স্টাফ রিপোর্টার: নির্বাচন নিয়ে রাজনীতিতে চলছে নানা গুঞ্জন। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম থেকে শুরু করে রাজনীতির মাঠ- সর্বত্রই এখন প্রশ্ন; নির্বাচন শেষ পর্যন্ত হবে তো, হলে কবে হবে? যদিও অন্তর্বর্তীকালীন সরকার বলছে, নির্বাচন হবে আগামী ডিসেম্বর থেকে জুনের মধ্যে। জামায়াতে ইসলামী, জাতীয় নাগরিক পার্টি বা এনসিপি, ইসলামী আন্দোলনসহ বিভিন্ন দল সরকারের অবস্থানকে সমর্থন করছে। তবে ডিসেম্বরে নির্বাচন চায় বিএনপি। ঈদের আগেই বোঝা যাচ্ছিলো যে, ঈদের পর রাজনৈতিক উত্তাপ বাড়তে পারে। কারণ বিএনপি ঘোষণা দিয়ে রেখেছিল, ডিসেম্বরে সংসদ নির্বাচনের দাবিতে প্রয়োজনে রাজপথের কর্মসূচি দেবে তারা। দলটি এখন সে পথেই এগোচ্ছে বলে ইঙ্গিত পাওয়া গেছে। ইতোমধ্যেই দলের নেতারা একাধিক বৈঠক করেছেন। গত সোমবার হয়েছে জাতীয় স্থায়ী কমিটির বৈঠক। এরপর বিএনপি জানিয়েছে, আগামী ১৬ এপ্রিল তারা প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে বৈঠকে বসবেন। যেখানে ডিসেম্বরে নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য ‘রোডম্যাপ দেয়ার আহ্বান’ জানানো হবে। প্রধান উপদেষ্টা জবাবে কী বলেন তার ওপর ভিত্তি করেই বিএনপি ঠিক করবে নির্বাচনের রোডম্যাপের দাবিতে তারা সরকারের ওপর কীভাবে চাপ তৈরি করবে, কর্মসূচি কী হবে। আর যদি ডিসেম্বরকে ঘিরেই নির্বাচনের কথা বলা হয়, তাহলে নির্বাচনের প্রস্তুতিতে যাবে দলটি। কিন্তু বিএনপি যখন ডিসেম্বরে নির্বাচনের জন্য এখনই রোডম্যাপ চাইছে, তখন জামায়াতে ইসলামী এবং ছাত্রদের নতুন দল এনসিপি আবার আগামী বছরের জুন পর্যন্ত সরকারকে সময় দেয়ার পক্ষে রয়েছে। তাদের যুক্তি, এই সময়ের মধ্যেই সরকার যেন ‘প্রয়োজনীয় সংস্কার ও গণহত্যা বিচারের’ কার্যক্রম শুরু করতে পারে। গত ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে শেখ হাসিনা দেশ ছেড়ে পালানোর পর ৮ আগস্ট দায়িত্ব নেয় অন্তর্বর্তী সরকার। সেই সরকারের প্রধান উপদেষ্টা হন অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস। বিএনপি শুরু থেকেই ‘দ্রুততম সময়ের মধ্যে’ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আহ্বান জানিয়ে আসছে। পরে নতুন বছরের শুরুতে বিএনপি নেতারা আগামী জুলাই-আগস্টের মধ্যেও নির্বাচন অনুষ্ঠান সম্ভব, এমন কথা বলে আসছিলেন। তবে দলটি আরেকটু পিছিয়ে ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচনের আহ্বান জানিয়েছে। অন্যদিকে সরকার বলছে সংস্কারের কথা। সংস্কারের জন্য গঠিত বিভিন্ন কমিশনের রিপোর্ট হাতে পাওয়ার পর সরকার জাতীয় ঐকমত্য কমিশন গঠন করে। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ইতোমধ্যেই জানিয়েছেন, বড় ধরনের সংস্কার করতে হলে নির্বাচন আগামী বছরের জুনে হতে পারে। আর ছোট আকারের সংস্কার হলে নির্বাচন হতে পারে ডিসেম্বরে। কিন্তু সংস্কারের জন্য ডিসেম্বরের পরে নির্বাচনের আয়োজনের বিরোধী বিএনপি। ‘মাননীয় প্রধান উপদেষ্টা বড় সংস্কার আর ছোট সংস্কার বলতে কী বোঝান, সেটা তো আমরা বুঝি না! কোনো সংস্কারই ছোট বা বড় নয়। আমরা বলেছিলাম, নির্বাচনমুখী যেসকল সংস্কার সেগুলো শেষ করে নির্বাচন দিয়ে দিন। কিন্তু এখন বড় সংস্কার বলতে উনি কী বোঝাচ্ছেন, সেটা পরিষ্কার করতে হবে। যদি উনি সংবিধান সংস্কারকে বড় সংস্কার মনে করেন তাহলে সেটা আমাদেরকে বলতে হবে। সংবিধান সংস্কার তো জাতীয় সংসদ ছাড়া হবে না।’ বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমদ বলেন, সংস্কারের জন্য সময়ক্ষেপণের কোনো যৌক্তিকতা নেই। ‘দেখেন সংবিধান সংস্কার ছাড়া এর বাইরে এমন আর কোনো সংস্কার প্রস্তাব নেই যেটা জাতীয় ঐকমত্যের ভিত্তিতে গৃহীত হলে এক থেকে দেড় মাসের বেশি সময় লাগবে।’ ‘আমাদের বক্তব্য হচ্ছে, এখানে সংবিধান সংশোধনীর যেসব বিষয়ে জাতীয় একমত্য তৈরি হবে সেসব বিষয় চিহ্নিত করে একটা চার্টার করাই যায়। পরবর্তী নির্বাচিত সংসদ সেটা বাস্তবায়ন করবে। এরজন্য নির্বাচন পেছানোর তো দরকার নেই। এগুলো নিয়ে জাতীয় ঐকমত্য একটা পর্যায়ে প্রতিষ্ঠিত হবে কিন্তু সেজন্য নির্বাচনী রোডম্যাপ ঘোষণা দিতে বাধা কোথায়?’ প্রশ্ন করেন বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমদ।
বিএনপি নির্বাচনের রোডম্যাপ চায়। কিন্তু সরকার রোডম্যাপ ঘোষণা করছে না। বিএনপি এটাকে সন্দেহের চোখে দেখে। যদিও অন্তর্বর্তীকালীন সরকার বলছে, আগামী ডিসেম্বর থেকে জুন এই সাত মাসের মধ্যেই নির্বাচন হবে। সরকার প্রথমে সংস্কারের এজেন্ডা ঠিক করার জন্য অপেক্ষা করেছে। সংস্কার কমিশনগুলোর রিপোর্ট হাতে পাওয়ার পর সেটা নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর মতামত চেয়েছে। এরপরের ধাপ হচ্ছে দলগুলোর সঙ্গে ধারাবাহিক আলোচনা। এই আলোচনা শেষ হলেই বোঝা যাবে সংস্কারের এজেন্ডা কী হবে এবং কবে, কীভাবে বাস্তবায়ন হবে। এই বিষয়ে ঐকমত্য হলেই সরকার নির্বাচনের রোডম্যাপ ঘোষণা করবে।
দেখা যাচ্ছে, জামায়াত, এনসিপির মতো দলগুলো সরকারের এই প্রক্রিয়ায় এবং নির্বাচনের সম্ভাব্য সময়সীমায় আস্থা রাখলেও বিএনপি সাত মাসের এই সম্ভাব্য সময়সীমাকে দেখছে তাদের ভাষায় নির্বাচন নিয়ে এক ধরনের অনিশ্চয়তা হিসেবে। ফলে তারা ডিসেম্বরের পরে যেতে চায় না। কিন্তু নির্বাচনের সম্ভাব্য সময়সীমা দেয়ার পরও বিএনপি কেন সেটাকে সন্দেহ করছে? এমন প্রশ্নের উত্তরে ‘নির্বাচন পেছানোর ষড়যন্ত্রের’ কথা বলছেন বিএনপি নেতারা। জানতে চাইলে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমদ বলেন, ‘যেখানে মানুষ গণতন্ত্রের জন্য, গণতান্ত্রিক অধিকারের জন্য রক্ত দিয়েছে, গণঅভ্যুত্থান করেছে, সেখানে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় উত্তরণের জন্য যদি এত অনিশ্চয়তা থাকে, সেটাকে আমরা স্বাভাবিক নয় বলেই মনে করি।’ ‘আমরা কো-রিলেট করতে চাই যে, কিছু কিছু নতুন রাজনৈতিক দল এবং পুরনো রাজনৈতিক দলের বক্তব্যে নির্বাচন বিলম্বিত করার একটা পাঁয়তারা লক্ষ্য করা যায়। তো সে কারণে সরকারের বক্তব্য এবং তাদের কথা ও কর্মকা- -সবকিছু বিবেচনা করলে দেখা যায় নির্বাচন নিয়ে একটা অনিশ্চিত পরিবেশ সৃষ্টি হচ্ছে। সেটা গণতন্ত্রের জন্য কল্যাণকর নয়। কারণ নির্বাচন যত দেরি হবে, গণতন্ত্র উত্তরণের রাস্তা তত কঠিন হবে।’ সালাহউদ্দিন আহমদ জানাচ্ছেন, নির্বাচন কবে হবে সেটা জানতে তারা প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে সাক্ষাৎ করবেন। সেই সাক্ষাতে কী ফল আসে তার ভিত্তিতেই করণীয় নির্ধারণ করা হবে। এটা স্পষ্ট যে নির্বাচন পেছানোর চেষ্টা কেউ কেউ করছে-বিএনপির ভেতরে এমন সন্দেহ তৈরি হয়েছে। এটা আরও জোরালো হয়েছে, কারণ সাম্প্রতিক সময়ে অনেকেই, বিশেষত সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোতে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের অন্তত পাঁচ বছর ক্ষমতায় থাকার পক্ষে প্রচারণা চালাচ্ছেন। কেউ কেউ প্রধান উপদেষ্টার প্রশংসা করে তাকে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে পাওয়ার আকাঙ্ক্ষার কথাও জানিয়েছেন। এসব প্রেক্ষাপটেই বিএনপি বলছে, ডিসেম্বরের পরে নির্বাচন নেওয়ার চেষ্টা হলে তারা বিরোধিতা করবে, প্রয়োজনে রাজপথে কর্মসূচি পালন করবে। এর বিপরীতে রাজনৈতিক অঙ্গনে যেসব বক্তব্য আসছে, সেগুলো মূলত পাওয়া যাচ্ছে জামায়াতে ইসলামী এবং জুলাই আন্দোলনে অংশ নেয়া ছাত্রদের নেতৃত্বে নবগঠিত দল জাতীয় নাগরিক পার্টি-এনসিপির নেতাদের বক্তব্যে। এসব দল নির্বাচনের আগে সংস্কার এবং আওয়ামী লীগের বিচারের যে দাবি করছে সেটাকে অনেকেই দেখছেন ‘নির্বাচন বিলম্বিত করার চেষ্টা’ হিসেবে। তবে জামায়াতে ইসলামী কিংবা এনসিপি অবশ্য বলছে, তারা নির্বাচন পেছানোর পক্ষে নন। বরং সরকারকে সময় দিতে চান ২০২৬ সালের জুন পর্যন্ত। জানতে চাইলে জামায়াতে ইসলামীর মুখপাত্র ও দলটির প্রচার সম্পাদক মতিউর রহমান আকন্দ বলেন, ‘প্রধান উপদেষ্টা তো বলেই দিয়েছেন জুনের মধ্যে নির্বাচন। তিনি বলেছেন, বেশি সংস্কার চাইলে ইলেকশন হবে জুনে। উনি যেহেতু জুন পর্যন্ত চলে গিয়েছেন, সুতরাং বেশি সংস্কার নিয়েই তো (নির্বাচন) হবে। আর এর পরে নির্বাচন কোন কারণে পেছাবে? এর পরে নির্বাচন যাওয়ার তো কোনো কারণ দেখি না।’ একইরকম মনোভাব জানিয়েছেন এনসিপির সদস্য সচিব আখতার হোসেন। তিনি বলেন, একটা গণঅভ্যুত্থানের পরে সংস্কার হওয়াটাই স্বাভাবিক। ‘ডিসেম্বর থেকে জুন -আমরা মনে করি এ সময়ের মধ্যেই সরকার সংস্কার এবং বিচারের দৃশ্যমানতার দিকে সরকার এগোতে পারে। এর মধ্যেই নির্বাচন আয়োজনের যে কার্যক্রম সেটা সম্পূর্ণ করা সম্ভব।’ তবে এনসিপি কিংবা জামায়াত জুন পর্যন্ত অপেক্ষা করতে চাইলেও ডিসেম্বরে নির্বাচন না হলে আন্দোলনের প্রস্তুতি নিচ্ছে বিএনপি। সেক্ষেত্রে যেসব দল জুন পর্যন্ত সরকারকে সময় দিতে চায় তাদের কী হবে? এসব দলও কি তাদের দাবি নিয়ে আন্দোলনে যাবে? জানতে চাইলে জামায়াতে ইসলামীর মুখপাত্র মতিউর রহমান আকন্দ বলেন, কোনো দলেরই আন্দোলনের পরিস্থিতি দেশে নেই। ‘আন্দোলনটা কার বিরুদ্ধে হবে? আন্দোলনটা তো হবে একটা দাবি আদায়ের জন্য। সেই দাবিটা তুলে ধরা, আলোচনার তো জায়গা আছে, প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে কথা বলা যায়, ঐকমত্য কমিশনে বক্তব্য তুলে ধরা যায়।’ ‘দ্বিতীয়ত, যদি এমনটা হয় যেকোনো অবস্থাতেই একটা যৌক্তিক দাবি আদায় করা যাচ্ছে না। তখন আপনি জনগণকে জানাতে পারেন। এতে কোনো সমস্যা নেই। কিন্তু বাংলাদেশে এই ধরনের কোনো সিচুয়েশন এখনও তৈরি হয়নি।’ দলগুলোর মধ্যে যখন এমন মতভেদ তখন অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের ঐকমত্য কমিশন ধারাবাহিকভাবে বৈঠক শুরু করেছে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে। এসব বৈঠক এবং দলগুলোর আনুষ্ঠানিক মতামত পাওয়ার পরই সংস্কার এবং নির্বাচনের সময় নিয়ে ঐকমত্যের পথ স্পষ্ট করতে চায় সরকার। কিন্তু তার আগেই বড় দলগুলোর যে মনোভাবে তাতে এটা বোঝা যাচ্ছে যে, সেই ঐকমত্য হয়তো খুব একটা সহজ হবে না।