স্টাফ রিপোর্টার: পাঁচটি সংস্কার কমিশন বিভিন্ন ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ যে ১৬৬টি সুপারিশ করেছে সে বিষয়ে বিএনপি ও জামায়াতসহ ৩৪টি রাজনৈতিক দল-জোটের কাছে মতামত জানতে চেয়েছিলো প্রধান উপদেষ্টা প্রফেসর মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন ‘জাতীয় ঐকমত্য কমিশন’। ছক আকারে মতামত জানতে চেয়ে কমিশন গত ৬ মার্চ চিঠি দেয় দল-জোটগুলোকে। চিঠিটি ছিলো মালটিপল চয়েস কোয়েশ্চেন (এমসিকিউ) ধাঁচের। যাতে ‘টিকচিহ্ন’ দিয়ে ১২০টি প্রশ্নের বিষয়ে মতামত জানতে চাওয়া হয়। সঙ্গে পাঁচটি সংস্কার কমিশনের প্রতিবেদনের হার্ডকপিও পাঠিয়েছিল। মতামত জানানোর শেষ দিন আজ বৃহস্পতিবার। তবে এমসিকিউ পদ্ধতিতে ‘টিকচিহ্ন’ দিয়ে মতামত জানাতে অনীহা প্রকাশ করছে বেশির ভাগ দল-জোট। একই সঙ্গে মতামত জানানোর জন্য বিএনপিসহ কয়েকটি দল ও জোট ইতিমধ্যেই কমিশনের কাছে বাড়তি সময় চেয়েছে।
জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সহসভাপতি অধ্যাপক আলী রীয়াজ গত সোমবার জাতীয় সংসদ ভবনের এলডি হলে এক সংবাদ সম্মেলনে জানিয়েছেন, প্রতিটি সুপারিশের ক্ষেত্রে দুটি বিষয়ে মতামত চাওয়া হয়েছে। প্রথমটি হলো, সংশ্লিষ্ট সুপারিশের বিষয়ে একমত কিনা। এতে তিনটি বিকল্প রাখা হয়েছে। সেগুলো হলো- ‘একমত’, ‘একমত নই’ ও ‘আংশিকভাবে একমত’। এ তিনটি বিকল্পের যে কোনো একটিতে টিকচিহ্ন দিয়ে মতামত জানাতে অনুরোধ করা হয়েছে। দ্বিতীয়টি হলো-প্রতিটি সুপারিশের বিষয়ে সংস্কারের সময়কাল ও বাস্তবায়নের উপায়। এক্ষেত্রে ছয়টি বিকল্প আছে। সেগুলো হলো- ‘নির্বাচনের আগে অধ্যাদেশের মাধ্যমে’, ‘নির্বাচনের আগে গণভোটের মাধ্যমে’, ‘নির্বাচনের সময় গণভোটের মাধ্যমে’, ‘গণপরিষদের মাধ্যমে’, ‘নির্বাচনের পরে সাংবিধানিক সংস্কারের মাধ্যমে’ ও ‘গণপরিষদ ও আইনসভা হিসেবে নির্বাচিত সংসদের মাধ্যমে’। এসব ঘরের যে কোনো একটিতে টিকচিহ্ন দিয়ে মতামত দিতে বলা হয়েছে। এর বাইরে প্রতিটি সুপারিশের পাশে দলগুলোর ‘মন্তব্য’ দেয়ার একটি জায়গা রাখা হয়েছে।
জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের পাঠানো প্রতিবেদন ও চিঠির বিষয়ে তিন দিন আগে অনুষ্ঠিত বিএনপির জাতীয় স্থায়ী কমিটির বৈঠকে আলোচনা হয়েছে। বৈঠকে ভার্চুয়ালি সভাপতিত্ব করেন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান। বৈঠকে উপস্থিত থাকা বিএনপির স্থায়ী কমিটির একাধিক সদস্য ইত্তেফাককে জানান, এমসিকিউ পদ্ধতিতে ‘টিকচিহ্ন’ দিয়ে মতামত জানানোর বিষয়টি নিয়ে বৈঠকে সমালোচনা হয়। কেউ কেউ এটিকে পরীক্ষার সঙ্গে তুলনা করে দলগুলোকে পরীক্ষার্থী হিসেবে আন্ডারমাইন্ড করা হয়েছে বলেও মন্তব্য করেন। স্থায়ী কমিটির এক সদস্য জানান, বিষয়টি নিয়ে দলীয় ফোরামে আরো বিস্তারিত আলোচনা করা হবে, একই সঙ্গে মিত্র দল-জোটের সঙ্গেও কথা বলবে বিএনপি। এজন্য মতামত জানাতে ঐকমত্য কমিশনের কাছে আরো সময় চেয়েছে দলটি।
জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সহসভাপতি অধ্যাপক আলী রীয়াজ জানিয়েছেন, পাঁচটি কমিশনের গুরুত্বপূর্ণ সুপারিশগুলোকে ছকের আকারে বিন্যস্ত করা হয়েছে। এই ছকে পুলিশ সংস্কার কমিশনের সুপারিশ যুক্ত করা হয়নি। পুলিশ সংস্কার কমিশন মনে করে, তাদের সুপারিশ প্রশাসনিক ব্যবস্থার মাধ্যমে বাস্তবায়ন সম্ভব। এই ছকগুলো গত ৬ মার্চ ৩৪টি রাজনৈতিক দল ও জোটের কাছে পৌঁছে দেয়া হয়েছে। এতে মোট সুপারিশের সংখ্যা ১৬৬টি। এর মধ্যে সংবিধান সংস্কার সংক্রান্ত সুপারিশ ৭০টি, নির্বাচনব্যবস্থা সংস্কার বিষয়ে সুপারিশ ২৭টি, বিচার বিভাগ সংক্রান্ত সুপারিশ ২৩টি, জনপ্রশাসন সংক্রান্ত সুপারিশ ২৬টি ও দুর্নীতি দমন কমিশন সংক্রান্ত সুপারিশ ২০টি।
সোমবারের সংবাদ সম্মেলনে আলী রীয়াজ বলেছেন, ‘আমরা রাজনৈতিক দল ও জোটগুলোর প্রতি যতদ্রুত সম্ভব মতামত জানাতে সনির্বন্ধ অনুরোধ জানাই। এই প্রক্রিয়ার পরের ধাপ রাজনৈতিক দলগুলোর ওপর নির্ভর করছে। আমরা চাই, দ্রুত আলোচনা করতে এবং স্বল্প সময়ের মধ্যেই ঐকমত্যে পৌঁছে একটি ‘জাতীয় সনদ’ তৈরি করতে।’ তিনি বলেছেন, দলগুলোর মতামত পাওয়ার পর শুরু হবে আলোচনা। আলোচনার সুনির্দিষ্ট দিনক্ষণ ঠিক হয়নি। যখন যে দলের মতামত পাওয়া যাবে, সেসময় থেকেই আলোচনার শুরু হবে। সংবিধান সংশোধন সংক্রান্ত প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেছেন, ‘অধ্যাদেশের মাধ্যমেও সংবিধান সংশোধন করা সম্ভব, অতীতে বাংলাদেশে এটা হয়েছে।’
বিএনপির মিত্র জোট ১২ দলীয় জোটের মুখপাত্র ও এলডিপির একাংশের সভাপতি শাহাদাত হোসেন সেলিম গতকাল বুধবার বলেন, ‘ঐকমত্য কমিশনের পাঠানো প্রতিবেদন ও ছক আকারের চিঠিগুলো নিয়ে ইতিমধ্যেই আমরা ১২ দলীয় জোট বৈঠক করে পর্যালোচনা করেছি। সেখানে এমসিকিউ পদ্ধতিতে ১২০টি প্রশ্নের বিষয়ে টিকচিহ্ন দিয়ে মতামত জানতে চাওয়া হয়েছে। আমাদের জোটের শরিকরা বিষয়টি ভালো চোখে দেখছেন না। রাজনৈতিক দল ও রাজনৈতিক নেতৃত্ব হিসেবে বিষয়টি আমাদের কাছে খুব একটা স্বস্তির মনে হয়নি। এজন্য আমরাও জোটের পক্ষ থেকে মতামত জানানোর জন্য আরো সাত দিন সময় চেয়েছি ঐকমত্য কমিশনের কাছে।’
জাতীয় ঐকমত্য কমিশন ও অন্তর্বর্তী সরকার সূত্রে জানা গেছে, রোজার ঈদের আগেই দল-জোটগুলোর সঙ্গে দ্বিতীয় দফায় সংলাপে বসতে চায় প্রধান উপদেষ্টার নেতৃত্বাধীন এই কমিশন। সেক্ষেত্রে বিএনপি, জামায়াত এবং নবগঠিত জাতীয় নাগরিক কমিটি (এনসিপি) সহ উল্লেখযোগ্য দলগুলোর সঙ্গে কমিশন এককভাবে সংলাপে বসতে চায়। আর যেসব দল নিজেরা অন্য কয়েকটি দল নিয়ে জোটবদ্ধ, তাদের সঙ্গে জোটবদ্ধভাবেই সংলাপ হবে। সেক্ষেত্রে, বিএনপির মিত্র জোট ১২ দলীয় জোট, জাতীয়তাবাদী সমমনা জোটের সঙ্গে জোটবদ্ধ সংলাপ হবে। এছাড়া গণতন্ত্র মঞ্চ, হেফাজতে ইসলাম ও বাম গণতান্ত্রিক জোটসহ অন্যান্য জোটের সঙ্গেও জোটবদ্ধ সংলাপ করতে চায় কমিশন।
যে ৩৪টি দল-জোটের কাছে পাঁচ সংস্কার কমিশনের প্রতিবেদন ও চিঠি পাঠানো হয়েছে সেগুলোর মধ্যে নিবন্ধিত দলের পাশাপাশি নিবন্ধন হারানো জামায়াতে ইসলামী এবং এখনো নিবন্ধনহীন অনেক রাজনৈতিক দলও রয়েছে। নির্বাচন কমিশনে (ইসি) এখনো নিবন্ধন না পাওয়া দলগুলোর মধ্যে নাহিদ ইসলামের নেতৃত্বে গত ২৮ ফেব্রুয়ারি আত্মপ্রকাশ করা তরুণদের নতুন রাজনৈতিক দল ‘জাতীয় নাগরিক পার্টি’ও (এনসিপি) রয়েছে।
গণঅধিকার পরিষদের সভাপতি নুরুল হক নুর গতকাল ইত্তেফাককে জানান, তার নেতৃত্বাধীন দলসহ তাদের জোট ‘গণতন্ত্র মঞ্চ’ ইতিমধ্যে ঐকমত্য কমিশনের পাঠানো প্রতিবেদন ও চিঠিগুলো পর্যালোচনা করেছে। তিনি বলেন, ‘আমরাও আমাদের জোট শরিকদের সঙ্গে এটা নিয়ে আলোচনা করব। এরপর মতামত জানিয়ে দেওয়া হবে কমিশনকে।’
প্রসঙ্গত, প্রধান উপদেষ্টা প্রফেসর মুহাম্মদ ইউনূসকে সভাপতি করে ১২ ফেব্রুয়ারি ছয় মাস মেয়াদি ‘জাতীয় ঐকমত্য কমিশন’ গঠন করে প্রজ্ঞাপন জারি হয়। সংবিধান সংস্কার কমিশনের প্রধান অধ্যাপক আলী রীয়াজ এই কমিশনের সহসভাপতি। এছাড়া নির্বাচন ব্যবস্থা, বিচার বিভাগ, দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক), জনপ্রশাসন এবং পুলিশ সংস্কারবিষয়ক কমিশনের প্রধানরা ঐকমত্য কমিশনের সদস্য। গত ১৫ ফেব্রুয়ারি এই কমিশন ৫৪টি রাজনৈতিক দল-জোটের প্রায় ১০০ জন নেতার সঙ্গে প্রথম বারের মতো রাজধানীর হেয়ার রোডে ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে একত্রে বৈঠক করে।
জানা গেছে, ঐকমত্য কমিশনের সঙ্গে দল-জোটগুলোর প্রথম বৈঠকের প্রক্রিয়া নিয়েও অসন্তোষ রয়েছে বিএনপিসহ কয়েকটি দলে। এই দলগুলোর নেতাদের কেউ কেউ আলাপকালে বলেন, বাস্তবতা হচ্ছে-৩৪টি দল-জোটের মধ্যে বিএনপি ছাড়া অবশিষ্ট ৩৩টি দল-জোট একমত হলেও সেটি বাস্তবায়ন সম্ভব নয়। কিন্তু, ১৫ ফেব্রুয়ারির বৈঠকে অন্যান্য ছোট ছোট দলের নেতাদের মতো করে বিএনপির প্রতিনিধিকেও সময় দেওয়া হয়েছে। ফলে দেখা গেছে, একটি ছোট্ট দল যে সময় পেয়েছে সেখানে কথা বলার, বিএনপির প্রতিনিধিও একই সময় পেয়েছেন। এছাড়া, একটি দল ভেঙে তিন টুকরা হওয়া তিন খ-াংশের তিন নেতাকেও আমন্ত্রণ জানানোর ঘটনা ঘটেছে। যার ফলে, ওই তিনটি খ-াংশের তিন জন নেতা বক্তব্য রাখার সুযোগ পেয়েছেন। দিনশেষে দেখা গেছে, অন্য ছোট দলগুলোর নেতারাই বিএনপির চেয়ে বেশি সময় কথা বলেছেন, মতামত দিয়েছেন। ভবিষ্যতে সংলাপের ক্ষেত্রে বিষয়টি নিয়ে বিএনপির পক্ষ থেকে প্রশ্ন তোলা হবে বলে দলটির দায়িত্বশীল সূত্রে জানা গেছে।