দেশের ১৮ থেকে ৫০ বছর পর্যন্ত সব নাগরিক হিসাব খুলতে পারবেন
স্টাফ রিপোর্টার: সর্বস্তরের জনগণকে পেনশনের আওতায় আনতে চেষ্টা করছে সরকার। সর্বজনীন এই পেনশন স্কিমের সুবিধা পেতে প্রত্যেক নাগরিককে মাসে ন্যূনতম এক হাজার টাকা করে চাঁদা দিতে হবে। ১৮ থেকে ৫০ বছর বয়সী সব নাগরিক এ পেনশন স্কিম গ্রহণ করতে পারবেন। বয়স ৬০ বছর পূর্ণ হলে পেনশন পাওয়া শুরু হবে। সর্বজনীন এ পেনশন স্কিমের আওতায় যারা ১৮ বছর বয়স থেকে প্রতি মাসে এক হাজার টাকা করে নিয়মিত চাঁদা পরিশোধ করবেন তারা ৬০ বছর বয়স থেকে প্রতি মাসে প্রায় ৬৫ হাজার টাকা পেনশন পাবেন। যারা আরও বেশি বয়স থেকে এ স্কিমের আওতায় চাঁদা দিতে শুরু করবেন তাদের পেনশনের পরিমাণ তুলনামূলক কম হবে। চাঁদা এক হাজার টাকার বেশিও দেয়ার সুযোগ থাকবে। সেক্ষেত্রে পেনশনের পরিমাণও বাড়বে। গতকাল বুধবার সরকারি ক্রয়সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটির বৈঠকের পর সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে এ তথ্য জানান অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল। তিনি বলেন, সর্বজনীন পেনশন ব্যবস্থা প্রবর্তন জাতির জন্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার একটি উপহার।
২০০৮ সালের নির্বাচনী ইশতেহারে শেখ হাসিনা দেশের বয়স্ক জনগোষ্ঠীকে একটি টেকসই ও সুসংগঠিত সামাজিক নিরাপত্তা কাঠামোর আওতায় বৃদ্ধকালীন সুরক্ষা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে জাতীয়ভাবে সর্বজনীন পেনশন ব্যবস্থা প্রবর্তনের অঙ্গীকার করেছিলেন। ২০১৯-২০২০ অর্থবছরের বাজেট বক্তৃতায় সর্বজনীন পেনশন পদ্ধতি চালুর সুনির্দিষ্ট ঘোষণা দেয়া হয় উল্লেখ করে অর্থমন্ত্রী বলেন, ‘সেই ধারাবাহিকতায় আন্তর্জাতিক অভিজ্ঞতা, বাংলাদেশের প্রেক্ষাপট এবং সক্ষমতা বিবেচনায় নিয়ে সর্বজনীন পেনশন ব্যবস্থা প্রবর্তনের জন্য একটি কৌশলপত্র প্রণয়ন করা হয়েছে। দেশের মানুষের বর্তমান গড় আয়ুষ্কাল ৭৩ বছর যা ২০৫০ সালে ৮০ এবং ২০৭৫ সালে ৮৫ বছর হবে বলে প্রক্ষেপণ করা হয়েছে।’ অর্থমন্ত্রী আরও বলেন, এ থেকে প্রতীয়মান হয়, আগামী তিন দশকে একজন কর্মজীবী ব্যক্তি অবসর গ্রহণের পরও গড়ে ২০ বছর আয়ু থাকবে। বর্তমানে বাংলাদেশে নির্ভরতার অনুপাত (ডিপেন্ডেন্সি রেশিও) ৭ দশমিক ৭ শতাংশ, যা ২০৫০ সালে ২৪ এবং ২০৭৫ সালে ৪৮ শতাংশে উন্নীত হবে। গড় আয়ুষ্কাল বৃদ্ধি ও ক্রমবর্ধমান নির্ভরতার অনুপাতের বিবেচনায় বার্ধক্যের নিরাপত্তা হিসেবে সর্বজনীন পেনশন ব্যবস্থা খুবই জরুরি বলে উল্লেখ করেন তিনি। মুস্তফা কামাল বলেন, সুবিধাভোগী বছরে ন্যূনতম বাৎসরিক জমা নিশ্চিত করবে। অন্যথায় তার হিসাব সাময়িকভাবে স্থগিত হবে এবং পরবর্তীকালে বিলম্ব ফিসহ বকেয়া চাঁদা প্রদানের মাধ্যমে হিসাব সচল করা হবে। সুবিধাভোগী আর্থিক সক্ষমতার ভিত্তিতে চাঁদা হিসেবে বর্ধিত অর্থ (সর্বনিম্ন ধাপের অতিরিক্ত যেকোনো অঙ্ক) জমা করতে পারবে। পেনশনের জন্য নির্ধারিত বয়সসীমা (৬০ বছর) পূর্তিতে পেনশন তহবিলে পুঞ্জীভূত লভ্যাংশসহ জমার বিপরীতে নির্ধারিত হারে পেনশন প্রদেয় হবে। দেশের সব নাগরিকের জন্য প্রবর্তিত এ ব্যবস্থার মধ্যে আরও রয়েছে পেনশনাররা আজীবন অর্থাৎ মৃত্যুর পূর্বপর্যন্ত পেনশন ভোগের সুবিধা। নিবন্ধিত চাঁদা জমাকারী পেনশনে থাকাকালীন ৭৫ বছর পূর্ণ হওয়ার আগে মারা গেলে তার নমিনি পেনশনের অবশিষ্ট সময়কালের জন্য মাসিক পেনশন প্রাপ্য হবেন। পেনশন স্কিমে জমা করা অর্থ কোনো পর্যায়ে এককালীন উত্তোলনের সুযোগ থাকবে না। তবে আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে জমা করা অর্থের সর্বোচ্চ ৫০ শতাংশ ঋণ হিসেবে উত্তোলন করা যাবে যা সুদসহ পরিশোধ করতে হবে। চাঁদা প্রদানকারী পেনশনপ্রাপ্ত হওয়ার আগে মারা গেলে জমা করা অর্থ মুনাফাসহ তার নমিনিকে ফেরত দেয়া হবে। পেনশনের জন্য নির্ধারিত চাঁদা বিনিয়োগ হিসেবে গণ্য করে কর রেয়াতের জন্য বিবেচিত হবে এবং মাসিক পেনশন বাবদ প্রাপ্ত অর্থ আয়কর মুক্ত থাকবে।
এ ব্যবস্থা স্থানান্তরযোগ্য ও সহজগম্য; অর্থাৎ কর্মী চাকরি পরিবর্তন বা স্থান পরিবর্তন করলেও তার অবসর হিসাবের স্থিতি, চাঁদা প্রদান ও অবসর সুবিধা অব্যাহত থাকবে। অর্থমন্ত্রী এ ব্যবস্থার একটি অনুমানভিত্তিক হিসাবও দিয়েছেন। যাতে দেখা যায় যদি মাসিক চাঁদা ১০০০ টাকা, মুনাফা ১০ শতাংশ ও আনুতোষিক ৮ শতাংশ ধরা হয় তাহলে ১৮ বছর বয়সে যদি কেউ চাঁদা প্রদান শুরু করে এবং ৬০ বছর বয়স পর্যন্ত তা চালু থাকে তাহলে ওই ব্যক্তি অবসরের পর ৮০ বছর বয়স পর্যন্ত প্রতি মাসে ৬৪ হাজার ৭৭৬ টাকা পেনশন পাবেন। যদি ৩০ বছর বয়সে চাঁদা প্রদান শুরু করেন এবং ৬০ বছর পর্যন্ত তা অব্যাহত থাকে তাহলে অবসরের পর প্রতিমাসে ১৮ হাজার ৯০৮ টাকা পেনশন পাবেন। প্রস্তাবিত সর্বজনীন পেনশন ব্যবস্থার উল্লেখযোগ্য দিকগুলো তুলে ধরে অর্থমন্ত্রী বলেন, ‘বিদেশে কর্মরত বাংলাদেশি কর্মীরা এ কর্মসূচিতে অন্তর্ভুক্ত হতে পারবেন। সরকারি ও স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানে কর্মরত কর্মচারীদের আপাতত নতুন জাতীয় পেনশন ব্যবস্থার বাহিরে রাখা হয়েছে। ভবিষ্যতে এ বিষয়ে সরকার সিদ্ধান্ত নেবে।’ তিনি জানান, সর্বজনীন পেনশন ব্যবস্থার আওতায় প্রতিটি নাগরিকের জন্য একটি পৃথক পেনশন হিসাব থাকবে ফলে চাকরি পরিবর্তন করলেও পেনশন হিসাব অপরিবর্তিত থাকবে। অর্থমন্ত্রী জানান, এ পদ্ধতিতে প্রতিষ্ঠানের অংশগ্রহণের সুযোগ থাকবে। তবে এ ক্ষেত্রে কর্মী বা প্রতিষ্ঠানের চাঁদা জাতীয় পেনশন র্কর্তৃপক্ষ কর্তৃক নির্ধারিত হবে। মাসিক সর্বনিম্ন চাঁদার হার নির্ধারিত থাকবে; তবে প্রবাসী কর্মীদের সুবিধার্থে ত্রৈমাসিক ভিত্তিতে তারা চাঁদা জমা দিতে পারবেন। আগামী ছয় মাস থেকে এক বছরের মধ্যেই এই স্কিম চালু করা সম্ভব বলে আশা করছেন অর্থমন্ত্রী। এর আগে আইন ও বিধি প্রণয়ন এবং আলাদা একটি র্কর্তৃপক্ষ গঠন করতে হবে বলেও জানান তিনি। নিম্ন আয়সীমার নিচের নাগরিকদের ক্ষেত্রে পেনশন স্কিমে মাসিক চাঁদার একটি অংশ সরকার অনুদান হিসেবে প্রদান করতে পারে। পেনশন কর্তৃপক্ষসহ সংশ্লিষ্ট অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের ব্যয় সরকার নির্বাহ করবে এবং পেনশন র্কর্তৃপক্ষ ফান্ডে জমাকৃত টাকা নির্ধারিত গাইডলাইন অনুযায়ী বিনিয়োগ করবে।