অনিয়ম অভিযোগরে মধ্যদিয়ে শান্তিপূর্ণ পরিবেশে দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনের ভোটগ্রহণ সম্পন্ন
স্টাফ রিপোর্টার: ভোটারের তুলনামূলক কম উপস্থিতি, কয়েকটি আসনে গোলযোগ আর অনিয়ম, জালভোট, ভোটকেন্দ্র দখলের অভিযোগ ও বর্জনের মধ্যেও গতকাল রোববার মোটাদাগে শান্তিপূর্ণভাবে দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনের ২৯৯ আসনের ভোটগ্রহণ শেষ হয়েছে। নির্বাচনি সংঘাতে কুমিল্লায় একজন ও মুন্সীগঞ্জে একজনকে কুপিয়ে হত্যা করেছে দুর্বৃত্তরা। বাংলাদেশে নির্বাচনের ইতিহাসে নতুন রেকর্ড গড়েছে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ। টানা চতুর্থবারের মতো বিজয়ী হয়ে সরকার গঠন করতে যাচ্ছে দলটি। গতকাল রোববার ২৯৯ আসনে ভোট হয়। রাত সোয়া ১১টা পর্যন্ত ২৯৯ আসনের মধ্যে ২২২ আসনের অনানুষ্ঠানিক ফল পাওয়া গেছে। ২৯৯ আসনের ৪২ হাজার কেন্দ্রের মধ্যে অনিয়মের কারণে ভোট স্থগিত হয়েছে অন্তত সাতটি কেন্দ্রের। এ নির্বাচনে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্টতায় বিজয়ের পথে। শেষ খবর পাওয়া পর্যন্ত ২১৬ টিতে জয় পেয়েছে আওয়ামী লীগ। বিপুল ভোটের ব্যবধানে নির্বাচিত হয়েছেন আওয়ামী লীগ সভাপতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এ নির্বাচনে ৫৩টি আসনে জয়ী হয়ে নতুন চমক সৃষ্টি করেছেন স্বতন্ত্র প্রার্থীরা। আর জাতীয় পার্টির প্রার্থীরা জয়ী হয়েছেন ১১টি আসনে। এর আগে রোববার সকাল ৮টায় ৩০০ আসনের মধ্যে ২৯৯টি আসনে একযোগে ভোট গ্রহণ শুরু হয়। নওগাঁ-২ আসনে একজন প্রার্থীর মৃত্যুর কারণে ওই আসনে নির্বাচন বন্ধ রাখা হয়েছে। সহিংসতা, নাশকতা, কারচুপি, ভোট দিতে বাধা দেয়ার অভিযোগের মধ্যদিয়ে এদিন বিকাল ৪টায় শেষ হয় ভোট গ্রহণ। তবে অনেক আসনে শান্তিপূর্ণ ভোট গ্রহণের খবরও পাওয়া গেছে। জয়ের সংখ্যা হিসাব করলে আওয়ামী লীগের পর স্বতন্ত্রদের অবস্থান। জাতীয় পার্টি তৃতীয় অবস্থানে রয়েছে। তবে দলগতভাবে বিবেচনায় জাতীয় পার্টি দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে। এবারের নির্বাচনে বিএনপিসহ ১৬টি রাজনৈতিক দল বর্জন করে। ভোটগ্রহণ শেষে সংশ্লিষ্ট রিটার্নিং কর্মকর্তা বেসরকারি ফলাফল ঘোষণা করেন। নির্বাচন কমিশনে স্থাপিত মঞ্চ থেকেও একে একে ফলাফল ঘোষণা করেন ইসি সচিব মো. জাহাংগীর আলম। ফলাফল ঘোষণা উপলক্ষ্যে নির্বাচন কমিশন সচিবালয়ে বড় মঞ্চ তৈরি করা হয়। বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের প্রতিনিধিরা ফলাফল ঘোষণা অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন। এ উপলক্ষ্যে নির্বাচন কমিশনে ব্যাপক নিরাপত্তা ব্যবস্থা নেয়া হয়। ভোটগ্রহণ নিয়ে সাধারণ মানুষের কৌতূহল এবং কেন্দ্রগুলোতে ভোটার উপস্থিতি দুটোই কম ছিলো। বিএনপিসহ ১৬টি রাজনৈতিক দল অংশ না নেয়ায় ভোটারদের কেন্দ্রমুখী হওয়ার আগ্রহ কম ছিলো। নির্বাচন কমিশনের দেয়া তথ্যমতেও, ভোটগ্রহণ শুরু থেকেই কেন্দ্রে ভোটার উপস্থিতি কম থাকার বিষয়টি স্পষ্ট হয়। সকাল ৮টা থেকে দুপুর ১২টা পর্যন্ত চার ঘণ্টায় ১৮.৫০ শতাংশ এবং বিকেল ৩টা পর্যন্ত সাত ঘণ্টায় ২৭.১৫ শতাংশ ভোট পড়ে বলে পৃথক সংবাদ সম্মেলনে জানান নির্বাচন কমিশন সচিব মো. জাহাংগীর আলম। যদিও বিকাল সাড়ে ৫টায় প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কাজী হাবিবুল আউয়াল জানান, নির্বাচনে বিকাল ৪টা পর্যন্ত ভোট পড়েছে ৪০ শতাংশ। তবে ভোটপড়ার ওই হার কমবেশি হতে পারে বলেও উল্লেখ করেন সিইসি।
ভোটগ্রহণ শেষে নির্বাচন অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ হয়েছে দাবি করে প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কাজী হাবিবুল আউয়াল বলেন, নির্বাচনে ‘৪০ শতাংশের মতো’ ভোট পড়েছে। দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনে কিছুটা চ্যালেঞ্জ থাকে। সরকারের যে উইল ছিলো অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের, সেদিক থেকে সরকারের তরফ থেকে আন্তরিকতা ছিল, সহযোগিতা ছিলো। সেই সহযোগিতা পেয়েছি বলেই দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ হয়েছে। তবে আমি বলছি না নির্বাচন গ্রহণযোগ্য হয়েছে।
গতকাল রাত এ প্রতিবেদন লেখা পর্যন্ত সর্বশেষ পাওয়া ফলাফলে ২২১ আসনের মধ্যে আওয়ামী লীগ ২১৬, জাতীয় পার্টি ১১, স্বতন্ত্র ৫৩ এবং অন্যান্য দলের মধ্যে কল্যাণ পার্টির ১টি আসন পেয়েছে। এর মধ্যে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের প্রার্থীর পাশাপাশি তাদের শরিক ওয়র্কার্স পার্টি, জাসদ, জেপির ছয় জন নৌকা প্রতীক নিয়ে নির্বাচন করছে। এরমধ্যে ১৪ দলীয় ৬ টি আসনের জাসদ ১টি, ওয়ার্কার্স পার্টি ১ ও তরিকত ফেডারেশন ১ আসনে বেসরকারিভাবে বিজয়ী হয়েছে। এই ভোটের ফলে বাংলাদেশের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো টানা চতুর্থ মেয়াদে সরকার গঠন করতে যাচ্ছে শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ। দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ভোটগ্রহন গতকাল সকাল ৮টা থেকে বিকাল ৪টা পর্যন্ত টানা চলেছে। নওগাঁ-২ আসনের একজন প্রার্থী মারা যাওয়ায় সেখানে ভোট বন্ধ আছে। ভোটের মাঠে শান্তিপূর্ণ পরিবেশ বজায় রাখতে মোতায়েন করা হয় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর প্রায় ৮ লাখ সদস্য। ভোটের লড়াইয়ে ছিলেন আওয়ামী লীগ-জাতীয় পার্টিসহ ২৮ দলের ১ হাজার ৯৬৯ জন প্রার্থী। এরমধ্যে স্বতন্ত্র ছিল ৪৩৭ জন। বিএনপিসহ ১৬টি দলের ভোট বর্জন করেছে।
ভোটকে ঘিরে রাজনৈতিক বিরোধীতায় অবরোধ, হরতালের কর্মসূচির মধ্যে বেশ কিছু গোলযোগ, সংঘর্ষের ঘটনাও ঘটেছে। এছাড়া গতকাল ভোটকেন্দ্র দখল, জালভোট প্রদান, এজেন্টদেরকে জোরপূর্বক কেন্দ্র থেকে বের করে দেয়াসহ নানা অভিযোগে শেষমূহুর্তে দ্বাদশ জাতীয় সংসদের নির্বাচন বর্জনের ঘোষণা দিয়েছেন বিভিন্ন আসনের প্রার্থীরা।
নির্বাচন বিশেষজ্ঞদের মতে, নির্বাচন অংশগ্রহণমূলক না হলে ভোটারদের আগ্রহ কম থাকে। তারা উদাহরণ টেনে বলেন, ২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ-বিএনপিসহ ৩৯টি দল অংশ নিয়েছিল। ওই নির্বাচনে ৮০ শতাংশ ভোট পড়ে। আর ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি নির্বাচনে আওয়ামী লীগসহ ১২টি দল অংশ নেয়। আর বিএনপিসহ বেশিরভাগ দল বর্জন করে। ওই নির্বাচনে ১৪৭টি আসনে গড়ে ৪০ শতাংশ ভোট পড়েছিলো।
গতকাল অনুষ্ঠিত দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিএনপিসহ প্রধান বিরোধী দলগুলোর প্রার্থী না থাকা এবং আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কঠোর অবস্থানের মধ্যেও কয়েকটি আসনে ভোটগ্রহণে অনিয়ম, প্রভাব বিস্তার ও কেন্দ্র দখলের ঘটনা ঘটে। প্রভাব বিস্তারসহ বিভিন্ন অপরাধে চট্টগ্রাম-১৬ আসনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী ও বর্তমান সংসদ সদস্য মোস্তাফিজুর রহমান চৌধুরীর প্রার্থিতা ভোটগ্রহণ শেষ হওয়ার মাত্র ১৫ মিনিট আগে বাতিল করে ইসি। জাল ভোট দেওয়াসহ বিভিন্ন অনিয়মের সঙ্গে জড়িত হওয়ার দায়ে প্রিসাইডিং কর্মকর্তাসহ কয়েকজনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। বেশ কয়েকজনকে বিভিন্ন মেয়াদে সাজা দেওয়া হয়েছে। এছাড়া কেন্দ্র দখল, জাল ভোটসহ নানা কারণে ১১টি আসনের ২৩টি কেন্দ্রের ভোটগ্রহণ স্থগিত করা হয়েছে। অবশ্য নির্বাচন কমিশন দাবি করেছে, তাদের প্রত্যাশার চেয়েও ভোটগ্রহণ ভালো হয়েছে। গতকাল রাত সাড়ে ৯টার দিকে প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কাজী হাবিবুল আউয়াল কয়েকটি গণমাধ্যমকে বলেন, প্রত্যাশার চেয়ে ভোটগ্রহণ ভালো হয়েছে। এতো ভালো ভোট হবে তা আশা করিনি। বিকেল ৪টায় ভোটগ্রহণ শেষ হওয়ার দেড় ঘণ্টা পর নির্বাচন কমিশন আনুষ্ঠানিক ব্রিফ করে। ওই সময়ে সিইসি সাংবাদিকদের বলেন, সরকারের সহায়তায় অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে। নির্বাচন নিয়ে স্বস্তির কথা জানিয়ে তিনি বলেন, মোটামুটিভাবে নির্বাচন নিয়ে আমাদের যে আশঙ্কা ছিল, সেটি হয়নি। আমাদের শঙ্কা ছিল ভোটার উপস্থিতি হয়তো আরও অনেক কম হবে। এটার কারণ হচ্ছে একটি জাতীয় নির্বাচনে বড় একটি পক্ষ নির্বাচন বর্জন করে প্রতিহত করার ঘোষণা দিয়েছে। কয়েকটি কেন্দ্রে অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটেছে। একটি ট্রেনে আগুনের মতো মর্মান্তিক ঘটনা ঘটেছে। অনেকের মনে এগুলো দেখে এক ধরনের শঙ্কা জাগ্রত হতে পারত যে, নির্বাচনটা সহিংস হবে। কিন্তু আমরা দেখেছি অনেক ভোটার স্বতঃস্ফূর্তভাবে কেন্দ্রে উপস্থিত হয়ে স্বাধীনভাবে তাদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করেছেন।
নির্বাচনকালীন সরকার নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে মতপার্থক্যের মধ্যে গত ১৫ নভেম্বর জাতীয় নির্বাচনের তফশিল ঘোষণা করেন সিইসি কাজী হাবিবুল আউয়াল। এ নির্বাচনে আওয়ামী লীগসহ ২৮টি রাজনৈতিক দল অংশ নেয়। রাজনৈতিক দল ও স্বতন্ত্র মিলিয়ে ১৯৬৯ জন প্রার্থী নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন। অনেক প্রার্থী নির্বাচনে অনিয়মের অভিযোগ তুলে ভোট বর্জন করেন। ৪২ হাজার ২৪টি ভোটকেন্দ্র এবং ২,৬০,৮৫৮টি ভোটকক্ষে ভোটগ্রহণ হয়। নির্বাচনে ভোটার ছিলেন ১১ কোটি ৯৩ লাখ ৩৩ হাজার ১৫৭ জন।