স্টাফ রিপোর্টার: আগামী ৪ ফেব্রুয়ারির পর যে কোনো দিন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে দেয়ার সম্ভাবনা আছে। ক্লাস শুরু হলে শুধু এসএসসি ও এইচএসসি পরীক্ষার্থীরা সপ্তাহে ৫-৬ দিন স্কুলে আসবে। অন্যান্য শ্রেণির শিক্ষার্থীরা সপ্তাহে একদিন স্কুলে আসবে। এ সময় তারা পুরো সপ্তাহের পড়া নিয়ে যাবে। শিক্ষার্থী বেশি হলে পালা (শিফট) করে আসবে। স্বাস্থ্যবিধি ও সামাজিক দূরত্ব বজায় রেখে বসবে ৩ ফুট দূরত্বে। এর সবকিছুই কোভিড-১৯ সংক্রান্ত জাতীয় পরামর্শক কমিটির মতামত নিয়ে করা হবে। এ কমিটির পরামর্শ না পেলে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলা হবে না।
শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনি এমপি রোববার বিকেলে বাংলাদেশ ইউনেস্কো জাতীয় কমিশনের (বিএনসিইউ) এক আলোচনাসভায় এ তথ্য প্রকাশ করেন। এর আগে দুপুরে জাতীয় সংসদ অধিবেশনে উচ্চমাধ্যমিক ও সমমানের পরীক্ষার ফল প্রকাশের লক্ষ্যে তিনটি বিল পাস হওয়ার পর দেয়া বক্তৃতায়ও তিনি একই প্রসঙ্গে কথা বলেন। বিকেলে অনুষ্ঠানে শিক্ষামন্ত্রী আরও বলেন, পর্যায়ক্রমে কলেজে চালু অনার্স-মাস্টার্স প্রোগ্রাম বন্ধ করে দেয়া হবে। তবে শিক্ষকরা চাকরি হারাবেন না। তারা অন্য কোর্স পড়াবেন। দেশে বর্তমানে বেসরকারি অনার্স-মাস্টার্স কলেজ ৩৪৯টি, সরকারি প্রায় দেড়শ। উভয় ধরনের কলেজে শিক্ষক আছেন প্রায় ৩০ হাজার।
জাতিসংঘের শিক্ষা, বিজ্ঞান ও সংস্কৃতি বিষয়ক সংস্থা ইউনেস্কো ঘোষিত তৃতীয় আন্তর্জাতিক শিক্ষা দিবস উপলক্ষে এ আলোচনাসভার আয়োজন করা হয়। কোভিড-১৯ প্রজন্মের জন্য শিক্ষা পুনরুদ্ধার ও পুনরুজ্জীবন শীর্ষক এ আলোচনায় শিক্ষামন্ত্রী প্রধান অতিথির বক্তৃতা করেন। বিশেষ অতিথি ছিলেন শিক্ষা উপমন্ত্রী ব্যারিস্টার মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেল। মূল আলোচক ছিলেন ইস্টওয়েস্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা অর্থনীতিবিদ ড. ফরাসউদ্দিন। সরাসরি এবং ভার্চুয়ালি উভয় মাধ্যমে আয়োজিত এ অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগের সচিব এবং বিএনসিইউর মহাপরিচালক মো. মাহবুব হোসেন। কারিগরি ও মাদরাসা বিভাগের সচিব আমিনুল ইসলাম খান এবং প্রাথমিক ও গণশিক্ষা সচিব গোলাম মো. হাসিবুল আলম এবং ইউনেস্কোর বাংলাদেশ প্রতিনিধি বিয়াটিস কালড্রুন এতে বক্তৃতা করেন।
আলোচনায় শিক্ষামন্ত্রী বলেন, ৪ ফেব্রুয়ারির মধ্যে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলার মতো উপযোগী করতে বলেছি আমরা। কোভিড বিষয়ক জাতীয় পরামর্শক কমিটির পরামর্শ না পেলে আমরা প্রতিষ্ঠান খুলবো না। কেননা, শিক্ষার্থীদের স্বাস্থ্য সুরক্ষা আমাদের কাছে প্রধান বিবেচ্য। আর কমিটি খোলার অনুমতি দিলেও আমরা সবাইকে একদিনে প্রতিষ্ঠানে আনব না। এসএসসি ও এইচএসসি পরীক্ষার্থীরা সপ্তাহে ৫-৬ দিন করে আসবে। বাকিরা আসবে একদিন করে। এসে পুরো সপ্তাহের পড়া নিয়ে যাবে। পরের সপ্তাহে আবার একদিন আসবে। এটা এ কারণে যে, শিক্ষার্থীর সংখ্যা অনেক। শ্রেণিকক্ষে তাদের গাদাগাদি করে বসতে হবে। তাতে স্বাস্থ্যবিধি মেনে বসানো সম্ভব হবে না। তাই সব শ্রেণির শিক্ষার্থীকে একসঙ্গে না এনে আলাদা আলাদা দিন ক্লাসে আনার ব্যবস্থা হবে। খুলে দেয়ার পরে ক্লাস কার্যক্রম মনিটরিং করা হবে। এজন্য স্থানীয় ও জাতীয় পর্যায়ে কমিটি থাকবে। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, আসলে ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে সাহসিকতার সঙ্গে আমাদের কাজ করতে হবে। আমরা স্বাস্থ্যবিষয়ক ঝুঁকি নিতে চাই না। এ বিষয়টি বিবেচনায় নিয়েই পদক্ষেপ নিচ্ছি।
শিক্ষামন্ত্রী বলেন, এ বছর যারা এসএসসি ও এইচএসসি পরীক্ষা দেবে তারা এক বছর সরাসরি ক্লাস করতে পারেনি। যদিও অনলাইন ও টিভিতে অনেকে ক্লাস করেছে। তবু প্রেক্ষাপট ও প্রয়োজন বিবেচনায় রেখে তাদের জন্য সংক্ষিপ্ত সিলেবাস করা হয়েছে। এ সিলেবাসের ওপর পাঠদান শেষে তাদের পরীক্ষা নেয়া যাবে।
শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলার প্রস্তুতি নিতে ২২ জানুয়ারি নির্দেশ দেয় সরকার। পাশাপাশি পাঠানো হয় প্রতিষ্ঠান খোলার প্রস্তুতি ও ক্লাস চলাকালীন সময়ের জন্য তৈরি গাইডলাইন। ক্লাসে বসতে হবে স্বাস্থ্যবিধি মেনে ৩ ফুট দূরত্বে। ৫ ফুটের কম দৈর্ঘ্যের বেঞ্চে একজন শিক্ষার্থী এবং ৫ থেকে ৭ ফুট দৈর্ঘ্যের বেঞ্চে দুজন শিক্ষার্থী বসতে পারবে। গাইডলাইনে আরও আছে, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলার আগেই স্কুলের পক্ষ থেকে প্রত্যেক শিক্ষার্থীর সঙ্গে যোগাযোগ করবেন শিক্ষকরা। শিক্ষক ও শিক্ষার্থী উপস্থিতির সংখ্যা আগেই নিরূপণ করবেন। স্বাস্থ্যবিধি অনুসরণ করে আসন ব্যবস্থা কেমন হবে, একই সঙ্গে বা একই শিফটে সর্বোচ্চ কতো শিক্ষার্থীকে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে আনা সম্ভব হবে এগুলো দেখা হবে। এছাড়া সবাইকে একই সঙ্গে আনা সম্ভব না হলে সেক্ষেত্রে সবার শিক্ষা নিশ্চিত করতে বিকল্প পরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে। কারা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে আসবে বা কারা বিকল্প উপায়ে লেখাপড়া চালাবে বা দূর-শিখনে যুক্ত হবে সে বিষয়টি পরিকল্পনায় অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। এতে আরও বলা হয়েছে, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে কোনো খাবারের আয়োজন থাকবে না। তবে শিক্ষার্থীর প্রয়োজনে শুধু নিজ নিজ বাসা থেকে নিয়ে আসা রান্না করা খাবার খাওয়া যেতে পারে। দরিদ্র, পিছিয়ে পড়া ও সুবিধাবঞ্চিত শিক্ষার্থীদের তালিকা প্রস্তুতকরণ ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ফিরিয়ে আনতে নিয়মিত যোগাযোগ করতে হবে। প্রয়োজন অনুসারে শিখন-সামগ্রী, মাস্কসহ অন্যান্য নিরাপত্তা সামগ্রী উপহার হিসাবে সরবরাহ করার ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের আঙিনা, বারান্দা বা শ্রেণিকক্ষের মেঝে জীবাণুমুক্ত করতে হবে। এজন্য আগে সাবান পানি দিয়ে ধুয়ে তারপর দশমিক ৫ শতাংশ (৫০০০ পিপিএম সমপরিমাণ) সোডিয়াম হাইডোক্লোরাইড ব্যবহার করতে হবে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ছোট উপকরণগুলো জীবাণুমুক্ত করতে ৭০ শতাংশ ইথাইল অ্যালকোহল ব্যবহার করার কথা বলা হয়েছে। এক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠানকে নিজস্ব তহবিল থেকে অর্থ ব্যয় করতে হবে। বলা হয়েছে, প্রতি ৩০ জন মেয়ে শিক্ষার্থীর জন্য একটি টয়লেট ও ৬০ জন ছেলে শিক্ষার্থীর জন্য একটি টয়লেট সংখ্যা নিশ্চিতকরণের পরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে।
গতকাল রোববারের আলোচনাসভায় ড. ফরাসউদ্দিন অবশ্য কিছুটা ভিন্নমত প্রকাশ করেন। তিনি প্রথমে প্রাথমিক বিদ্যালয় খুলে দেয়ার পক্ষে মত দেন। আর সপ্তাহে ৬ দিনের মধ্যে ৩দিন করে ৪ ভাগে শিক্ষার্থীদের প্রতিষ্ঠানে আনার পরামর্শ দেন। এক্ষেত্রে সকাল-বিকেল দুই শিফটে হবে ক্লাস। তিনি বলেন, শিক্ষকদের এ ক্ষেত্রে যেহেতু অতিরিক্ত পরিশ্রম করতে হবে তাই তাদের প্রতি মাসে বাড়তি একটি মূল বেতনের সমান অর্থ দেয়া যেতে পারে। সংক্ষিপ্ত সিলেবাসে এসএসসি-এইচএসসি পরীক্ষার্থীদের ক্লাস সপ্তাহে ৬ দিনই রাখার পরামর্শ দিয়ে তিনি বলেন, তাহলে মে মাসের শেষে এসএসসি আর এপ্রিলের শেষে এইচএসসি পরীক্ষা সম্ভব হবে। এতে ৩-৬ মাস সময় তাদের জীবন থেকে নষ্ট হবে। টিকা কার্যক্রম শুরু হলে ডিসেম্বরের মধ্যে দেশ করোনামুক্ত হবে বলে তিনি আশা ব্যক্ত করেন। তিনি শিক্ষার বিভিন্ন ধারায় প্রয়োজনীয় সংস্কার আনার পরামর্শ দেন।