টানা তাপপ্রবাহে দুর্বিষহ হয়ে পড়েছে জনজীবন : হাসপাতালে বাড়ছে রোগী

চুয়াডাঙ্গাসহ দেশের ৫৬ জেলায় বইছে তাপপ্রবাহ : সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ৪০ ডিগ্রি ছুঁই ছুঁই

স্টাফ রিপোর্টার: চৈত্রের শেষে প্রচ- গরম পড়েছে। শুধু চুয়াডাঙ্গা নয়, এ গরম দেশের সর্বত্র। গরম কমার লক্ষণ নেই তাড়াতাড়ি। রংপুর বিভাগ ছাড়া সারাদেশে বইছে মৃদু থেকে মাঝারি তাপপ্রবাহ। গতকাল বুধবার দেশের ৫৩ জেলায় তাপপ্রবাহ বইছে। এ পরিস্থিতি অব্যাহত থাকতে পারে বলে জানিয়েছে আবহাওয়া অধিদপ্তর। অন্তত আরও পাঁচদিন এমন গরম থাকতে পারে বলে জানিয়েছেন আবহাওয়াবিদেরা। চৈত্রের শেষে এমন তাপপ্রবাহ বইলেও মাসের শুরুটা কিন্তু আরামদায়ক ছিলো। এর কারণ ছিলো বৃষ্টি। চৈত্র মাসের প্রথম দুই সপ্তাহে বৃষ্টি ঝরেছে। চলতি এপ্রিলের ২ তারিখে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে কয়েক দিন ধরে চলা টানা বৃষ্টি শেষ হয়। এরপর অবশ্য দুয়েক জায়গায় বিচ্ছিন্নভাবে বৃষ্টি হয়েছে। তবে এক সপ্তাহ ধরে বৃষ্টির দেখা নেই প্রায় কোনো স্থানে। এর মধ্যে তাপমাত্রা ৪০ ডিগ্রি ছুঁই ছুঁই। গতকাল দেশের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয় চুয়াডাঙ্গায়, ৩৯ দশমিক ৯ ডিগ্রি সেলসিয়াস। ঢাকায় সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ছিলো ৩৮ দশমিক ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস।

আবহাওয়া অধিদপ্তরের দেয়া আগামী ২৪ ঘণ্টার পূর্বাভাসে বলা হয়েছে রাজশাহী, ঢাকা, চট্টগ্রাম, খুলনা, বরিশাল ও সিলেট বিভাগ এবং নীলফামারীতে মৃদু থেকে মাঝারি আকারের তাপপ্রবাহ বয়ে যাচ্ছে। অর্থাৎ ৫৩ জেলায় তাপপ্রবাহ বয়ে যাচ্ছে। এটি অব্যাহত থাকতে পারে।

আবহাওয়া অধিদপ্তরের আবহাওয়াবিদ মো. উমর ফারুক বলেন, এখন যে তাপপ্রবাহ বইছে, এটা ১৬ এপ্রিল পর্যন্ত থাকতে পারে। এর মধ্যে তাপমাত্রা বাড়তে পারে। সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ৪০ ডিগ্রি সেলসিয়াস হওয়ার সম্ভাবনা আছে এর মধ্যে। আবহাওয়া অধিদপ্তর প্রতিদিন ৪৪টি স্টেশনের আবহাওয়ার পরিস্থিতি তুলে ধরে। সেখানে দেখা যাচ্ছে, ৪৪টি স্টেশনের কোথাও গত ২৪ ঘণ্টায় বৃষ্টি হয়নি।

আবহাওয়াবিদ মো. উমর ফারুক বলেন, ১৭ এপ্রিল থেকে চট্টগ্রাম ও সিলেট বিভাগের কিছু কিছু জায়গায় বৃষ্টি হতে পারে। এর আগে দেশে বৃষ্টির সম্ভাবনা কম। আসলে এবার একটু বেশি সময় ধরে বৃষ্টি হচ্ছে না। এতে আরও তীব্র গরম অনুভূত হচ্ছে। আবহাওয়া অধিদপ্তরের তথ্যানুযায়ী-৩৬ থেকে ৩৮ ডিগ্রিকে মৃদু, ৩৮ থেকে ৪০ ডিগ্রিকে মাঝারি ও ৪০ ডিগ্রি সেলসিয়াসের চেয়ে বেশি তাপমাত্রাকে তীব্র তাপপ্রবাহ বলা হয়।

এদিকে, টানা ১২দিন দেশের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছে চুয়াডাঙ্গায়। গতকাল বুধবারও দেশের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ৩৯ দশমিক ৭ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়। যা এ মরসুমের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা। টানা তাপপ্রবাহে দুর্বিষহ হয়ে পড়েছে জনজীবন। তীব্র তাপদাহে এ জেলার খেটে খাওয়া মানুষ সবচেয়ে বেশি বিপাকে পড়েছেন। তীব্র গরম ও রোদের তাপের কারণে শ্রমিক, দিনমজুর, ভ্যান-রিকশা চালকরা কাজ করতে না পেরে অলস সময়ও পার করছেন। একটু প্রশান্তির খোঁজে গাছের ছায়া ও ঠা-া পরিবেশে স্বস্তি খুঁজছে স্বল্প আয়ের মানুষরা। বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে রাস্তা ঘাটে লোকজনের চলাচল সীমিত হয়ে পড়ছে। আবার অনেকে জরুরি প্রয়োজন ও জীবন-জীবিকার তাগিদে প্রচ- তাপদাহ উপেক্ষা করে কাজে বের হচ্ছেন। অতিরিক্ত গরমে অসুস্থ হয়ে পড়ছেন অনেকে। জেলা সদরের হাসপাতালসহ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সগুলোতেও বেড়েছে শিশুসহ বিভিন্ন বয়সী রোগীর সংখ্যা।

দিনমজুর শামসুল আলম বলেন, ‘এতো তাপমাত্রা সহ্য করা কঠিন। জমিতে বেশিক্ষণ কাজ করতে পারলাম না। এখন ছায়ায় বসে আছি। আজ কাজ শেষ করতে দেরি হবে।’

রাস্তার পাশে বসে বেল ও কলা বিক্রি করছিলেন মুনছুর আলী। তিনি বলেন, ‘কোনো বিক্রি নেই। শুয়ে-বসে দিন কাটাচ্ছি। এভাবে চললে সংসার চালানোই কঠিন হয়ে পড়বে।’

তরমুজ ও ডাব বিক্রেতা শামীম হোসেন বলেন, ‘এতো গরম তারপরও দিনের বেলায় তেমন বেচাকেনা নেই। ইফতারের আগমুহূর্তে বিক্রি বাড়বে আশা করি। কিন্তু অসহ্য এ গরমে দোকানে বসে থাকাই কষ্ট হয়ে যাচ্ছে।’

বেসরকারি চাকরিজীবী রত্না মালিক বলেন, ‘এ তাপমাত্রায়ও অফিসে এসেছি। তবে ফিল্ডে যেতে পারছি না। সৃষ্টিকর্তা দ্রুত আবহাওয়া স্বাভাবিক করুক। সেই প্রার্থনা করি।’

চুয়াডাঙ্গা প্রথম শ্রেণির আবহাওয়া পর্যবেক্ষণাগার সূত্রে জানা গেছে, গত ২ এপ্রিল চুয়াডাঙ্গায় ৩৩ দশমিক ৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়। যা ছিলো দেশের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা। এরপর থেকে গত ১২দিন একটানা দেশের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা এ জেলায় রেকর্ড করা হচ্ছে। গত ৩ এপ্রিল ৩৫ দশমিক ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস, ৪ এপ্রিল ৩৭ ডিগ্রি সেলসিয়াস, ৫ এপ্রিল ৩৭ ডিগ্রি সেলসিয়াস, ৬ এপ্রিল ৩৭ দশমিক ৬ ডিগ্রি সেলসিয়াস, ৭ এপ্রিল ৩৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস, ৮ এপ্রিল ৩৮ দশমিক ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস, ৯ এপ্রিল ৩৯ ডিগ্রি সেলসিয়াস, ১০ এপ্রিল ৩৯ দশমিক ২ ডিগ্রি সেলসিয়াস ও ১১ এপ্রিল ৩৯ দশমিক ৬ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়। বুধবার সন্ধ্যা ৬টায় সারা দেশের তথ্য সংগ্রহ শেষে এতথ্য জানায় আবহাওয়া অফিস। চুয়াডাঙ্গা প্রথম শ্রেণির আবহাওয়া পর্যবেক্ষণাগারের ইনচার্জ জামিনুর রহমান বলেন, ‘ বুধবার চুয়াডাঙ্গায় ৩৯ দশমিক ৭ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছে। এটি চলতি মরসুমের ও দেশের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা। তবে আপাতত বৃষ্টিপাতের সম্ভাবনা নেই। তাপমাত্রা আরও বাড়বে।

তিনি বলেন, চুয়াডাঙ্গা জেলা কর্কটক্রান্তি রেখার কাছাকাছি হওয়ায় মার্চ ও এপ্রিল মাসের তাপমাত্রা স্বাভাবিকের তুলনায় বেশি থাকে। এ বছর পর্যাপ্ত বৃষ্টি না হওয়ায় মার্চে গড় তাপমাত্রা বেড়ে গেছে। এরই ধারাবাহিকতায় এপ্রিলে তাপমাত্রা আরও বেড়েছে।

চুয়াডাঙ্গা সদর হাসপাতালের শিশু কনসালট্যান্ট ডা. মাহাবুবুর রহমান মিলন বলেন, গরমের কারণে হাসপাতালের আন্তঃবিভাগ ও বহির্বিভাগে প্রতিদিন রোগী বাড়ছে। শিশুরা ডায়রিয়া ও টাইফয়েডে বেশি আক্রান্ত হচ্ছে। ডায়রিয়া ওয়ার্ডে ৪৬জন রোগী ভর্তি রয়েছেন। আর শিশু ওয়ার্ডে ভর্তি ৫৫ জন। শয্যার তুলনায় অতিরিক্ত রোগী ভর্তি হওয়ায় গরমের ভেতর গাদাগাদি করে মেঝে ও বারান্দায় চিকিৎসা নিতে হচ্ছে। গরমে শিশুদের প্রতি যত্নবান হওয়ার পরামর্শ দিয়ে তিনি বলেন, শিশুরা অতিরিক্ত গরম সহ্য করতে না পারায় সহজে রোগে আক্রান্ত হচ্ছে। তাদের টাটকা খাবার ও বিশুদ্ধ পানি খাওয়াতে হবে।

Comments (0)
Add Comment