মেহেরপুর অফিস: বয়সের ভারে ন্যুব্জ। স্বামী মারা গেছেন অনেক বছর আগে। প্রায় ১৫-২০ বছর ধরে পেয়ে আসছেন বয়স্ক ভাতা। এতোকাল পরে জন্ম নিবন্ধন কার্ডে বয়স কম; তাই কেড়ে নেয়া হচ্ছে তাদের বয়স্ক ভাতা’র কার্ড। মাথার চুল পেকে হয়েছে শাদা। বদ্ধ-বৃদ্ধার ছেলে-মেয়েরাও দেখেছেন নাতি-পুতির মুখ। তাহলে আর কত বয়স হলে তিনি বয়স্ক ভাতা পাবেন। আর কাগজপত্রের এসব ভুলের দায়িত্ব কে বহন করবেন? এমন ভুলের কারণে বয়স্ক ভাতা থেকে বঞ্চিত হতে চলেছেন মেহেরপুরের কয়েক হাজার বৃদ্ধ-বৃদ্ধা।
মেহেরপুর সমাজসেবা অফিসসূত্রে জানা যায়, জেলা সমাজসেবা অফিসের আওতায় জেলায় বয়স্কভাতা’র সুবিধাভোগীর সংখ্যা ২০ হাজার ৮০১ জন। এর মধ্যে মেহেরপুর শহর সমাজসেবা অফিসের আওতায় মেহেরপুর পৌরসভার বয়স্ক ভাতার সুবিধাভোগীর সংখ্যা এক হাজার ৩৩৫ জন। এক সময় ৫৭ বছর বয়স হলেই বয়স্ক ভাতার সুবিধা পেতেন। বর্তমানে পুরুষদের ক্ষেত্রে ৬৫ বছর ও নারীদের ক্ষেত্রে ৬২ বছর বয়স হলে বয়স্ক ভাতা পাওয়ার যোগ্য। বয়স্ক ভাতা’র সুবিধাভোগীরা বর্তমানে প্রতি ৩ মাসে ব্যাংকের মাধ্যমে এক হাজার পাঁচশত টাকা করে পেয়ে আসছেন।
সম্প্রতি সরকার বয়স্কভাতা প্রাপ্তীদের সুবিধা বৃদ্ধির জন্য নামের তালিকা ডাটাবেজের মাধ্যমে কম্পিউটারাইজড করার নির্দেশ দেন। এক্ষেত্রে বয়স্কভাতা প্রাপ্ত সুবিধাভোগীদের নাম এন্টি করতে কম্পিউটারে ডাটা এন্টিতে তাদের জাতীয় পরিচয়পত্র (এনআইডি) নং দিলে সকল তথ্য বের হয়ে আসছে। সে ক্ষেত্রে পুরুষ ও নারীর বয়স কম থাকায় তাদের নাম কম্পিউটার ডাটাবেজে এন্টি হচ্ছে না। মেহেরপুর শহর সমাজসেবা অফিসের ডাটা এন্টিতে যেভাবে বয়স্ক ভাতা’র সুবিধাভোগীরা বাদ পড়ছেন সে হিসেবে জেলায় তিন সহ¯্রাধিক সুবিধাভোগী বয়স্ক ভাতা বঞ্চিত হবেন বলে মনে করেন সচেতনমহল। বিধায় জীবনের বাকি সময় বয়স্কভাতা পাবেন না ভেবে দিশেহারা হয়ে পড়েছেন অনেকে।
মেহেরপুর শহরের স্টেডিয়ামপাড়ার শহীদ জাভেদ ওসমান সড়কের বাসিন্দা মৃত সেলিম শেখের স্ত্রী জাহানারা খাতুন। তার দাবি ও স্থানীয়দের দৃষ্টিতে তার বর্তমান বয়স ৭৫ বছর। স্বামী সেলিম শেখ মারা গেছেন ২৫ বছর আগে। ২০০৬ সালে জন্ম নিবন্ধন সনদ করার সময় তার জন্ম নিবন্ধন সনদে জন্ম তারিখ লেখা হয়েছে ২১ মে ১৯৭২ সাল। সে অনুযায়ী করা জাতীয় পরিচয়পত্রে (নং-৮২৪৫০৩০১৪৬) বর্তমানে তার বয়স মাত্র ৪৮ বছর। অন্যদিকে তিনি এক মেয়ে ও ২ ছেলের জননী। তার মেয়ে সেলিনা খাতুনের জাতীয় পরিচয়পত্রে (নং- ৯১৪৫০৬২১২২) জন্ম তারিখ- ১১ এপ্রিল ১৯৭২ সাল। হিসেব মতে মেয়ের চেয়ে মায়ের বসয় ১ মাস ১০ দিন কম।
বৃদ্ধা জাহানারা খাতুন বলেন, মেহেরপুর পৌরসভার ৮নং ওয়ার্ডের সাবেক কাউন্সিলর তৌহিদুল ইসলাম বাবলুর সময় আমাকে একটি বয়স্ক ভাতা’র কার্ড করে দিয়ে হয়েছিলো। সে অনুযায়ী আমি প্রতি তিন মাসে এক হাজার পাঁচশত টাকা করে পেয়ে আসছিলাম। কিন্তু বয়স কম এমন কারণ দেখিয়ে প্রায় ২ সপ্তাহ আগে মেহেরপুর শহর সমাজসেবা অফিস আমার বয়স্কভাতা অনুমোদন না করে বইটি নিয়ে গেছে। ভাতা না পেলে এ বয়সে আমি কি খাবো? তিনি চান বয়স্ক ভাতা অথবা বিধবা ভাতা পেয়ে যেন আমি বাকি জীবনটা কাটাতে পারি।
মেহেরপুর পৌরসভার ৮নং ওয়ার্ডের সাবেক কাউন্সিলর তৌহিদুল ইসলাম বাবলু বলেন, সরকারি সিদ্ধান্তে ২০০৫-২০০৬ সালের দিকে প্রথম জন্ম নিবন্ধন করা শুরু হয়। সরকারি সিদ্ধান্তের পর দেশের নতুন জন্ম নেয়া সন্তানদের জন্ম তারিখ শতভাগ সঠিকভাবে লিপিবদ্ধ হয়েছে। কিন্তু যাদের ২০০৫-২০০৬ সালের আগে জন্ম! তাদের কয়জনের জন্ম তারিখ সঠিকভাবে খাতায় লিপিবদ্ধ হয়েছে? আর সেই সময় বয়স্ক লোকজনের জন্য জন্ম তারিখ নির্ধারণ করা তো আদৌও সম্ভব ছিলো না। সেক্ষেত্রে বয়সের ভারে ন্যুব্জ এবং মাথার চুন পেকে শাদা হয়ে গেছে এমন বৃদ্ধ-বৃদ্ধার বয়স্ক ভাতা’র কার্ড কেড়ে নিয়ে বয়স্ক ভাতা বন্ধ করা নিতান্তই অমানবিক ব্যাপার হবে।
মেহেরপুর শহর সমাজসেবা অফিসার সোহেল মাহমুদ জানান, সরকারি নির্দেশ মতে কম্পিউটারে সুবিধাভোগীদের তালিকা করার জন্য ডাটাবেজে জন্মনিবন্ধন সনদ (এনআইডি) নং এন্টি করায় তাতে চাহিদার চেয়ে বয়স কম থাকায় নাম বাদ পড়ছে। ইতোমধ্যে আমরা ৮৭ জনের ভাতা’র বই ফেরত নিয়ে রেখেছি। সবগুলো এনআইডি কার্ড যদি পাই তবে; তা কম্পিউটারে এন্টি করতে বয়সের অসঙ্গতির জন্য প্রায় দুইশত জন সুবিধাভোগী বয়স্কভাতা বঞ্চিত হবেন। তিনি আরও বলেন, আমাদের অফিসিয়াল কাজ চলছে। তাই এরই মধ্যে বয়স সংশোধন করে যদি তারা নতুন এনআইডি কার্ড আমাদের কাছে জমা দিতে পারেন তবে তারা বয়স্ক ভাতা পাবেন। তবে যারা ব্যর্থ হবেন। আমরা চেষ্টা করবো সেই পরিবারের অন্য কেউ যাতে বয়স্ক ভাতা পান।
এদিকে জানতে চাইলে জেলা সমাজ সেবা অফিসার মো. আব্দুল কাদের জানান, উপজেলা ও শহর সমাজসেবা অফিসগুলোতে বয়স্কভাতা’র সুবিধাভোগীদের ডাটা এন্টি চলছে। দেখি কতজনের নাম তালিকার বাইরে থাকে। তিনি সদিচ্ছা প্রকাশ করে আরও বলেন, বাদ পড়াদের নামের তালিকা করে আমরা সরকারের কাছে পাঠাবো পুনঃবিবেচনার জন্য।