দেশের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা চুয়াডাঙ্গায় ৪১ ডিগ্রি সেলসিয়াস রেকর্ড : চলছে তীব্র দাবদাহ

প্রয়োজন ছাড়া ঘর থেকে বের না হওয়াসহ ফলমূল ও বেশি করে পানি খাওয়ার পরামর্শ

স্টাফ রিপোর্টার: চুয়াডাঙ্গায় মাঝারি থেকে এবার প্রচ- দাবদাহ শুরু হয়েছে। আবহাওয়া অধিদপ্তর গতকাল বৃহস্পতিবার বেলা তিনটায় জেলার সর্বোচ্চ তাপমাত্রা রেকর্ড করেছে ৪১ ডিগ্রি সেলসিয়াস। ঢাকায় সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ছিল ৩৯ দশমিক ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস। তাপদাহের কারণে ধানের শিষ পুড়ে যাচ্ছে। সবজিরও ক্ষতি হচ্ছে। বিশেষ প্রয়োজন ছাড়া ঘর থেকে বের হচ্ছে না মানুষ। জেলা প্রশাসন থেকেও প্রয়োজন ছাড়া ঘর থেকে বের না হওয়ার পরামর্শ দিয়ে প্রচারণা চালাচ্ছেন। আরও এক সপ্তাহ এমন তাপদাহ থাকতে পারে বলে জানিয়েছেন চুয়াডাঙ্গা আবহাওয়া অফিস। টানা তাপপ্রবাহে দুর্বিষহ হয়ে পড়েছে জনজীবন। তীব্র তাপদাহে এ জেলার খেটে খাওয়া মানুষ সবচেয়ে বেশি বিপাকে পড়েছেন। তীব্র গরম ও রোদের তাপের কারণে শ্রমিক, দিনমজুর, ভ্যান-রিকশা চালকরা কাজ করতে না পেরে অলস সময়ও পার করছেন। একটু প্রশান্তির খোঁজে গাছের ছায়া ও ঠান্ডা পরিবেশে স্বস্তি খুঁজছে স্বল্প আয়ের মানুষরা। বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে রাস্তা ঘাটে লোকজনের চলাচল সীমিত হয়ে পড়ছে। আবার অনেকে জরুরি প্রয়োজন ও জীবন-জীবিকার তাগিদে প্রচন্ড তাপদাহ উপেক্ষা করে কাজে বের হচ্ছেন। অতিরিক্ত গরমে অসুস্থ হয়ে পড়ছেন অনেকে। জেলা সদরের হাসপাতালসহ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সগুলোতেও বেড়েছে শিশুসহ বিভিন্ন বয়সী রোগীর সংখ্যা।

আবহাওয়াবিদ মো. ওমর ফারুক বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় এ তথ্য জানান। তিনি বলেন, ‘এখন যে তাপপ্রবাহ চলছে, এটি আগামী ১৬ তারিখ পর্যন্ত থাকবে। সেই পর্যন্ত তাপমাত্রা বৃদ্ধির ধারা অব্যাহত থাকতে পারে। এরপর হয়তো তাপমাত্রা কিছুটা কমতে পারে। তখন বিচ্ছিন্নভাবে কোথাও কোথাও কিছুটা বৃষ্টি হতে পারে। তবে আগামী ২৩ এপ্রিল পর্যন্ত তাপপ্রবাহ মোটামুটি এমনই থাকতে পারে।’ গতকাল বৃহস্পতিবার সন্ধ্যা ৬টা থেকে আগামী ২৪ ঘণ্টার আবহাওয়ার পূর্বাভাস তুলে ধরে তিনি বলেন, ‘এ সময়ে সারাদেশের আবহাওয়া শুষ্ক থাকতে পারে। দিন ও রাতের তাপমাত্রা সামান্যত বাড়তে পারে।’ চাঁদ দেখা সাপেক্ষে আগামী ২২ বা ২৩ এপ্রিল মুসলমানদের সবচেয়ে বড় ধর্মীয় উৎসব ঈদুল ফিতর উদযাপিত হবে। ঈদের সময় আবহাওয়া কেমন থাকবে, জানতে চাইলে ওমর ফারুক বলেন, ‘ঈদের সময় চট্টগ্রাম, ময়মনসিংহ ও সিলেটের দিকে কিছুটা বৃষ্টির সম্ভাবনা রয়েছে। তবে অন্যান্যা বিভাগগুলোতে বৃষ্টিপাতের সম্ভাবনা কম।’ আবহাওয়া অধিদপ্তরের তথ্যানুযায়ী, ৩৬ থেকে ৩৮ ডিগ্রিকে মৃদু, ৩৮ থেকে ৪০ ডিগ্রিকে মাঝারি ও ৪০ ডিগ্রি সেলসিয়াসের চেয়ে বেশি তাপমাত্রাকে তীব্র তাপপ্রবাহ বলা হয়। গরম বেড়ে সারাদেশে জনজীবন দুর্বিষহ হয়ে উঠেছে। রমজান মাস, এর ওপর চৈত্রের দাবদাহে মানুষের দুর্ভোগ সীমাহীন।

আবহাওয়াবিদরা জানিয়েছেন, এবারের গরমের একটি ভিন্নমাত্রা রয়েছে। বাতাসের আর্দ্রতার পরিমাণ স্বাভাবিকের চেয়ে কম। তাই তাপদাহের মধ্যেও ঠোঁট শুকিয়ে ফেঁটে যাচ্ছে। কারও চড়চড় করছে ত্বক। বাতাসে জ্বলীয়বাষ্প কম থাকায় মূলত এমন হচ্ছে।

আবহাওয়া অধিদপ্তর জানিয়েছে, বৃহস্পতিবার ফরিদপুর, মানিকগঞ্জ, রাজশাহী, পাবনা, বাগেরহাট, যশোর, চুয়াডাঙ্গা ও কুষ্টিয়া জেলার ওপর দিয়ে তীব্র তাপপ্রবাহ এবং বরিশাল ও চট্টগ্রাম বিভাগসহ এবং ঢাকা, টাঙ্গাইল, মাদারীপুর, গোপালগঞ্জ, নরসিংদী, নারায়ণগঞ্জ, বগুড়া, নওগাঁ, সিরাজগঞ্জ, ময়মনসিংহ, মৌলভীবাজার, খুলনা ও সাতক্ষীরা জেলার ওপর দিয়ে মৃদু থেকে মাঝারি ধরনের তাপপ্রবাহ বয়ে যাচ্ছে এবং তা অব্যাহত থাকতে পারে। বৃহস্পতিবার সকালে দেশের সর্বনিম্ন তাপমাত্রা ১৮ দশমিক ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস ছিলো তেঁতুলিয়ায়। ঢাকায় সর্বনিম্ন তাপমাত্রা ছিলো ২৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস। চুয়াডাঙ্গায় সর্বনিম্ন তাপমাত্রা ছিলো ১৯ দশমিক ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস।

এদিকে, অতীতের সব রেকর্ড ভেঙে চলতি মরসুমে ২ এপ্রিল থেকে একটানা চুয়াডাঙ্গাতেই দেশের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়। একটানা তাপমাত্রা বেড়ে যাওয়ায় হিট স্ট্রোক, হৃদরোগ, ডায়রিয়া, শিশুদের নিউমোনিয়াসহ গরমজনিত রোগবালাই বেড়ে গেছে। চুয়াডাঙ্গায় ১০০ শয্যার সদর হাসপাতালে আজ অন্তর্বিভাগে অন্তত ২৭০ জন রোগী ভর্তি হয়ে চিকিৎসা নিচ্ছেন। এছাড়া বহির্বিভাগে প্রায় এক হাজার রোগী চিকিৎসা নিয়েছেন। সদর হাসপাতালের আবাসিক চিকিৎসা কর্মকর্তা ফাতেহ আকরাম জানান, হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে আসা রোগীদের বেশির ভাগই গরমজনিত রোগে আক্রান্ত। গরমে জরুরি প্রয়োজন ছাড়া মানুষ তেমন বাইরে বের হচ্ছেন না।

আবহাওয়া অধিদপ্তরের তথ্যমতে, বৃহস্পতিবার চলতি মরসুমের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছে। গত বছরের ২৪ ও ২৫ এপ্রিল জেলায় ওই বছরের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছিলো ৪১ ডিগ্রি সেলসিয়াস। এ বছর ১১ দিন আগেই বৃহস্পতিবার গত বছরের সর্বোচ্চ রেকর্ড ছুঁয়ে ফেলেছে। গত বছরের ১৩ এপ্রিল এ জেলার সর্বোচ্চ তাপমাত্রার রেকর্ড ছিলো ৩৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস।

চুয়াডাঙ্গা সদরের কুলচারা গ্রামের শফিউল বলেন, ‘এতো তাপমাত্রা সহ্য করা কঠিন। জমিতে বেশিক্ষণ কাজ করতে পারলাম না। এখন ছায়ায় বসে আছি। আজ কাজ শেষ করতে দেরি হবে।’ ‘ যে গরম পড়ছে, আর কাজ করতে পারবো কিনা জানি না’। ‘ধানে সব শিশ বের হয়েছে, প্রচন্ড রোদে তা পুড়ে যাচ্ছে’। প্রতিদিন পানি দেয়া লাগছে’। ‘যেখানে আগে সপ্তাহে ২দিন পানি দিলেই চলতো’।

ভ্যানচালক মাহবুব বলেন, ‘ঈদের কেনাকাটা থাকলেও মানুষজন বাজারে আসছে না’। ‘তাই ভাড়াও হচ্ছে না, দুপুর হয়ে গেছে এখনও ৫০টাকা ভাড়া হয়নি’। ‘শুয়ে-বসে দিন কাটাচ্ছি। এভাবে চললে সংসার চালানোই কঠিন হয়ে পড়বে।’ ‘ঈদের কেনাকাটা তো দূরের কথা’।

তরমুজ বিক্রেতা মুনছুর হোসেন বলেন, ‘এতো গরম তারপরও দিনের বেলায় তেমন বেচাকেনা নেই। ইফতারের আগমুহূর্তে বিক্রি বাড়বে আশা করি। কিন্তু অসহ্য এ গরমে দোকানে বসে থাকাই কষ্ট হয়ে যাচ্ছে।’

চুয়াডাঙ্গা পৌর এলাকার হাটকালুগঞ্জে অবস্থিত প্রথম শ্রেণির আবহাওয়া পর্যবেক্ষণাগারের জ্যেষ্ঠ পর্যবেক্ষক রাকিবুল হাসান জানান, বুধবার পর্যন্ত চলতি মরসুমে মাঝারি দাবদাহ বিরাজ করছিলো। ওইদিন জেলায় সর্বোচ্চ তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছিলো ৩৯ দশমিক ৭ ডিগ্রি সেলসিয়াস। বৃহস্পতিবার সেখানে একদিনেই তাপমাত্রার পারদ ১ দশমিক ৩ ডিগ্রি বেড়ে ৪১ ডিগ্রিতে উঠে গেছে। শুরু হয়েছে প্রচ- তাপদাহ। আগামী বুধবার পর্যন্ত তাপমাত্রা বাড়তে থাকবে। চলতি সপ্তাহেই তাপমাত্রা ৪৩ ডিগ্রিতে পৌঁছাতে পারে। প্রচ- থেকে প্রচ-তর দাবদাহ দেখা দিতে পারে। রাকিবুল হাসান বলেন, প্রতিবছর এপ্রিল-মে মাসে তাপমাত্রা বেড়ে থাকে। এছাড়া কোনো কোনো বছর জুন মাসেও তাপমাত্রা বাড়তে থাকে। ভৌগলিক কারণে এই চরম ভাবাপন্নতা দেখা দিয়েছে। তাপমাত্রা বেড়ে যাওয়ায় গরমের প্রভাবে সবচেয়ে সংকটে আছেন পরিবারের জ্যেষ্ঠ ও শিশু সদস্যরা। বাড়ি বাড়ি গরমজনিত জ্বর-ডায়রিয়া ছড়িয়ে পড়েছে। সদর হাসপাতাল ও জেলার তিনটি উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে গরমজনিত রোগের চিকিৎসা নিতে রোগীদের ভিড় বেড়েই চলেছে। সদর হাসপাতালের মেডিসিন বিভাগের পরামর্শক আবুল হোসেন জানান, গরমের কারণে হার্টের রোগীরা সমস্যায় আছেন, বাড়ছে হিট স্ট্রোকের ঘটনা। এসব রোগী চিকিৎসা নিতে হাসপাতালে আসছেন। তিনি বলেন, গরমজনিত রোগবালাইয়ের হাত থেকে রক্ষা পেতে মানুষকে ঘরের বাইরে বের হতে বারণ করা হচ্ছে। জরুরি প্রয়োজনে ছাতা ব্যবহার, প্রচুর পরিমাণ পানি, খাওয়ার স্যালাইন ও তরলজাতীয় খাবার এবং রোজাদারদের ভাজাপোড়া খেতে বারণ করে ফলমূল ও বেশি করে পানি খাওয়ার পরামর্শ দেয়া হচ্ছে।

চুয়াডাঙ্গা জেলায় শিশুদের জন্য আলাদা কোনো হাসপাতাল নেই। ১০০ শয্যার সদর হাসপাতালে শিশুদের জন্য ১৫টি শয্যা বরাদ্দ। শিশু বিভাগের পরামর্শক মাহবুবুর রহমান জানান, ১৫ শয্যার বিপরীতে বৃহস্পতিবার শিশু ওয়ার্ডে ৭০ জন ও ডায়রিয়া ওয়ার্ডে ৪০জন শিশু ভর্তি এবং বহির্বিভাগে আরও দেড় শতাধিক শিশুর চিকিৎসা দেয়া হয়েছে। যাদের বেশির ভাগই গরমজনিত রোগে আক্রান্ত।

মাহবুবুর বলেন, ‘গরমে শিশুদের ডায়রিয়া, টাইফয়েড, শরীরে ঘাম বসে নিউমোনিয়া, ঠান্ডা, সর্দি, কাশি, জ্বর ও প্রস্রাবে সংক্রমণ দেখা দিচ্ছে। এসব রোগ নিয়েই হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে আসছে তারা। আমরা শিশুদের অভিভাবকদের পরামর্শ দিচ্ছি, ছয় মাস পর্যন্ত শিশুদের শুধুই বুকের দুধ খাওয়াতে হবে। শিশু যাতে না ঘামে, সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। ঘেমে গেলে দ্রুত মুছে দিতে হবে। শিশুকে ঘরের বাইরে বের হতে দেয়া যাবে না। টাটকা খাবার খাওয়াতে ও ফ্যানের নিচে রাখতে হবে। সামর্থ্য থাকলে এসিতে ২৬-২৭ ডিগ্রি তাপমাত্রায় রাখতে পরামর্শ দেয়া হচ্ছে।’

চুয়াডাঙ্গা প্রথম শ্রেণির আবহাওয়া পর্যবেক্ষণাগার সূত্রে জানা গেছে, গত ২ এপ্রিল চুয়াডাঙ্গায় ৩৩ দশমিক ৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়। যা ছিলো দেশের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা। এরপর থেকে গত ১২দিন একটানা দেশের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা এ জেলায় রেকর্ড করা হচ্ছে। গত ৩ এপ্রিল ৩৫ দশমিক ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস, ৪ এপ্রিল ৩৭ ডিগ্রি সেলসিয়াস, ৫ এপ্রিল ৩৭ ডিগ্রি সেলসিয়াস, ৬ এপ্রিল ৩৭ দশমিক ৬ ডিগ্রি সেলসিয়াস, ৭ এপ্রিল ৩৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস, ৮ এপ্রিল ৩৮ দশমিক ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস, ৯ এপ্রিল ৩৯ ডিগ্রি সেলসিয়াস, ১০ এপ্রিল ৩৯ দশমিক ২ ডিগ্রি সেলসিয়াস ও ১১ এপ্রিল ৩৯ দশমিক ৬ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়। বুধবার সন্ধ্যা ৬টায় সারা দেশের তথ্য সংগ্রহ শেষে এতথ্য জানায় আবহাওয়া অফিস। বৃহস্পতিবার দুপুর ১২টায় ৩৯ ডিগ্রি এবং বেলা ৩টায় ৪১ ডিগ্রি সেলসিয়াস।

চুয়াডাঙ্গা জেলা প্রশাসন ও জেলা তথ্য অফিসের পক্ষ অতি প্রয়োজন ছাড়া বাড়ি থেকে বের না হওয়ার জন্য পরামর্শ দিয়ে প্রচারণা চালানো হচ্ছে। সেই সাথে পর্যাপ্ত পানি খেতে বলা হচ্ছে। লেবুর শরবত ও স্যালাইন খাওয়ারও পরামর্শ দেয়া হচ্ছে।

Comments (0)
Add Comment