফেক নিউজের বেসাতিই অনেকের নিকট প্রধান সংবাদসূত্র! এমতাবস্থায় যা হওয়ার তাই হয়েছে। তথ্যের বিভ্রান্তি ও বিশৃঙ্খলার এক ভয়ানক অরাজকতা দেখা যাচ্ছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোতে। প্রথম কথা হলো-ফেসবুকে ফেকের অভাব নেই। দ্বিতীয়ত, তাতে ব্যক্তিগত তথ্যের গোপনীয়তার বালাই নেই। সুতরাং সহজ প্রশ্ন হলো-মানুষ ফেসবুক কেন ব্যবহার করবে? এই ক্ষেত্রে এককথায় বলা যায়, ফেসবুকেরও রয়েছে অসংখ্য ইতিবাচক দিক। এতে তুলো না টানা যায় ওষুধের সাথে। প্রায় প্রতিটি ওষুধেরই পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া রয়েছে। কিন্তু ওই পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার তুলনায় লাভের পাল্লা অনেক বেশি ভারী থাকে। বিধায় শরীর খারাপ করলে সংশ্লিষ্ট ওষুধের ওপর আমাদের নির্ভর করতে হয় বটে। কিন্তু সমস্যা হলো ফেসবুক ব্যবহারকারী প্রায় সকলেই ‘বিশ্বাস’ করে ফেসবুকে তাদের ‘মনের ভা-ার’ খুলে দিয়ে থাকেন। কিন্তু এ নিয়ে কেউ মাথা ঘামায় না যে, ফেসবুক সেই সকল তথ্য নিয়ে ব্যবসা করতে পারে। বাংলায় একটি প্রবাদ রয়েছে-শিয়ালের নিকট মুরগি বর্গা দেয়া। ফেসবুকের নিকট ব্যক্তিগত তথ্য বর্গা দেয়ার সাথে ওই প্রবাদের খুব বেশি পার্থক্য নেই। মুশকিল হলো, মানুষের তথ্যের গোপনীয়তার নিশ্চয়তা দেয় ফেসবুক। অর্থাৎ শিয়াল হয়ে সে এই ঘোষণা দেয় যে, তার নিকট ব্যক্তিগত-তথ্য নামের মুরগিখানি নিরাপদে রাখা যাবে। কিন্তু শেষাবধি সেই শর্ত ফেসবুক গোপনে বরখেলাপ করে। সুতরাং সাধারণ মানুষকেও বুঝতে হবে, কেবল ফেসবুক নয়, ইন্টারনেটের জগতে প্রদান করা কোনো তথ্যই গোপন থাকে না শেষ পর্যন্ত। কতটুকু তথ্য প্রকাশযোগ্য-তা বুঝে নিতে হবে সাধারণ ব্যবহারকারীকেই। কথা যত কম বলা যায়, ততই বুদ্ধিমানের কাজ।