বই উৎসবের এপিঠ-ওপিঠ : উচ্ছ্বসিত শিক্ষার্থীরা উদ্বিগ্ন অভিভাবক

নতুন শিক্ষাক্রমে বদলে যাওয়া শিক্ষা পদ্ধতি নিয়েই তাদের এ উৎকণ্ঠা
স্টাফ রিপোর্টার: নতুন বই, নতুন শ্রেণি, নতুন ক্লাসরুম এ তিনে মিলে বছরের প্রথম দিন আনন্দ-উৎসবে কাটালো পৌনে চার কোটি শিক্ষার্থী। খালি হাতে স্কুলে এসে নতুন বই নিয়ে বাসায় ফিরে দারুণ উচ্ছ্বসিত তারা। শুরু হলো নতুন শিক্ষাবর্ষ। তবে বই উৎসবের দিনে এমন দৃশ্যের বিপরীত চিত্রও দেখা গেছে। সন্তান নতুন বই হাতে যখন খুশিতে আত্মহারা, অভিভাবকের কপালে তখন চিন্তার ভাঁজ। নতুন শিক্ষাক্রমে বদলে যাওয়া শিক্ষা পদ্ধতি নিয়েই তাদের এ উৎকণ্ঠা। স্কুলে আসা অভিভাবকদের গল্প-আড্ডায়ও শোনা গেলো সেই উদ্বেগের সুর। এবার প্রাথমিকের শিক্ষার্থীদের নিয়ে মূল বই উৎসবের আয়োজন করা হয় সারাদেশেই। একটি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে মায়ের সঙ্গে বই নিতে এসেছে সেজুতি শিউলি। দ্বিতীয় থেকে তৃতীয় শ্রেণিতে উঠলো সে। সেজুতি বলে, ‘বই নিতে আসার জন্য আমি খুব ভোরে ঘুম থেকে উঠেছি। মায়ের সঙ্গে এসেছি, নতুন সব বই পেয়েছি। বাসায় গিয়ে সবার আগে বাংলা বইয়ের গল্প-ছড়াগুলো পড়বো।’
ছোট্ট সেজুতির কণ্ঠে যখন উচ্ছ্বাস, তখন তার মায়ের মুখে শোনা গেলো ভিন্ন কথা। মা শামসুন নাহার বলেন, ‘এবার তো সব নতুন পড়া। কী সব নতুন নিয়ম নাকি করেছে। সবাই বলছে এ নিয়মে পড়াশোনায় খরচ বেশি। ওর বাবা আর আমি খুব টেনশনে। আমাদের তো এত খরচ দিয়ে পড়ানোর মতো অবস্থা নেই।’ দ্বিতীয় শ্রেণির নাবিল হোসেন নতুন বই পেয়েই মায়ের ব্যাগে ঢুকিয়ে রেখেছে। খুশিতে আত্মহারা এ খুদে শিক্ষার্থীর ভাষ্য, ‘বাইরে রাখলে বই ময়লা হয়ে যাবে। ওরা (সহপাঠীরা) বাইরে রাখছে, ওদের বই আগে পুরোনো হবে।’ সন্তানের কথায় বেশ উচ্চস্বরে হেসে ওঠেন নাবিলের স্নাতক ডিগ্রিধারী মা মারজিয়া সিন্থি। পরক্ষণেই তিনি বলেন, ‘ও (নাবিল) পড়াশোনায় খুবই ভালো। রোল সবসময় পাঁচের মধ্যে থাকে। কিন্তু এবার তো নতুন কারিকুলাম। এ কারিকুলাম নিয়ে ভয়ে আছি। আমরাই বুঝছি না, ওরা কী বুঝবে? এটা (কারিকুলাম) বোঝার জন্য তো আমাদেরই প্রশিক্ষণ নিতে হবে দেখছি।’
জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের (এনসিটিবি) তথ্যমতে, এবার বই উৎসবে প্রথম থেকে নবম শ্রেণির তিন কোটি ৮১ লাখ ২৭ হাজার ৬৩০ জন শিক্ষার্থী নতুন বই পেয়েছে। ৯টি শ্রেণির মধ্যে এবার সাত শ্রেণিতে নতুন শিক্ষাক্রমে লেখা বই। সেগুলো হলো প্রথম, দ্বিতীয়, তৃতীয়, ষষ্ঠ, সপ্তম, অষ্টম, নবম। এসব বইয়ের পা-ুলিপি একেবারে নতুন করে লেখা। শুধু চতুর্থ ও পঞ্চমের শিক্ষার্থীরা আগের বই পড়বে। ২০২৩ সালে প্রথম, ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণিতে নতুন শিক্ষাক্রমে পড়ানো হয়। এবার প্রাথমিকের দ্বিতীয় ও তৃতীয় এবং মাধ্যমিকের অষ্টম-নবমে এ শিক্ষাক্রম পড়ানো হবে। দুই শ্রেণিতে নতুন শিক্ষাক্রম চালুর পর থেকেই এ নিয়ে নানা সমালোচনা শুরু হয়। আন্দোলনেও নামেন অভিভাবকদের একটি অংশ। মামলা ও সরকারের চাপেই কার্যত তাদের আন্দোলন গুটিয়ে যায়। তবে ভেতরে ভেতরে এখনো নতুন শিক্ষাক্রম নিয়ে ক্ষুব্ধ অভিভাবকরা।
এদিকে, বই উৎসবেও শিক্ষার্থী-অভিভাবকদের নতুন শিক্ষাক্রমের ইতিবাচক বিভিন্ন দিক তুলে ধরেছেন শিক্ষা প্রশাসনের কর্মকর্তারা। প্রাথমিকের বই উৎসব অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথির বক্তব্যে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা সচিব ফরিদ আহাম্মদ বলেন, ‘পুরোনো ধারার শিক্ষার খোলস পাল্টে নতুন শিক্ষার বীজ বপনের কাজে হাত দিয়েছে সরকার। নতুন এ শিক্ষাক্রম শিক্ষার্থীর কাঁধ থেকে মুখস্থবিদ্যার বোঝা ঝেড়ে ফেলবে। তাদের মধ্যে অনুসন্ধান, গবেষণা ও ভাবনার শক্তি জোগাবে। শিক্ষার্থী নিজেই নানা চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করবে এবং তা মোকাবিলা করে অভীষ্ট গন্তব্য পৌঁছুবে। এ নিয়ে কেউ উদ্বিগ্ন হবেন না।’ রোববার বই বিতরণ কার্যক্রম উদ্বোধন অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, ‘সরকার দেশে আন্তর্জাতিক মানের শিক্ষাব্যবস্থা চালুর উদ্যোগ নিয়েছে। বিশ্বের নামীদামি বিশ্ববিদ্যালয়, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের কে কোন কারিকুলাম পড়াচ্ছে, তা গবেষণা করে আমরাও তেমন কারিকুলামে শিক্ষার্থীদের পড়াতে চাই।’ শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনি সভাপতির বক্তব্যে বলেন, ‘নতুন শিক্ষাক্রমে শিক্ষার্থীদের ওপর পরীক্ষার চাপ কমানোর উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। তাদের মধ্যে যাতে উদ্ভাবনী শক্তি বাড়ে, সেদিকে নজর রেখে শিক্ষাক্রম সাজিয়েছি আমরা।’
তবে সরকার ও শিক্ষা প্রশাসনের বক্তব্যে সন্তুষ্ট নন অভিভাবকরা। মেহজাবিন নাফিসা পঞ্চম থেকে এবার ষষ্ঠ শ্রেণিতে উঠেছে সে। প্রথমবারের মতো নতুন শিক্ষাক্রমে পড়বে মেহজাবিন। এ নিয়ে চিন্তার শেষ নেই মা রুকাইয়া সুলতানার। তিনি বলেন, ‘আগের বছর যারা ষষ্ঠ শ্রেণিতে নতুন কারিকুলাম পড়েছে, তারা কেউ পজিটিভ বলেনি। চিন্তা না করে করবো কী বলেন? এককথায় বলতে বললে বলবো—আমরা সন্তানের পড়াশোনা নিয়ে ভয় পাচ্ছি।’ শিক্ষার্থীরাই অভিভাবকদের ভয় দূর করবে বলে মনে করেন নতুন শিক্ষাক্রম প্রণেতাদের অন্যতম অধ্যাপক ড. মো. মশিউজ্জামান। জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের (এনসিটিবি) শিক্ষাক্রম ইউনিটের এ সদস্য বলেন, ‘বিদায়ী বছরে ষষ্ঠ-সপ্তমে প্রথম আমরা নতুন শিক্ষাক্রম পড়িয়েছি। এবার মাধ্যমিকের সব ক্লাসে নতুন শিক্ষাক্রম। অভিভাবকদের একটু চিন্তায় থাকা স্বাভাবিক। এটিকে আমি অভিভাবকদের সচেতনতা মনে করি।’ তিনি আরও বলেন, ‘তারা (অভিভাবকরা) যত উদ্বিগ্ন হবেন, তত জানতে চাইবেন। আমরাও তাদের বলতে চাই, বোঝাতে চাই। অভিভাবক উৎসুক হলে আমাদের কাজ, শিক্ষকদের কাজ সহজ হয়ে যাবে। অভিভাবকদের প্রতি একটাই অনুরোধ থাকবে, গুজব-অপপ্রচারে কেউ কান দেবেন না। কিছু জানতে হলে শ্রেণি শিক্ষক বা আমাদের কাছে প্রশ্ন করুন। নিশ্চয়ই আমরা বুঝিয়ে দেবো।’ প্রাক-প্রাথমিক থেকে সপ্তম শ্রেণি পর্যন্ত সব শিক্ষার্থী শতভাগ বই পেয়েছে। অষ্টম ও নবমের ২০-২৫ শতাংশ বই এখনো ছাপা হয়নি। সেগুলো চলতি মাসেই ছাপা শেষে শিক্ষার্থীদের হাতে পৌঁছে দেয়া হবে বলে জানিয়েছে পাঠ্যপুস্তক বোর্ড। বোর্ডের তথ্যমতে, ২০২৪ শিক্ষাবর্ষে শিক্ষার্থী সংখ্যা তিন কোটি ৮১ লাখ ২৭ হাজার ৬৩০ জন। তাদের জন্য বই ছাপা হয়েছে ৩০ কোটি ৭০ লাখ ৮৩ হাজার ৫১৭টি। এর মধ্যে ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর (পাঁচটি ভাষায় রচিত) শিশুদের জন্য এবার মোট দুই লাখ পাঁচ হাজার ৩১ কপি বই ছাপা হয়েছে। অন্য বইয়ের মধ্যে রয়েছে পাঁচ হাজার ৭৫২ কপি ‘ব্রেইল’ বই। তাছাড়া শিক্ষকদের ৪০ লাখ ৯৬ হাজার ৬২৮টি ‘শিক্ষক সহায়িকা’ দেয়া হবে।