স্টাফ রিপোর্টার: স্থানীয় সরকারের সব স্তরের জন্য একীভূত আইন প্রণয়ন, রাষ্ট্রপতি পদ্ধতি থেকে সংসদীয় পদ্ধতিতে রূপান্তর (কাউন্সিলর বা মেম্বারদের ভোটে মেয়র বা চেয়ারম্যান নির্বাচন) এবং দলীয় প্রতীক ছাড়া নির্বাচন পদ্ধতি চালুসহ একগুচ্ছ সুপারিশ করছে স্থানীয় সরকার সংস্কার কমিশন। সোমবার রাজধানীর আগারগাঁওয়ে স্থানীয় সরকার ইনস্টিটিউটে সাংবাদিকদের সঙ্গে মতবিনিময়কালে এসব সুপারিশের কথা উঠে আসে কমিশনের সদস্যদের কথায়। মতবিনিময়কালে সভায় কমিশনের সদস্যরা বলেন, দেশের স্থানীয় সরকার ব্যবস্থায় অর্থাৎ-সিটি করপোরেশন, পৌরসভা, জেলা পরিষদ, উপজেলা পরিষদ এবং ইউনিয়ন পরিষদের গুণগত পরিবর্তন আনতে একগুচ্ছ সুপারিশ করবেন তারা। এর বাস্তবতা বুঝতে দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে শুরু করে রাজধানীর সর্বোচ্চ পর্যায়ের বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষের মতামত গ্রহণ করা হচ্ছে। আগামী ফেব্রুয়ারির মধ্যে চূড়ান্ত সুপারিশ অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের কাছে জমা দেয়া হবে। তারা আরও বলেন, জাতীয় এবং স্থানীয় সরকার নির্বাচন একসঙ্গে করলে খরচ অনেক কম হবে। তবে এখানে অনেক চ্যালেঞ্জ রয়েছে। এজন্য স্থানীয় সরকারের সব নির্বাচনকে একত্রে করার সুপারিশ করা হচ্ছে। এতে সুবিধা হবে, খরচ অনেকাংশে কমে আসবে। ২০২১ থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত স্থানীয় সরকার নির্বাচনে ২৩ হাজার কোটি টাকা খরচ করেছে সরকার। যেটা একত্রে করলে ৬০০ কোটি টাকায় করা সম্ভব হতো।
এতদিন স্থানীয় সরকার নির্বাচন বাস্তবায়ন করা নির্বাচন কমিশনের জন্য ঐচ্ছিক ব্যাপার ছিল; যেটা স্থানীয় সরকার বিভাগের অনুরোধে অন্যান্য কার্যক্রমের অংশ হিসাবে নির্বাচন কমিশন বাস্তবায়ন করত; এটাকে নির্বাচন কমিশনের বাধ্যতামূলক কাজের অংশ করার সুপারিশ করা হচ্ছে। একই সঙ্গে স্থানীয় সরকারের স্তরগুলো থেকে আইনবহির্ভূত চর্চা তুলে দিয়ে নারীর ক্ষমতায়ন বাড়ানোর সুপারিশ করা হবে।
তারা জানান, এ সময় স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানের জনপ্রতিনিধিদের কাজে সংসদ সদস্যরা (এমপি) যাতে অযাচিত নিয়ন্ত্রণ করতে না পারেন, সে ব্যাপারে সুপারিশ থাকছে। তবে এমপিদের জেলা পরিষদের উপদেষ্টার ভূমিকায় রাখা যেতে পারে। তাদের উন্নয়ন প্রক্রিয়া থেকে একেবারে দূরে রাখাটা ভালো হবে না।
জেলা পরিষদের কাজ হবে-পরিকল্পনা প্রণয়ন করা এবং এর আওতাধীন স্থানীয় সরকারের অন্য স্তরগুলোকে দিয়ে তা বাস্তবায়ন করা। জেলা পরিষদকে ঢেলে সাজাতে প্রত্যেক উপজেলাকে জেলা পরিষদের ৩টি ওয়ার্ড করা যেতে পারে। জেলা পরিষদের জনপ্রতিনিধিরাও নির্বাচনের মাধ্যমে বিজয়ী হবেন। জেলা পরিষদকে পুনর্বাসন কেন্দ্র বানানোর চিন্তা থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। এছাড়া স্থানীয় সরকারের পার্বত্য জেলাগুলোর ভূমিকায় সংস্কারের প্রস্তাব নিয়ে ভাবছে কমিশন।
বিশেষ করে জেলা পরিষদ নির্বাচন অনুষ্ঠানের বিষয়ে সংস্কার প্রস্তাব করবে। কেননা পার্বত্য অঞ্চলও বাংলাদেশের অংশ; সেখানে ১৯৮৯ সালের পর আর কোনো নির্বাচন হয়নি। স্থানীয় সরকারে এটা কোনোভাবেই হতে পারে না।
স্থানীয় সরকার সংস্কার কমিশনের প্রধান অধ্যাপক ড. তোফায়েল আহমেদ বলেন, বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচন হওয়ার পথ বন্ধ করতে হবে। একক প্রার্থী থাকলে সেখানে পুনরায় তফশিল ঘোষণা করা উচিত। কত শতাংশ ভোট পড়লে নির্বাচন বৈধ হবে; সেটি নির্ধারণ করতে হবে। স্থানীয় সরকার ব্যবস্থায় সব সিদ্ধান্ত ও অনুমোদন করবেন জনপ্রতিনিধিরা। সরকারি কর্মচারীরা শুধু সাচিবিক ভূমিকা পালন করবেন।
স্থানীয় সরকারের যে কোনো সিদ্ধান্ত ও অনুমোদনে জনপ্রতিনিধিরা সংসদ সদস্যদের প্রভাবমুক্ত থাকবেন। সংসদ সদস্যরা তাদের কার্যক্রমে কোনোরকম হস্তক্ষেপ করতে পারবেন না। জনপ্রতিনিধিদের কার্যক্রমের বিষয়ে অভিযোগ দেয়া ও তার প্রতিকারের ব্যবস্থাও থাকতে হবে। এছাড়া বছর শেষে জনপ্রতিনিধিদের কাজের মূল্যায়নের ব্যবস্থা থাকতে হবে, যা একটি নীতিমালার মাধ্যমে বাস্তবায়ন করা যেতে পারে।
তিনি বলেন, স্থানীয় সরকার নির্বাচনে স্কুল-কলেজের শিক্ষক বা চাকরিজীবীদের সুযোগ দেওয়া যেতে পারে। বিশেষ করে বেসরকারি স্কুল-কলেজের শিক্ষকদের নির্বাচনে সুযোগ দিলে ‘জনপ্রতিনিধিত্ব’ নির্ভর জীবিকা থেকে স্থানীয় সরকারকে বের করে আনা সম্ভব হবে এবং এটা পার্টটাইম হিসাবে তারা করতে পারবেন।
তিনি জানান, মফস্বল এলাকা থেকে জাতীয় নির্বাচনের আগে স্থানীয় সরকার নির্বাচন করার সুপারিশ বেশি আসছে। আমাদের কাছে সুপারিশ আসছে আগে স্থানীয় সরকার নির্বাচন করার জন্য। মানুষ বলছে, স্থানীয় জনপ্রতিনিধি না থাকায় তারা কাক্সিক্ষত সেবা পাচ্ছেন না। একটা শূন্যতা তৈরি হয়েছে। এ শূন্যতা দূর করতে তারা আগে স্থানীয় নির্বাচন চাচ্ছেন।
স্থানীয় সরকার নির্বাচন আগে, নাকি জাতীয় নির্বাচন আগে করা দরকার-এ বিষয়ে স্থানীয় লোকদের মতামত নিতে হবে। এক্ষেত্রে একইভাবে রাজনৈতিক দলগুলোর স্থানীয় পর্যায়ের নেতাদের মতামতও একই।
সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে ড. তোফায়েল আহমেদ বলেন, দেশের নগর সম্প্রসারণ ঘটছে। আগামী ১০ বছর বা দ্রুততম সময়ে দেশের সিংহভাগ এলাকা নগরায়ণের আওতায় চলে আসছে। এজন্য ভবিষ্যতে স্থানীয় সরকারের স্তরগুলোকে কমিয়ে আনার সুযোগ সৃষ্টি হবে। দেশে দুই ধরনের সরকার রয়েছে, এর একটি কেন্দ্রীয় সরকার এবং অন্যটি স্থানীয় সরকার। স্থানীয় সরকারকে ঢেলে সাজাতে কাজ করতে হবে এবং এটাকে গুরুত্ব দিতে হবে। স্বায়ত্তশাসিত হলে অর্থায়ন বন্ধ করা যাবে।
তিনি বলেন, কেন্দ্রীয় সরকার সব ধরনের ট্যাক্স আদায় করে থাকে। সেখান থেকে স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানগুলোকে বরাদ্দ দিতে হবে। তাহলে স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানগুলো শক্তিশালী হবে, সেখানে মেধাবীরা চাকরি নেবে এবং একটি শক্তিশালী কাঠামো গড়ে উঠবে। তখন এসব প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে কার্যকরভাবে জনগণের সেবা নিশ্চিত করা সম্ভব হবে।
মতবিনিময় সভায় কমিশনের সদস্যরা বলেন, দেশের অনেক পৌরসভার আর্থিক অবস্থা ভালো নয়। অনেক পৌরসভার মাসের পর মাস বেতন বাকি; এগুলো বিলুপ্ত করা যায় কি না তা ভেবে দেখতে হবে। পৌরসভাগুলোকে ইউনিয়ন পরিষদের সঙ্গে একীভূত করা যায় কি না তা নিয়েও সংস্কার কমিশন ভাবছে। একই সঙ্গে পৌরসভাসহ স্থানীয় সরকারের স্তরগুলোকে সাংগঠনিকভাবে শক্তিশালী করে স্বতন্ত্র সার্ভিস কাঠামো গড়ে তোলার সুপারিশ করব; এটা ক্যাডার বা নন-ক্যাডার যে কোনোটি হতে পারে।
মতবিনিময় সভায় অন্যান্যের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন-স্থানীয় সরকার সংস্কার কমিশনের সদস্য অধ্যাপক ড. ফেরদৌস আরফিনা ওসমান, আবদুর রহমান, মাশহুদা খাতুন শেফালী, অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ তারিকুল ইসলাম, ইলিরা দেওয়ান এবং অধ্যাপক ড. কাজী মারুফুল ইসলাম প্রমুখ।