সম্প্রীতি ও ঐক্য প্রতিষ্ঠার লক্ষ্য : নতুন প্রত্যাশা ও অশুভ শক্তিকে বধ করার প্রত্যয়

নতুন বাংলাদেশে এলো বৈশাখ : ভিন্ন আবহে বর্ষবরণের প্রস্তুতি

স্টাফ রিপোর্টার: ভিন্ন এক পরিবেশে নতুন বাংলা বছরকে স্বাগত জানাতে যাচ্ছে বাংলাদেশ। ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থান পরবর্তী বাংলাদেশের প্রথম নববর্ষ। বদলে যাওয়া বাংলাদেশে ১৪৩২ বঙ্গাব্দকে প্রত্যাশা করা হচ্ছে সম্প্রীতির বন্ধনের বছর হিসেবে। সব মত, পথ ও সম্প্রদায়ের ভেদাভেদ ভুলে নতুন বাংলাদেশ গড়ে তোলার আকাক্সক্ষা সর্বত্র। এবার পরিবর্তন আনা হয়েছে উদ্যাপনের ঢঙে। ‘নববর্ষের ঐকতান, ফ্যাসিবাদের অবসান’- এ প্রতিপাদ্য নিয়ে দেশব্যাপী আয়োজন করা হয়েছে নানান আয়োজনের। প্রথমবারের মতো সরকারও সম্পৃক্ত হয়েছে একডজনের বেশি আয়োজনে। তবে প্রতিবছরের মতো এবারও বর্ণাঢ্য আনন্দ শোভাযাত্রার মাধ্যমে দিনটি পালন করবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) চারুকলা অনুষদ। এ শোভাযাত্রায় থাকবে নতুন শুভদিনের প্রত্যাশা ও অশুভ শক্তিকে বধ করার প্রত্যয়। এদিকে, চুয়াডাঙ্গা জেলা প্রশাসনের কর্মসূচির সময় সূচিতে কিছু পরিবর্তন আনা হয়েছে। নতুন সময় সূচিতে বলা হয়েছে; আজ সোমবার সকাল ৮টায় চাঁদমারী মাঠে জাতীয় সংগীত ও এসো হে বৈশাখ গান পরিবেশনের মাধ্যমে অনুষ্ঠানের শুভ সূচনা। সোয়া ৮টায় অন্তর্ভুক্তিমূলক সার্বজনীন শোভাযাত্রায় সকল গোষ্ঠি, ব্যক্তি, পরিবার, সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠান, এনজিও, বিভিন্ন সংগঠন ও বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বর্ণিল সাজে অংশগ্রহণ করবে। শোভাযাত্রা শেষে চুয়াডাঙ্গা সরকারি কলেজের সামনে মুক্তমঞ্চ মাঠে তিনদিন ব্যাপী লোকজ সাংস্কৃতিক মেলা উদ্বোধন। মুক্তমঞ্চে বেলা ৩টা থেকে সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত প্রতিদিন চুয়াডাঙ্গা জেলার বিভিন্ন সাংস্কৃতি সংগঠনের পরিবশেনায় সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। সুবিধাজনক সময়ে সরকারি শিশু সদন, সদর হাসপাতাল এবং জেলা কারাগারে ঐতিহ্যবাহী বাংলা খাবার সরবরাহ। এছাড়া সকল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় উৎসবমুখর পরিবেশে ও সাড়স্বরে বাংলা নববর্ষ উদযাপন করতে হবে। ৩ বৈশাখ বুধবার সাড়ে ৫টায় চুয়াডাঙ্গা সরকারি কলেজের সামনে মুক্তমঞ্চে পুরস্কার বিতরণী ও সমাপনী অনুষ্ঠান।
বিশিষ্টজনরা বলছেন, স্বাধীন বাংলাদেশে দীর্ঘসময় যে বৈষম্য ছিলো তা নিরসনে কাজ করবে গণ অভ্যুত্থান পরবর্তী সরকারগুলো। অন্তর্বর্তী সরকারের হাত ধরে শুরু হওয়া সংস্কারের কার্যক্রম দেশের গণতন্ত্রকে দেবে নতুন মাত্রা। নতুন বছর ১৪৩২-এ স্পষ্ট হবে অনেক কিছুই। প্রত্যাশা আছে এবছরই স্বাধীন পরিবেশে মুক্তভাবে ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে পারবে দেশবাসী। ঐকমত্যের ভিত্তিতে দেশে আসবে সুশাসন। ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে ঘটে যাওয়া রাজনৈতিক পালাবদলের প্রেক্ষাপটে যে জগদ্দল পাথর বিদায় নিয়েছে তেমন পরিবেশে আর ভুগতে হবে না দেশবাসীকে। তাই নতুন বছরকে বাংলাদেশের ভবিষ্যতের জন্য বিশেষ তাৎপর্যময় মনে করা হচ্ছে।
সরকার ঘোষিত কর্মসূচি হিসেবে এবারের পয়লা বৈশাখে অনেক অনুষ্ঠান হবে একেবারেই আনকোরা। আগে কখনো বাংলাদেশে এভাবে নববর্ষ উদ্যাপন হয়নি। যার প্রথম প্রতিফলন দেখা যাবে আনন্দ শোভাযাত্রায়। আগে মঙ্গল শোভাযাত্রা নামে আয়োজন করা হলেও এবার ফিরিয়ে আনা হয়েছে প্রথম শোভাযাত্রার নাম। এবার বিশেষভাবে চাকমা, মারমা, সাঁওতাল ও গারোসহ ২৮টি জাতিগোষ্ঠীর অংশগ্রহণে অন্তর্ভুক্তিমূলক শোভাযাত্রা অনুষ্ঠিত হবে। সকাল ৯টায় চারুকলা অনুষদ থেকে শুরু হবে বর্ষবরণ আনন্দ শোভাযাত্রা। শুধু নীলক্ষেত-পলাশী ফটক দিয়ে জনসাধারণ শোভাযাত্রায় অংশগ্রহণের উদ্দেশ্যে ক্যাম্পাসে প্রবেশ করতে পারবেন। বাকি ফটকগুলো বন্ধ থাকবে। শোভাযাত্রার শেষ অংশ যখন শাহবাগ মোড়ে পৌঁছাবে তখন জনসাধারণ শাহবাগ অংশের প্রবেশ পথ দিয়ে শোভাযাত্রায় অংশগ্রহণ করতে পারবেন। এবার শোভাযাত্রার সামনে কোনো পুলিশ বা সোয়াত সদস্য থাকবে না। তার পরিবর্তে শোভাযাত্রার দুই পাশে থাকবে পুলিশ সদস্যরা। পুলিশের ৮ ঘোড়ার পর শোভাযাত্রায় পর্যায়ক্রমে ২৮টি ভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর ৪৬৪ জন সদস্য, চারুকলা অনুষদ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়, বান্দরবানের কিশোর ব্যান্ডদল, বামবা ব্যান্ডসংগীত শিল্পীর দল, বাউল সাধু, কৃষকদল ও মূলধারা শিল্পীগোষ্ঠী, সাধনা নৃত্য সংগঠন, রংধনু পোশাকশ্রমিক শিল্পী সংগঠন, নারী ফুটবলার, অ্যাক্রোবেটিক শিল্পী, রিকশা র‌্যালি, ঘোড়ার গাড়ির বহর এবং সব শেষে থাকবে সাধারণ মানুষ।
শোভাযাত্রার অনুষঙ্গ হিসেবে বড়, মাঝারি ও ছোট- এই তিন শ্রেণির মোটিফ থাকবে। বড় মোটিফ হিসেবে থাকবে- ফ্যাসিবাদের মুখাকৃতি, কাঠের বাঘ, ইলিশ মাছ, শহীদ মুগ্ধর পানির বোতল, শান্তির পায়রা, পালকি এবং তরমুজের ফালি। মাঝারি মোটিফ হিসেবে থাকবে- সুলতানি ও মুঘল আমলের মুখোশ, রঙিন চরকি, তালপাতার সেপাই, তুহিন পাখি, পাখা, ঘোড়া, লাঙল এবং ১০০ ফুট লোকজ চিত্রাবলির ক্যানভাস। ছোট মোটিফ হিসেবে থাকবে- ফ্যাসিবাদের মুখাকৃতি, মাছের ডোলা, বাঘের মাথা, পলো, মাছের চাই, মাথাল এবং লাঙল।
এদিকে রমনা বটমূলে দিনভর অনুষ্ঠিত হবে পয়লা বৈশাখ উদ্যাপন ও নববর্ষবরণ সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। সকাল সোয়া ৬টা থেকে শুরু হবে মূল পরিবেশনা। এতে অংশগ্রহণ করবেন নারী-পুরুষের সম্মিলিত প্রায় দেড় শত শিল্পী। থাকবে বৈশাখী গান ও কবিতা। মোট ২৪টি পরিবেশনার মধ্যে ৯টি সম্মিলিত গান, ১২টি একক গান ও কবিতা থাকবে তিনটি। এবারের নববর্ষের মূল কথন পাঠ করবেন ছায়ানটের নির্বাহী সভাপতি সারওয়ার আলী।
অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস দেশবাসীকে নিজ নিজ উপায়ে, নিজেদের রীতি অনুযায়ী পয়লা বৈশাখ উদ্যাপনের আহ্বান জানিয়েছেন। গতকাল আন্তর্জাতিক বৌদ্ধবিহারে সম্প্রীতি ভবনের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন অনুষ্ঠানে তিনি বলেন, ‘পয়লা বৈশাখ আমাদের এই সম্প্রীতির অন্যতম প্রতীক। নানা মত-ধর্ম-রীতিনীতির মধ্যেও আমরা সবাই এক পরিবারের সদস্য। এ দেশের হিন্দু, মুসলমান, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান, পাহাড় ও সমতলের বিভিন্ন সম্প্রদায় ও জনগোষ্ঠী- সব মিলিয়ে এ দেশের মানুষের বিচিত্র ভাষা-সংস্কৃতি-ঐতিহ্য।’
বাংলা নববর্ষ উপলক্ষে দেশ-বিদেশে বসবাসরত সব বাংলাদেশিকে আন্তরিক অভিনন্দন ও শুভেচ্ছা জানিয়েছেন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান। গতকাল জাতির উদ্দেশে দেয়া এক বাণীতে তিনি বলেন, ‘নববর্ষের প্রথম দিনে আমি সবার কল্যাণ ও শান্তি কামনা করছি। বৈশাখের বহ্নিতাপে সমাজ থেকে মুছে যাক অসত্য, অন্যায়, অনাচার ও অশান্তি। চারিদিকে প্রবাহিত হোক শান্তির সুবাতাস, সুশীলা নদী, সমস্ত জগৎ হোক অমৃতময়।’