প্রতিদিন ১০ হাজার টার্গেট করা হলেও তা এখনো বাস্তবায়ন হচ্ছে না

ল্যাব ও লোকবল সঙ্কটে ব্যাহত করোনার নমুনা পরীক্ষা
স্টাফ রিপোর্টার: দেশে করোনা ভাইরাসের সংক্রমণ বৃদ্ধির মুখে ১০ হাজার নমুনা পরীক্ষার টার্গেট করা হলেও তা এখনো বাস্তবায়ন করা যায়নি। কর্মকর্তারা বলেন, নমুনা সংগ্রহ থেকে শুরু করে লোকবলের সমস্যার কারণে পরীক্ষার সংখ্যা বাড়ানোর ক্ষেত্রে বিলম্ব হচ্ছে। বিশেষজ্ঞদের অনেকে বলেন, বাংলাদেশে এ পরীক্ষা শুরুর পর দুই মাসেও এর সংখ্যা বাড়াতে না পারলে সংক্রমণের সঠিক পরিস্থিতি বোঝা যাবে না। করোনা ভাইরাসের পরীক্ষা শুরু হওয়ার পর দুই মাসে একটি ল্যাবের জায়গায় এখন ৩৭টি ল্যাবে পরীক্ষা বাড়ানোর বিষয়কে সরকারের পক্ষ থেকে বড় অর্জন হিসেবে তুলে ধরা হচ্ছে। কিন্তু এর একেকটি ল্যাবের ওপর নির্ভর করছে কয়েকটি জেলা-উপজেলার বিশাল সংখ্যক মানুষের পরীক্ষা। দেশের উত্তরে বগুড়ার সিভিল সার্জন গাউসুল আজম বলেছেন, বগুড়ায় মাত্র একটি ল্যাবে নমুনা আসছে তিনটি জেলা থেকে। ফলে পরীক্ষায় জট লেগে যাচ্ছে বলে তিনি উল্লেখ করেছেন। তিনি বলেন, ‘আমাদের এখানে শহিদ জিয়াউর রহমান মেডিকেল কলেজ ল্যাবে দুই শিফটে কিন্তু কাজ হয়। এই দুই শিফটে ১৮৮টি নমুনা পরীক্ষার সক্ষমতা আছে। এ সংখ্যাই কিন্তু পরীক্ষা হচ্ছে। এই ল্যাবে আর অতিরিক্ত করা সম্ভব নয়। এটা থেকে বোঝা যাচ্ছে, এখানে আরেকটা ল্যাব করা ছাড়া পরীক্ষা আর বাড়ানো যাবে না।’ তিনি আরও বলেন, ‘এই ল্যাবে বগুড়ার ১২টা উপজেলা এবং সিরাজগঞ্জ ও জয়পুর জেলা থেকে নমুনা আসছে পরীক্ষার জন্য। ফলে দুটি শিফট চালানোর পরও ব্যাকলগ থেকেই যাচ্ছে।’ দেশের বিভিন্ন জেলা থেকেই ল্যাবের সমস্যা এবং পরীক্ষার বিলম্বের একই রকম চিত্র পাওয়া যায়। আরেকটি জেলা থেকে একজন নারী নাম-পরিচয় প্রকাশ না করার শর্তে বলেছেন, করোনা ভাইরাসের উপসর্গ থাকায় এক সপ্তাহ আগে তিনি নমুনা দিয়েছেন। কিন্তু পরীক্ষার রিপোর্টের জন্য বিভিন্ন জায়গায় ঘুরেও তা পাচ্ছেন না। তিনি এ পরিস্থিতিতে কী করবেন সেটাও বুঝতে পারছেন না। তিনি জানান, ‘আমি বেশকিছু দিন আগে টেস্ট করিয়েছি। কিন্তু রিপোর্ট পাচ্ছি না। আমাকে ঘোরানো হচ্ছে। এখানে-ওখানে-সেখানে বিভিন্ন জায়গায় যেতে বলা হচ্ছে, আমি যাচ্ছি। কিন্তু সাতদিন হয়ে গেলো এখনো রিপোর্ট পাইনি।’ এ যাবত একদিনে সর্বোচ্চ ৭২৮০ জনের নমুনা পরীক্ষা করা হয়েছে। আর দুই মাসে (মঙ্গলবার পর্যন্ত) মোট ১ লাখ ৩৬ হাজার ৬৩৮টির মতো নমুনা পরীক্ষা করা হয়েছে। বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, বাংলাদেশের জনসংখ্যার অনুপাতে এই পরীক্ষার সংখ্যা নগণ্য। বিশেষজ্ঞদের অনেকে বলেন, যেটুকু পরীক্ষা হচ্ছে, তাতেই সংক্রমণ বেড়ে চলেছে। সেখানে পরীক্ষার সংখ্যা না বাড়িয়ে সংক্রমণের হার একটা পর্যায় রাখার কোনো কৌশল আছে কি না, এমন সন্দেহও করছেন বিশেষজ্ঞদের অনেকে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইরোলজি বিভাগের সাবেক চেয়ারম্যান অধ্যাপক নজরুল ইসলাম মনে করেন, পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের জন্যই পরীক্ষা আরও বাড়ানো প্রয়োজন। সরকার এমন বক্তব্য নাকচ করেছে। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব মো. হাবিবুর রহমান খান বলেন, ‘আমরা আরটিপিসিআর মেশিনের মাধ্যমে ল্যাবে সঠিক টেস্ট করার চেষ্টা করছি। এ কারণে খুব দ্রুত বাড়ানোটা কঠিন। তারপরও বলব, একটা ল্যাব থেকে ৩৭টা ল্যাবে পরীক্ষা উন্নীত করা গেছে। এখন ছয়-সাত হাজার নমুনা পরীক্ষা করা যাচ্ছে। আমাদের চেষ্টা আছে, পরীক্ষার সংখ্যা আপাতত ১০ হাজার পর্যন্ত উন্নীত করতে পারি কি না এবং এটা করতে পারলে আরও বাড়ানোর চেষ্টা সরকার করবে।’ স্বাস্থ্য অধিদফতরের রোগ নিয়ন্ত্রণ বিভাগের সাবেক একজন পরিচালক ডা. বেনজীর আহমেদ মনে করেন, নমুনা সংগ্রহ থেকে শুরু করে ল্যাবে পরীক্ষা করা পর্যন্ত লোকবলের অভাব রয়েছে। ল্যাবের সংখ্যা এখনো অনেক কম। এসব ঘাটতিকেই পরীক্ষা বাড়ানোর ক্ষেত্রে বড় সমস্যা বা চ্যালেঞ্জ হিসেবে তিনি দেখেন।
বিশেষজ্ঞরা বলেন, সংক্রমণ বৃদ্ধির এ সময়ে পরীক্ষা এখনকার তুলনায় কয়েক গুণ বাড়ানো না হলে আক্রান্ত বা পরিস্থিতির সঠিক চিত্র পাওয়া যাবে না। সরকার বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থ্যা ব্র্যাকের সঙ্গে সারাদেশে ৬০০ বুথ তৈরি করে নমুনা সংগ্রহ আরও বাড়ানোর কথা বলছে। ব্র্যাক ইতোমধ্যেই ঢাকায় বিভিন্ন হাসপাতাল এবং কমিউনিটি সেন্টারে বুথ তৈরি করার পর ২০টিতে কার্যক্রম শুরু করেছে। নগরীতে মোট ৪৯টি বুথ বসানো হবে। ঢাকার বাইরে বুথ তৈরির কাজ অল্প সময়ের মধ্যে শুরু করার কথা বলা হচ্ছে।
কিন্তু বুথ হলেই কি সমাধান হবে- এ প্রশ্নে ব্র্যাকের সংশ্লিষ্ট বিভাগের সহযোগী পরিচালক মোর্শেদা চৌধুরী বলেন, ‘বুথ বানানো কোনো ব্যাপার নয়। বুথ আমরা তৈরি করেছি। কিন্তু সমস্যাটা হচ্ছে, লকডাউনের মধ্যে দক্ষ লোক হায়ার করা এবং তাদের প্রশিক্ষণ দেয়া। এছাড়া নমুনা সংগ্রহের লজেস্টিক সব আমরা পাচ্ছি সরকারের কাছ থেকে। এসবের সরবরাহের ওপর সবকিছু নির্ভর করবে।’
স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব মো. হাবিবুর রহমান খানের বক্তব্য হচ্ছে, ‘এখন যদি কোভিড-১৯ এর বিষয় না থাকত তাহলে এত তিতোভাবে লজেস্টিকসের ঘাটতি কিন্তু বোঝা যেত না। আগে থেকেই এ ঘাটতি ছিলো। টেকনোলজিস্টের কয়েকশ পদ শূন্য ছিলো। আমরা এখন আউট সোর্সিংয়ের মাধ্যমে অন্তত কয়েকশ লোক নেয়ার চেষ্টা করছি।’ তিনি আরও জানিয়েছেন, এখন সারাদেশে ১১শ’ টেকনিশিয়ান রয়েছেন।

Comments (0)
Add Comment