সিনেমা স্টাইলে চলছে মোটরসাইকেল ॥ দুটি দুর্ঘটনায় ৩ ছাত্র নিহত

মেহেরপুরের গাংনীতে যাত্রীবাহী বাস ও মোটরসাইকেলের মুখোমুখি সংঘর্ষ

গাংনী প্রতিনিধি: দুই কিশোর মোটরসাইকেলে আনন্দ করতে করতে উড়ছিলো। পেছনের জন্য দাঁড়িয়ে দুই হাত তুলে উল্লাস করছিলেন। বেপরোয়া গতিতে মোটরসাইকেলটি গিয়ে যাত্রীবাহী বাসের সামনে ধাক্কা দেয়। এতে বাসের সামনের অংশ মুচড়ে যায়। একইসাথে মোটরসাইকলেটি হয় খন্ড – বিখন্ড। ফলাফল একজনের মৃত্যু ঘটনাস্থলে; আরেকজনের মৃত্যু হাসপাতালে নেয়ার পথে। মর্মান্তিক এই মোটরসাইকের দুর্ঘটনার স্থান মেহেরপুর-কুষ্টিয়া সড়কের আকুবপুর নামকস্থানে। গতকাল বুধবার বিকেলে এ দুর্ঘটনা ঘটে। নিহতরা দুজন হচ্ছে গাংনী উপজেলার পিরতলা গ্রামের আলেক হোসেনের ছেলে সিয়াম হোসেন (১৭) এবং একই গ্রামের সোহরাব হোসেন সেন্টুর ছেলে আব্দুল্লাহ আল বাকি (১৭)। নিহত দুজনের পিতা প্রবাসী। নিহত দুজন কুষ্টিয়া ইসলামিয়া কলেজের প্রথম বর্ষের ছাত্র। ঘটনার সময় কলেজ থেকে বাড়ি ফিরছিলেন তারা।
এদিকে গতকাল বুধবার সন্ধ্যায় একই সড়কের ওলিনগর গ্রামে সবজি বোঝাই ট্রাকের ধাক্কায় শিপন আলী (১৭) নামের অপর এক কিশোর নিহত হয়েছেন। এ সময় আহত হয়েছেন তার খালাতো ভাই খোকন (২৩)। নিহত শিপন আলী গাংনী উপজেলার চিৎলা গ্রামের হাফিজুল ইসলামের ছেলে। তিনি গাংনী হাইস্কুল এন্ড কলেজের বিএম প্রথম বর্ষের ছাত্র। বাবার গরু বিক্রির টাকা দিয়ে কয়েকদিন আগে একাই মোটরসাইকেল কিনেছিলেন সিপনকে।
প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, সিয়াম ও বাকি একটি দ্রুত গতির মোটরসাইকেল কুষ্টিয়ার দিক থেকে বামন্দীর দিকে আসছিলেন। আকুবপুর মাঠের ভিতরে পৌঁছালে মেহেরপুর থেকে কুষ্টিয়াগামী একটি যাত্রীবাহী বাস (যার নম্বর কক্সবাজার জ-০৪ ০০২১) এর মুখোমুখি সংঘর্ষ হয়। এতে ঘটনাস্থলে নিহত হন মোটরসাইকেল চালক সিয়াম হোসেন। গুরুতর আহত অবস্থায় আব্দুল্লাহ আল বাকীকে উদ্ধার করে কুষ্টিয়ার মেডিকেলের উদ্দেশ্যে রওনা দেন কয়েকজন। তবে গাংনী-কুষ্টিয়ার মাঝামাঝি মিরপুর নামক স্থানে পৌঁছুলে মুত্যুর কোলে ঢলে পড়েন বাকী। দুর্ঘটনা কবলিত বাসটি আটক করে স্থানীয় লোকজন। তবে মোটরসাইকেলের দ্রুত গতি দুর্ঘটনার কারণ বলে জানিয়েছেন প্রত্যক্ষদর্শীরা।
নিহত দুই কিশোরের গ্রামে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, সিয়ামের পিতা সৌদি প্রবাসী। কয়েক লাখ টাকার সুজকি মোটরসাইকেল চড়ে সিয়াম। নিহত বাকির বাবাও থাকেন সৌদিতে। পবিত্র উমরাহ পালনের জন্য কিছুদিন আগে বাকির মাকে সৌদিতে নিয়ে গেছেন তার বাবা। মূলত প্রবাসী বাবার টাকায় কেনা দ্রুত গতির মোটরসাইকেল এবং পরিবারের শাসন না থাকায় সিয়াম ও বাকী বেপরোয়া মোটরসাইকেল চালিয়ে বেড়ায় বলে জানা গেছে।
স্থানীয়রা জানান, প্রবাসে যারা আছেন তারা পরিবারের মুখে হাঁসি ফুটাতে অনেক কষ্ট স্বীকার করেন। তাদের রক্তঘামে কেনা হয় সন্তানদের মোটরসাইকেল। কিন্তু একদিকে কিশোর বয়স অন্যদিকে পরিবারের অনুশাসন না থাকায় এসব কিশোররা ভুল করেই থাকে। কিশোর সন্তানদের হাতে যত্রতত্র মোটরসাইকেল তুলে দেয়ায় প্রায়ই এ দুর্ঘটনায় অকালে ঝরে যাচ্ছে অকেন তরতাজা প্রাণ।
এদিকে মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় দুই কিশোর নিহতের ঘটনা এলাকায় প্রধান আলোচনার বিষয় ছিলো। এর মধ্যেই বামন্দীর অদূরবর্তী ওলিনগর গ্রামে ঘটে আরও একটি মোটরসাইকেল দুর্ঘটনা। চিৎলা গ্রামের শিপন আলী ও তার খালাতো ভাই খোকন মোটরসাইকেলযোগে গাংনী থেকে বামন্দীর দিকে যাচ্ছিলেন। ওলিনগর পৌঁছুলে একটি সবজি বোঝায় ট্রাককে ওভারটেক করার সময় নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ছিটকে পড়ে। এতে ট্রাকের চাকার নিচে পিষ্ট হয়ে ঘটনাস্থলেই মৃত্যুবরণ করে সিপন। আহত অবস্থায় খোকনকে একটি ক্লিনিকে চিকিৎসা দেয়া হয়েছে। এ দুর্ঘটনার পেছনেও অপ্রাপ্ত বয়স্ক ছেলের হাতে দ্রুত গতির মোটরসাইকেলকে দায়ী করছেন স্থানীয়রা।
চিৎলা গ্রামে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, নিহত সিপনের পিতা হাফিজুল ইসলাম একজন কৃষক। গেল মাসের ২৯ তারিখে বাড়িতে পালিত একটি গরু বিক্রি করেন হাফিজুল ইসলাম। পিতা-মাতাকে না বলে সেই টাকা নিয়ে একাই একটি পালসার মোটরসাইকেল কিনে আনে সিপন। সেই মোটরসাইকেল নিয়েই তারা দুজন গতকাল বামন্দীর দিকে যাচ্ছিলো।
স্থানীয়রা জানান, একদিকে অল্প সময়ে মোটরসাইকেল চড়ার অভিজ্ঞতা অন্য দিকে কিশোর বয়স; এই দুয়ে মিলে দুর্ঘটনার ফলাফল মৃত্যু।
সচেতন মহলের মতে, সড়ক প্রশস্থ হওয়ার পাশাপাশি কিশোরদের হাতে আসছে দ্রুত গতির বাইক। ভাল রাস্তায় তাই অনেকেই সিনেমা স্টাইলে দ্রুত গতিতে মোটরসাইকেল চালাচ্ছে। যা নিত্যদিনের ঘটনা। ফলে প্রায়ই দুর্ঘটনায় হারাচ্ছে তাজা প্রাণ। তাই পরিবারের অনুশাসনের পাশাপাশি অপ্রাপ্তদের হাতে মোটরসাইকলে নিয়ন্ত্রণে আইনের কঠোর প্রয়োগ এখন সময়ের দাবী।
গাংনী থানার পরিদর্শক (তদন্ত) আল মামুন জানান, দুটি সড়ক দুর্ঘটনায় থানায় পৃথক দুটি মামলা দায়ের করা হয়েছে। নিহতদের পরিবারের পক্ষে মামলা দুটি করা হয়। তবে তাদের দাবির প্রেক্ষিতে আইনগত প্রক্রিয়া অনুসরণের মাধ্যমে মরদেহ ময়নাতদন্ত ছাড়াই তাদের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে।