স্টাফ রিপোর্টার: টানা প্রায় দেড় যুগ ধরে ক্ষমতার বাইরে থাকা বিএনপিতে অনেকটা সুদিন ফিরেছে গত বছরের ৫ আগস্টের পর থেকে। ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে শেখ হাসিনার বিদায়ের পর জেল-জুলুমের খড়গ থেকে অনেকটা মুক্তি পেয়েছেন বিএনপির নেতাকর্মীরা। প্রধান রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ বিধ্বস্ত হওয়ায় ক্ষমতার মসনদে যেতে দলটি সামনে আর কোনো বাধা দেখছে না। আগামী নির্বাচনে তাদের ক্ষমতায় যাওয়ার পথ অনেকটা মসৃণ বলে মনে করছে দলটি। ক্ষমতায় যাওয়ার উজ্জ্বল সম্ভাবনা তৈরি হওয়ায় দ্রুত নির্বাচন দাবিতে সোচ্চার হয়ে উঠেছে বিএনপি। অন্তর্বর্তী সরকার প্রয়োজনীয় সংস্কার শেষে নির্বাচনের কথা বললেও বিএনপি চাচ্ছে দ্রুত নির্বাচন। দলটি মনে করছে, নির্বাচন দিতে দেরি হলে প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে ফিরে আসার সম্ভাবনা রয়েছে। অন্যদিকে তৃণমূলের নেতাকর্মীদের নানা বিতর্কিত কর্মকা-ে জনপ্রিয়তাও কমে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।
বিএনপির চাপের মুখে অন্তর্বর্তী সরকারের পক্ষ থেকে বারবার প্রয়োজনীয় সংস্কার দ্রুত শেষ করে নির্বাচন দেয়া হবে বলে জানানো হচ্ছে। ইতোমধ্যে প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস জানিয়েছেন, নির্বাচনের সম্ভাব্য দুটি সময়সূচি তারা নির্ধারণ করেছেন। একটি হলো চলতি বছরের ডিসেম্বরে, আরেকটি ২০২৬ সালের জুনের মধ্যে। প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম জানিয়েছেন, রাজনৈতিক দলগুলো বেশি সংস্কার না চাইলে চলতি বছরের ডিসেম্বরেই নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। ইতোমধ্যে নির্বাচন রোডম্যাপ ঘোষণা করা হয়েছে বলেও মনে করেন প্রেস সচিব। তবে সরকারের এসব বক্তব্যে পুরোপুরি আশ্বস্ত নয় বিএনপি। দলটি আরও সুনির্দিষ্টভাবে রোডম্যাপ ঘোষণার দাবি করেছে। দ্রুত সময়ে নির্বাচন আদায়ের ব্যাপারে অন্তর্বর্তী সরকারকে চাপে রাখার কৌশল নিয়েছে বিএনপি। দলটি এই দাবিতে কর্মসূচি ঘোষণার পরিকল্পনা নিয়েছে। দ্রুত নির্বাচনের দাবিতে অপরাপর দলগুলো নিয়ে মাঠে নামার কথাও চিন্তা করছে বিএনপি। বিএনপি নেতারা বলছেন, অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে প্রথম থেকেই তারা সহযোগিতা করে আসছেন। এখনো সহযোগিতা করছেন। সরকার যে সংস্কারগুলো করছে এতে তাদের কোনো আপত্তি নেই। সংস্কার একটি চলমান প্রক্রিয়া। সময় অনুযায়ী সংস্কার হয়ে থাকে। অভ্যুত্থানের দুই বছর পূর্বেই তারা রাষ্ট্র মেরামতে ৩১ দফা দিয়েছেন। ওই সংস্কারের মাধ্যমেই দেশকে একটি সত্যিকারের গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র হিসেবে গঠন করা সম্ভব। অন্তর্বর্তী সরকার যেসব সংস্কারের কথা বলছে, তার সবগুলোই ওই ৩১ দফাতে অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। তাই এখন প্রয়োজনীয় সংস্কার করে দ্রুত সময়ের মধ্যে নির্বাচনের আয়োজন করা সম্ভব।
সূত্র জানিয়েছে, নির্বাচন ইস্যু নিয়ে মিত্রদের সঙ্গে বৈঠক করেছে বিএনপি। বৈঠকে নির্বাচনের বিষয়ে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও জোটে নেতাদের মতামত নিয়েছে দলটি। সংস্কারে বেশি সময় না নিয়ে অবিলম্বে নির্বাচনের সুস্পষ্ট রোডম্যাপ ঘোষণা চান নেতারা। জানুয়ারির মধ্যে নির্বাচনের রোডম্যাপের ঘোষণা দেয়া না হলে যুগপৎ আন্দোলনের পরিকল্পনাও রয়েছে তাদের। কর্মসূচির লক্ষ্য হবে নির্বাচন ইস্যুতে জনমত তৈরি করা এবং সরকারের ওপর নির্বাচনী চাপ সৃষ্টি করা। এজন্য সারাদেশেই কর্মসূচির পরিকল্পনাও রয়েছে তাদের। শুরু থেকেই সরকারকে দ্রুত নির্বাচনের ব্যবস্থার চাপ দিয়ে আসছে বিএনপি। দলটির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান এবং মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরসহ কেন্দ্রীয় নেতারা প্রায় প্রতিদিনই নির্বাচন ইস্যুতে কথা বলছেন। সবশেষ গতকাল বৃহস্পতিবার (৯ জানুয়ারি) জাতীয় প্রেসক্লাবে জাতীয়তাবাদী মুক্তিযোদ্ধা দল আয়োজিত এক আলোচনা সভায় দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য মেজর (অব.) হাফিজ উদ্দিন আহমেদ নির্বাচন প্রসঙ্গে কথা বলেন। তিনি বলেন, ‘আমরা অতি দ্রুত নির্বাচন চাই, যে সংস্কারের কথা বলেন, শেখ হাসিনার পলায়নের মাধ্যমে ৮০ ভাগ সংস্কার হয়েছে। এখন আর সংস্কারের প্রয়োজন নেই, এখন প্রয়োজন নির্বাচনি ব্যবস্থা সংস্কার। নির্বাচন দিতে যত দেরি হবে, তত শেখ হাসিনার ষড়যন্ত্র বাড়বে।’ অন্তর্বর্তী সরকারের উদ্দেশে হাফিজ উদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘আপনারা যে সংস্কার করতে চান সেই সংস্কারের অধিকার আপনাদের নেই, জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধিরাই সংস্কার করবে। ভারত থেকে শেখ হাসিনাকে ফিরিয়ে আনার উদ্যোগ নিয়েছে অন্তর্বর্তী সরকার। এরপরও দেশটি শেখ হাসিনার ভিসার মেয়াদ বৃদ্ধি করেছে। বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্ক অস্থিতিশীল করতেই এটি করা হয়েছে।’
বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব শহীদ উদ্দিন চৌধুরী এ্যানী বলেন, ‘অন্তর্বর্তী সরকারকে প্রথম থেকে আমরা সহযোগিতা করে আসছি, এখনো সহযোগিতা করছি। যৌক্তিক সময়ের মধ্যে নির্বাচন দেবেন, আমরা এটাই আশা করি। ওনাদের (অন্তর্বর্তী সরকার) কাছে আমাদের প্রত্যাশার জায়গা অনেক, একটু বেশি থাকবে এটাই স্বাভাবিক। দেশের কথা চিন্তা করে, জনগণের কথা চিন্তা করে আমরা এই কথাগুলো বলছি। সেই পর্যায়ে আসা খুবই জরুরি। সংস্কার একটি চলমান প্রক্রিয়া, এখন যতোটুকু প্রয়োজন তারা ততোটুকু করবে। এরপর যারা সরকার গঠন করবে তারাই বাকি কাজগুলো করবে।’
বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব আব্দুস সালাম আজাদ বলেন, ‘অন্তর্বর্তী সরকারের সংস্কারকে আমরা অস্বীকার করছি না। তারা সংস্কার করবে, কিন্তু আমরা দ্রুত সময়ের মধ্যে নির্বাচন চাচ্ছি। সংস্কার একটি চলমান প্রক্রিয়া। কখন কোন বিষয়টি সংস্কার করা প্রয়োজন সেটা সময়ই বলে দেয়। আমরা নির্বাচনের জন্য দীর্ঘ ১৫ বছর লড়াই সংগ্রাম করেছি। এতে অনেক লোকের জীবন দিতে হয়েছে। শুধু নির্বাচনব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার জন্য তো এতোকিছু হয়েছে। দেশের মানুষ দ্রুত নির্বাচন প্রত্যাশা করে, এজন্য আমরাও দ্রুত নির্বাচন চাই। পাশাপাশি সংস্কার চলছে, চলবে। এতে আমাদের কোনো আপত্তি নেই।’ বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন বলেন, ‘নির্বাচনের বিষয়ে বিএনপির পক্ষ থেকে পরিষ্কার বক্তব্য দেয়া হয়েছে। নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য যত দ্রুত সম্ভব সেটাই বলা হয়েছে।’ ভোটের তারিখ মানুষ কতটা সংস্কার চায় সেটার ওপর নির্ভর করে ড. মুহাম্মদ ইউনূসের এমন বক্তব্য প্রসঙ্গে খন্দকার মোশাররফ বলেন, ‘ওনার (ড. ইউনূস) বক্তব্য জনগণ যদি চায়; জনগণ যখন তাদের বসিয়েছে তখনই চেয়েছে। জনগণ চেয়েছে পরিবর্তন, কিন্তু অনির্দিষ্ট পরিবর্তন তো কেউ কখনো যেতে পারে না। তারা অন্তর্বর্তীকালীন সরকার তারা তো অনির্দিষ্টকালের জন্য সরকার নয়। অতএব জনগণের দাবি অনুযায়ী যত দ্রুত সম্ভব নির্বাচন দেয়া উচিত। জনগণ ইতোমধ্যে নির্বাচন চাচ্ছে।’