স্টাফ রিপোর্টার: তীব্র দাবদাহে খাল, বিল, পুকুর শুকিয়ে যাচ্ছে। বৃষ্টির দেখা নেই। ফলে বাড়ছে পানির তাপমাত্রা। এতে করে বিপাকে পড়েছেন চুয়াডাঙ্গার মাছচাষিরা। এই তীব্র গরমে চুয়াডাঙ্গার জলাশয়ের মাছ মরে যাচ্ছে। এতে করে লোকসানের মুখে পড়ছেন চাষিরা।
আবহাওয়া অফিস সূত্রে জানা যায়, এক সপ্তাহেরও বেশি সময় ধরে চুয়াডাঙ্গায় বৃষ্টিপাত হয়নি। তাপমাত্রা থাকছে ৩৮ থেকে ৪০ ডিগ্রি সেলসিয়াসে। আর মাছ চাষের জন্য ২৫ থেকে ৩২ ডিগ্রি আদর্শ তাপমাত্রা। বিধায় মাছ মারা যাচ্ছে।
সরেজমিনে জেলার বিভিন্ন পুকুরে গেলে দেখা যায়, মাছ চাষিরা তাদের মাছ বাঁচানোর পানি সেচসহ নানাভাবে আপ্রাণ চেষ্টা করছেন। তারপরও অতিরিক্ত তাপে মরে যাচ্ছে মাছ।
দামুড়হুদা উপজেলার উজিরপুর গ্রামের হরকত আলীর ১০ বিঘারও বেশি জলাশয় লিজ নিয়ে মাছ চাষ করেন আলমডাঙ্গা উপজেলার চিৎলা গ্রামের হালদারপাড়ার মদন হালদার। গত দুদিনের গরমে তার প্রায় ৩০০ মণ মাছ মারা গেছে। তিনি শ্রমিক দিয়ে সেই মাছ পুকুর থেকে তুলছেন।
মদন হালদার বলেন, এই দুদিনে গরমের কারণে আমার প্রায় ৩০০ মণ মাছ মরে গেছে। এই গরমে মাছ তো দূরের কথা, মানুষেরও জীবনযাপন কষ্টকর হয়ে গেছে। একটু বৃষ্টি হলে আবহাওয়া ঠান্ডা হতো। আর যদি ঠিকমতো বিদ্যুৎ থাকতো, তাহলে সমস্যা এত তীব্র হতো না। তিনি আরও বলেন, গরমে গত দুদিনেই আমাদের ১৫-২০ লাখ টাকা লোকসান হয়েছে। জেলার অন্য চাষিদেরও আমার মতো অবস্থা।
আলমডাঙ্গার ফুলবগাদী গ্রামের জব্বার আলী ফেরি করে গ্রামে গ্রামে মাছ বিক্রি করেন। তিনি চুয়াডাঙ্গার সবচেয়ে বড় পাইকারি মাছের বাজার শহরের মাছপট্টিতে এসেছেন মাছ কিনতে। জব্বার আলী বলেন, ‘মাছ মরে যাচ্ছে, মাছ পাওয়া যাচ্ছে না। গরমে পুকুরের পানির অবস্থা ভালো না, পানি নেই। আবার দাম বেশি।’
বাজারে আসা এক মাছ ব্যবসায়ী বলেন, পুকুরে জাল দিয়েও গরমের কারণে মাছ উঠছে না। সব মাছ গভীরে চলে যাচ্ছে। বৃষ্টি হবে তারপর মাছ ভাসবে। এখন মাছ ভাসছে না, একদম গভীরে চলে যাচ্ছে।
মাছচাষি মো. আমানউল্লাহ বলেন, আমার দুটি পুকুর আছে। গরমে মাছ ছটফট করছে। মাছ বাঁচাতে স্যালোমেশিন দিয়ে পুকুরে পানি দিচ্ছি। সময় না হলেও কিছু মাছ তুলে বিক্রিও করে দিয়েছি।
চুয়াডাঙ্গা মাছপট্টির আড়তদার জামিরুল ইসলাম বলেন, বর্তমান গরমের কারণে ইলিশ মাছ খুব একটা আসছে না। বিদ্যুৎ বিভ্রাটের কারণে মাছগুলো তাড়াতাড়ি নরম হয়ে যাচ্ছে। দামও কম পাচ্ছি। তবে অন্য মাছের দাম ঠিক আছে। লোডশেডিং ও গরম কমে গেলে বাজার স্বাভাবিক হবে।
চুয়াডাঙ্গা জেলা মৎস্য অফিস সূত্রে জানা গেছে, জেলায় ১১ হাজারের বেশি পুকুর রয়েছে। আর ৬৫ হাজার হেক্টরের বেশি জলাধার রয়েছে। এছাড়া এ জেলায় ১২টি নদী ও ১০টি বাওড় আছে। যেখানে চাষ ছাড়াও প্রাকৃতিকভাবেই মাছ পাওয়া যায়। চুয়াডাঙ্গায় ২০২২-২০২৩ অর্থবছরে মাছের উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা ২৩ হাজার ৭৪১ মেট্রিক টন। তবে এবার গরমের কারণে উৎপাদন কম হতে পারে।
চুয়াডাঙ্গা জেলা মৎস্য কর্মকর্তা দীপক কুমার পাল বলেন, সারাদেশে প্রচ- গরম পড়ছে। এতে প্রাকৃতিক জলাশয়সহ চাষের পুকুরেও মাছের সমস্যা হবে। গরমের কারণে পুকুরের পানির তাপমাত্রা বৃদ্ধি পেলে মাছের প্রাকৃতিক খাদ্য নষ্ট হয়ে যেতে পারে। তীব্র গরমের ফলে পুকুরে অক্সিজেন সংকট দেখা দিতে পারে। এসময় মাছ ভেসে ওঠে। এছাড়া পরিবেশগত চাপ সহ্য করতে না পেরে মাছ মারাও যেতে পারে। তিনি বলেন, মাছ ভেসে উঠলে কিছু কৌশল প্রয়োগ করতে হবে। সকালে মাছ ভাসলে প্রতি শতকে ২০০ থেকে ২৫০ গ্রাম চুন প্রয়োগ করতে হবে। আবার দুপুরের পর ভাসলে একই হারে লবণ প্রয়োগ করতে হবে। তাহলে রাসায়নিক সমস্যা থেকে সহজেই রক্ষা পাওয়া যাবে। এসময় বিশেষ পরিচর্যার মধ্যে অন্যতম হলো মাছের খাবার কমিয়ে আনতে হবে। পরিমিত খাবার দিতে হবে। হররা টেনে পুকুরের তলার গ্যাস বের করে দিতে হবে। এটি মাছ চাষের অত্যাবশ্যকীয় একটি করণীয়।
দীপক কুমার পাল বলেন, অক্সিজেনের ঘাটতির জন্য প্রতি শতকে অক্সিজেন ট্যাবলেট প্রয়োগ করা যেতে পারে। তবে এটি খুবই ব্যয়বহুল। সম্ভব হলে পানি সরবরাহের ব্যবস্থা করতে হবে। ১৫ দিন অথবা এক মাসের মধ্যে পানি প্রবেশ করানো খুব ভালো। কিন্তু এখন অপরিকল্পিত পুকুর খননের কারণে এটি সম্ভব হচ্ছে না। তাই পুকুরে মাছের ঘনত্ব কমাতে হবে। এছাড়া স্থায়ী সমাধান হিসেবে এরেটর (পানিতে অক্সিজেন সরবরাহের যন্ত্র) সেট করতে হবে। এছাড়া পুকুরে সেচের মাধ্যমে পানি প্রবেশ করানো যেতে পারে। গরমে মাছ চাষে বিশেষ কিছু সতর্কতা অবলম্বন করলেই অনেকাংশে দুর্ঘটনা কমানো যায়। মাছ চাষে বছরব্যাপী পরিকল্পনা রাখতে হবে। তাহলে এসব সমস্যা হবে না।
চুয়াডাঙ্গার বিভিন্ন নদ, নদী, খাল, বিল, হাওড়, বাওড়ে প্রচুর পরিমাণে দেশীয় জাতের মাছ পাওয়া যায়। তবে গরম অব্যাহত থাকলে এ প্রাকৃতিক মাছও হারিয়ে যাবে। এছাড়া বিভিন্ন জলাশয়ে পাঙাশ, সিলভারকার্প, তেলাপিয়া, মাগুর, কইসহ প্রায় ১৮-২২ প্রজাতির মাছ চাষ হয়। অব্যাহত তাপপ্রবাহে এই চাষও ঝুঁকিতে।