ইসলাম রকিব: ক্রিকেট দিয়ে খেলোয়াড়ী জীবনের শুরু হলেও তিনি এখন প্রমিলা তারকা ফুটবলার। হ্যাঁ লম্বা চুলে হাওয়ায় দোল খেলানো ব্লাক পার্ল বা কালো মানিকের মতো চেহারা সেই মেয়েটির কথাই বলছি। যার নাম বিদিশা রানী বেদ। ২০১৬ সালে চুয়াডাঙ্গা নাইটিঙ্গেল ক্রিকেট একাডেমির মাধ্যমে যার সংঘবদ্ধ খেলায় হাতেখড়ি হয়েছিলো। অল্প ক’দিনেই বোলিং, ব্যাটিং ও ফিল্ডিংয়ে পারদর্শিতা অর্জন করে নিজেকে পুরোদস্তুর ক্রিকেটার বলে প্রমাণ করে ফেলেন বিদিশা। ২০১৭ সালে চুয়াডাঙ্গা নাইটিঙ্গেল ক্রিকেট একাডেমির পরিচালক কাম কোচ ইসলাম রকিবের হাত ধরে ঢাকার বিকেএসপিতে মাসব্যাপী ক্রিকেট প্রশিক্ষণের সুযোগ লাভ করেন। প্রশিক্ষণ শেষে পড়ালেখার চাপ সামলাতে বেশ কিছুদিন সব ধরণের খেলার বাইরে চলে যান বিদিশা। মাস ছয়েক পর খেয়ালী মনের স্বপ্ন ডানায় ভর করে ফুটবল খেলতে বাসনা জাগে তার। যদিও প্রাইমারি জীবনে বঙ্গমাতা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় গোল্ডকাপে বেশ কয়েকবার জেলা ও উপজেলা পর্য়ায়ে শ্রেষ্ঠত্বের মালা তার গলাই উঠেছিলো। ফুটবলের সেই পুরানো ভালোলাগা নতুন করে পেয়ে বসে বিদিশার নেশায়। তাইতো ২০কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়ে আলমডাঙ্গা থেকে প্রতিদিন চুয়াডাঙ্গা পুরাতন স্টেডিয়ামে মহাতাব বিশ্বাস ফুটবল একাডেমিতে অনুশীলন করতে চলে আসেন বিদিশা। সেখানে ফুটবল গুরু মিলন বিশ্বাসের হাত ধরে শুরু করে নতুন উদ্যোমে ফুটবল প্রশিক্ষণ। এ ফুটবল একাডেমি থেকে জেলা, বিভাগ ও জাতীয় পর্যায়ের বিভিন্ন প্রমিলা ফুটবল টুর্ণামেন্টে অংশগ্রহণ করে নিজেকে বিদিশা রাণী থেকে ফুটবলের রাণীতে পরিণত করতে থাকেন তিনি। জীবনের সেরা সুযোগটি চলে আসে বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব অনুর্ধ-১৭ জাতীয় ফুটবল টুর্ণামেন্টে খেলতে গিয়ে। এ টুর্নামেন্টে চুয়াডাঙ্গা আন্তঃ উপজেলা, জেলা ও খুলনা বিভাগের খেলায় নিজেকে উজ্বলভাবে মেলে ধরেন বিদিশা। খুলনা বিভাগের হয়ে জাতীয় পর্যায়ে খেলার সুযোগ লাভ করেন বিদিশা। এখানে দেশি ও বিদেশি ফুটবল বিশেজ্ঞদের নজর কাড়েন বিদিশা। তাদের সিলেকশনে ঢাকার বিকেএসপিতে সারা বাংলাদেশ থেকে ২৫জন প্রমিলা ফুটবলারকে ডাকা হয় মাসব্যাপী উন্নত প্রশিক্ষণের জন্য। সেখানে নিবীড় প্রশিক্ষণ শেষে ১৫জন প্রমিলা ফুটবলারকে বাছাই করা হয়। এ ১৫ জনের মধ্য থেকে আবার চুলচেরা বিশ্লেষণ করে বেস্ট ইলেভেন (সেরা-১১) বাছাই করা হয়। যারা চলতি বছরের জুলাই মাসে ২মাসব্যাপী ইউরোপের দেশ পর্তুগালে উন্নত প্রশিক্ষণের সুযোগ লাভ করবে। সেই বেস্ট ইলেভেনে চুয়াডাঙ্গার মেয়ে বিদিশা রাণী বেদের অবস্থান দাঁড়ায় ৮ নস্বরে। অথাৎ ওয়ান ইলেভেনের হয়ে পর্তুগালে উন্নত প্রশিক্ষণের সুযোগ লাভ করে বিদিশা রাণী।
বিষয়টি নান্দনিকভাবে বললে বলতে হয়, সারা বাংলাদেশের শত শত প্রমিলা ফুটবলারদের পেছনে ফেলে ওয়ান ইলেভেন হয়ে পর্তুগালে উন্নত প্রশিক্ষণের সুযোগ পেলেন চুয়াডাঙ্গার মেয়ে প্রমিলা ফুটবলার বিদিশা রাণী। আগামী জুলাই মাসে বাংলাদেশ সরকারের সহায়তায় ও বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশন ও পর্তুগাল গাল ফুটবল অ্যাসোসিয়েশন এবং ফিফার ব্যবস্থাপনায় ২ মাসের উন্নত ফুটবল প্রশিক্ষণের জন্য বিদিশা ইউরোপের দেশ পর্তুগালে যাওয়ার সুবর্ণ সুযোগ লাভ করেছে।
বিদিশা রানী তার বাবা-মায়ের ৫ কন্যা সন্তানের মধ্যে দ্বিতীয়। বাবা আলমডাঙ্গা শহরের স্টেশনপাড়ার রাজ কুমার বেদ ও মা ডলি রানী বেদ গৃহিনী। বাবা আলমডাঙ্গার হারদীর এমএস জোহা ডিগ্রি কলেজে অফিস সহায়ক পদে চাকরি করেন। বিদিশার বাবা রাজকুমার দৈনিক মাথাভাঙ্গাকে বলেন, আমার শত অভাব থাকলেও আমি আমার মেয়েদেরকে খেলাপড়া ও খেলাধুলার অবাধ সুযোগ করে দিয়েছি। ভগবান ওর ও আমার মুখের দিকে চেয়েছেন। আমার মেয়ে ইউরোপে যাচ্ছে ফুটবল খেলতে। এমন সৌভাগ্য ক’জনের হয়। আমি আজ নিজেকে খুব গর্বিত পিতা মনে করছি।
বিদিশার ফুটবল গুরু মিলন বিশ্বাস বলেন, ভাবতে খুব ভালো লাগছে। আমার হাতে গড়া মহাতাব বিশ্বাস ফুটবল একাডেমির একজন খেলোয়াড় এত বড় জায়গায় ফুটবল প্রশিক্ষণের সুযোগ লাভ করেছে। দেশবাসীর নিকট ওর জন্য দোয়া চাচ্ছি।
বিদিশার হাতে খড়ি হয়েছিলো যার হাতে, চুয়াডাঙ্গা নাইটিঙ্গেল ক্রিকেট একাডেমির পরিচালক ইসলাম রকিব বলেন, বিদিশা হিরের টুকরা খেলোয়াড়। ওর মতো খেলোয়াড় যুগে যুগে পৃথিবীতে আসে। ওদের ভালোমতো পরিচর্যা করতে পারলে ওরা দেশ ও জাতীর জন্য সেরাটা উপহার দেবে।
চুয়াডাঙ্গার কিংবদন্তি সাবেক কৃতি ফুটবলার কানাডা প্রবাসী মামুন জোয়ার্দ্দার বলেন, আমি কানাডায় বসে বসে ডিজিটাল প্লাটফর্ম ফেসবুকের মাধ্যমে মাঝে মাঝে বিদিশার খেলা ও অনুশীলনী দেখি। সত্যিই অসাধারণ। ও খেলা ধরে রাখতে পারলে একদিন বাংলাদেশের প্রমিলা ফুটবলে চমক সৃষ্টি করবে।
অনুভুতি ব্যক্ত করতে গিয়ে বিদিশা বলেন, আমার খুব ভালো লাগছে। আমার মতো একজন হতদরিদ্রের মেয়ে আজ ফুটবলের সেরা উপহারটি নিয়ে স্বপ্নের দেশ ইউরোপের পর্তুগালে প্রশিক্ষণের জন্য যাচ্ছি। তবে আমি চাই সেখান থেকে দেশে ফিরে দেশ ও জাতীর জন্য আমার সেরা খেলাটি উপহার দিতে।