গাংনী প্রতিনিধি: দাম্পত্য জীবনে তিক্ত অভিজ্ঞতা ছিলো গাংনীর কুঞ্জনগর হুদাপাড়া গ্রামের বিদ্যুত হোসেন এবং পাশর্^বর্তী কুমারীডাঙ্গা গ্রামের ছাবিনা খাতুনের। এ কারণে বিয়ে না করেই বাকি জীবন কাটিয়ে দেয়ার সিদ্ধান্ত ছিলো দু’জনের। কিন্তু পারিবারিক ও সামাজিক রীতি তাদের তাড়া করছিলো। দুজনের সাথে পূর্ব পরিচয় কিংবা সম্পর্ক না থাকলেও তাদের তিক্ত অভিজ্ঞতার বিষয়টি অভিন্ন। পূর্বের দাম্পত্য জীবনের মর্মান্তিক অভিজ্ঞতার দুই গ্রামের এ দুজনকে বিয়ে দেয়া হয় পারিবারিকভাবে। কিন্তু বিয়ের এক মাসের মাথায় লাশ হলো দুজনই। স্ত্রী ছাবিনা খাতুনের (৩০) মাথায় আঘাত করে হত্যা করার পর গলায় ফাঁস দিয়ে আত্মহত্যা করলেন স্বামী বিদ্যুত। গতকাল বুধবার সকালে স্বামীর বাড়ির শয়নকক্ষ থেকে সাবিনার মরদেহ উদ্ধার করা হয়। পরে দুপুরের দিকে বাড়ির পাশর্^বর্তী বাঁশ বাগানে ঝুলন্ত অবস্থায় বিদ্যুতের মরদেহ উদ্ধার করা হয়। মর্মান্তিক এ ঘটনায় শোকের ছায়া বিরাজ করছে দুই গ্রামে। নিহত ছাবিনা খাতুন কুমারীডাঙ্গা গ্রামের আব্দুস সাত্তারের মেয়ে। তার স্বামী বিদ্যুত হুদাপাড়া গ্রামের মৃত ওলি আহম্মেদের ছেলে।
স্থানীয় ও ছাবিনার পিতার পরিবার সূত্রে জানা গেছে, এক মাস আগে কুমারীডাঙ্গা গ্রামের আব্দুস সাত্তারের মেয়ে ছাবিনা খাতুনের সাথে কুঞ্জনগর গ্রামের কৃষক বিদ্যুত হোসেনের বিয়ে হয়। এটি ছাবিনার দ্বিতীয় আর বিদ্যুতের তৃতীয় বিয়ে। এ বিয়ের পর থেকে ছাবিনা বিদ্যুতের মাঝে কলহ চলছিলো। মঙ্গলবার গভীর রাতে বাড়ির লোকজন ঘুমিয়ে পড়েন। এ সময় আবারও দু’জনের মাঝে কলহ শুরু হয়। এক পর্যায়ে পাথর দিয়ে উপর্যুপরি মাথায় আঘাত করে ছাবিনাকে হত্যা করে স্বামী বিদ্যুত। সকাল ৭টার দিকে পাড়া প্রতিবেশীরা ছাবিনার মরদেহ বিদ্যুতের বাড়ির শয়নকক্ষের খাটের ওপর পড়ে থাকতে দেখে। খবর পেয়ে এলাকার হাজারো উৎসুক মানুষের পাশাপাশি ঘটনাস্থলে পৌঁছায় পুলিশ। মাথায় আঘাতের কারণে ছাবিনার মৃত্যু হয়েছে বিষয়টি প্রাথমিক নিশ্চিত করে পুলিশ। মরদেহ উদ্ধার করে ময়নাতদন্তের জন্য মেহেরপুর জেনারেল হাসপাতাল মর্গে প্রেরণের প্রস্তুতি নেয় পুলিশ। স্বামী বিদ্যুত তাকে হত্যা করেছে মর্মে বিষয়টি পরিস্কার হলে ছাবিনার পরিবারের পক্ষ থেকে হত্যা মামলার প্রস্তুতিও শুরু হয়। পুলিশের পক্ষ থেকে সম্ভাব্য সব জায়গায় সন্ধান শুরু হয় বিদ্যুতের। পাষ- স্বামীর হাতে স্ত্রী খুন; এমন প্রতিক্রিয়ায় বিদ্যুতের প্রতি ঘৃণা জ্ঞাপন করে অনেকে। এদিকে দুপুরের দিকে বিদ্যুতের বাড়ির পাশে বাঁশ বাগানে বিদ্যুতের ঝুলন্ত মরদেহ দেখতে পান স্থানীয়রা। স্থানীয়রা জানান, পরনের লুঙ্গি খুলে গলায় ফাঁস দিয়ে বাঁশের সাথে ঝুলে ছিলো বিদ্যুত। স্থানীয়রা একটি গামছা দিয়ে বিদ্যুতের গোপনাঙ্গ ঢেকে দেয়। আবারও ঘটনাস্থলে আসে পুলিশ। মরদেহের সুরতহাল প্রতিবেদন ও ফাঁস দেয়ার স্থান বিবেচনায় আত্মহত্যা হিসেবে চিহ্নিত করে পুলিশ। এর মধ্য দিয়ে স্ত্রীকে হত্যা করে বিদ্যুত আত্মহত্যা করেছে মর্মে স্পষ্ট হয় পুলিশ ও পরিবারের কাছে। পুলিশের পক্ষ থেকে বিদ্যুতের মরদেহ ময়নাতদন্তের জন্য মর্গে প্রেরণ করে। মেহেরপুর জেনারেল হাসপাতালে ময়নাতদন্ত শেষে বিকেলে তাদের স্ব স্ব পরিবারের কাছে মরদেহ হস্তান্তর করে পুলিশ। নিহত স্বামী-স্ত্রীর পারিবারিক সূত্রে জানা গেছে, ১০/১২ বছর আগে ছাবিনার বিয়ে হয়। তার স্বামী ঘরজামাই হিসেবে তার পিতার বাড়ি কুমারীডাঙ্গা গ্রামেই বসবাস করতেন। বছর দশেক আগে ছাবিনার পিতার বাড়িতেই বিদ্যুতস্পৃষ্টে স্বামীর মৃত্যু হয়। তাদের কোনো সন্তান ছিলো না। কিন্তু স্বামীর প্রতি ভালবাসার টানে দ্বিতীয় বিয়ে করেননি ছাবিনা। পরিবারের পক্ষ থেকে বারবার চাপ দিলেও সে বিয়ে না করার বিষয়ে অনড় ছিলো। কিন্তু পরিবার ও সামাজিক চাপে সে অসহায় হয়ে পড়ে। শেষ পর্যন্ত মাসখানেক আগে পারিবারিকভাবে দেখাশোনার পর বিদ্যুতের সাথে দ্বিতীয় বিয়ে করেন ছাবিনা। এদিকে বিদ্যুতের পরিবারিক সূত্রে জানা গেছে, ছাবিনার সাথে বিয়ের আগেও বিদ্যুত আরও দুই বিয়ে করেছিলেন। নানা সমস্যায় তার সংসার দীর্ঘস্থায়ী হয়নি। পিতার একমাত্র ছেলে হিসেবে সংসার করার চাপ ছিলো পরিবার থেকে। বৃদ্ধ মায়ের পক্ষে সংসার সামলানো সম্ভব ছিলো না। তার ৫ বোন বিয়ে করে স্বামীর সংসারে আছেন। ফলে মাকে নিয়েই ছিলো বিদ্যুতের সংসার। শেষ পর্যন্ত আবারও বিয়ে করার সিদ্ধান্ত হলে ঘটকের মাধ্যমে পাত্রী হিসেবে ছাবিনার সন্ধান পায় বিদ্যুত। মাসখানেক আগে তাদের বিয়ে হলেও দাম্পত্যে কলহ লেগেই ছিলো। গত এক সপ্তাহ ছাবিনা তার পিতার বাড়িতে থেকে মঙ্গলবার বিকেলে ভাইকে সঙ্গে নিয়ে স্বামীর বাড়িতে যায়। এ সময় বিদ্যুতের সঙ্গে ছাবিনা ও তার ভাইয়ের ঝগড়া হয়। এক পর্যায়ে ছাবিনার ভাইকে মারধর করে তাড়িয়ে দেয় বিদ্যুত। ভাই বাড়িতে ফিরে গেলেও ছাবিনা ও বিদ্যুতের মাঝে কলহ চলছিলো। এই কলহের জের ধরে গভীর রাতে স্ত্রীকে হত্যা করে বিদ্যুত। মরিচ গুড়ো করার পাথর (নোড়া) দিয়ে মাথায় উপর্যুপরী আঘাত করে স্ত্রীকে হত্যা করে। পরে বাড়ির পাশের বাঁশবাগানে নিয়ে লুঙ্গি দিয়ে গলায় ফাঁস দেয়। গাংনী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আব্দুর রাজ্জাক জানান, স্ত্রীকে হত্যা করে বিদ্যুত আত্মহত্যা করেছে বলে প্রাথকিভাবে ধারণা করা হচ্ছে। ছাবিনার পরিবারের পক্ষ থেকে হত্যা মামলা করার প্রক্রিয়াধীন। অপরদিকে বিদ্যুতের মৃত্যুর বিষয়ে অপমৃত্যু (ইউডি) মামলা করা হয়েছে। তবে এ হত্যাকা-ের বিষয়ে তদন্ত শেষ হলেই পূর্ণাঙ্গ বিষয়টি জানতে পারবে পুলিশ।