নামধারী স্বেচ্ছাসেবকদের চিহ্নিত করা হচ্ছে
নিয়মিত অভিযান চালিয়ে নেয়া হবে ব্যবস্থা-জেলা প্রশাসক
স্টাফ রিপোর্টার: অনিয়ম-অব্যবস্থাপনা ও দালালের দৌরাত্ম্যের চরমে পৌঁছেছে চুয়াডাঙ্গা সদর হাসপাতাল। চিকিৎসা সেবা নিতে পদে পদে ভোগান্তিতে পড়তে হচ্ছে রোগীদের। হাসপাতালে জরুরি বিভাগ থেকে শুরু করে প্রতিটি ক্ষেত্রে সেবা পেতে অভ্যন্তরীণ সিন্ডিকেটের কাছে জিম্মি হতে হচ্ছে। এক দিকে দালালচক্রের অপতৎপরতা অন্যদিকে জরুরি বিভাগের কতিপয় স্বেচ্ছাসেবকের লাগামহীন দুর্নীতি। ফলে চিকিৎসা নিতে এসে নাকাল রোগী ও স্বজনরা। দিনের পর দিন অনিয়ম চললেও কোনোভাবে এর প্রতিকার হচ্ছে না। এই নিয়ে ভুক্তভোগীদের হয়রানি বেড়েই চলছে। আর প্রকাশ্যেই চলছে এসব অনিয়ম-দুর্নীতি এবং অব্যবস্থাপনা। বিভিন্ন সময় এই অনিয়ম-দূর্নীতির বিরুদ্ধে বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় লেখালেখি হলেও তেমন কেউ আমলে নেয়নি। এই ব্যাপারে বরাবরই নিশ্চুপ থেকে যাচ্ছেন কর্তৃপক্ষ। ফলে অনিয়মই একপ্রকার নিয়মে পরিণত হয়েছে।
অনিয়ম-অব্যবস্থাপনার মধ্যে চুয়াডাঙ্গা সদর হাসপাতালে চিকিৎসা সেবা নিতে এসে রোগীদের হয়রানি ও ভোগান্তির অন্যতম কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে দালালচক্রের দৌরাত্ম্য। এখানে সেবা নিতে এসে দালালের খপ্পরে পড়েননি এমন সেবাপ্রার্থীর সংখ্যা হয়তো খুবই কম। হাসপাতালের কর্মকর্তা, স্থানীয় বেসরকারি ক্লিনিক ও রোগনির্ণয়কেন্দ্রের (ডায়াগনস্টিক সেন্টার) মালিকেরা এই দালাল চক্র গড়ে তুলেছেন বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। তাদের দৌরাত্ম্যে চিকিৎসা নিতে আসা রোগীরা যেমন বিপাকে পড়ছেন; তেমনি এদের অপতৎপরতার শিকার হচ্ছেন চিকিৎসকরাও। এছাড়া জরুরি বিভাগে কিছু স্বেচ্ছাসেবকের নিকট জিম্মি হয়ে পড়েছে সেবা নিতে আসা রোগী ও তাদের স্বজনেরা।
অভিযোগ রয়েছে, চুয়াডাঙ্গা সদর হাসপাতালের জরুরি বিভাগে জরুরি চিকিৎসা নিতে অবশ্যই স্বেচ্ছাসেবকদের সঙ্গে দরদাম ঠিক করতে হয় রোগীদের। দরদাম ঠিক হলেই শুরু হয় সেবা নামক চিকিৎসা। আগে টাকা পরে চিকিৎসা নিয়মে বাদ যায় না অসহায়, প্রতিবন্ধী ও দরিদ্র রোগীরাও। টাকা দেয়ার পরই শুরু হয় চিকিৎসা। অন্যদিকে, হাসপাতালের স্বেচ্ছাসেবক হওয়ার সুযোগে এক শ্রেণির দালালচক্র মোটা অঙ্কের কমিশনের মাধ্যমে সদর হাসপাতাল থেকে রোগী ভাগিয়ে বিভিন্ন বেসরকারি ডায়াগনস্টিক সেন্টারে স্থানান্তর করছে। দৈনিক এ সিন্ডিকেট ৪০ থেকে ৫০ হাজার টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে জেলার বিভিন্ন এলাকা থেকে আসা গরিব অসহায় রোগীদের কাছ থেকে। কেউ এর প্রতিবাদ করলেই তাকে নানা ভয়ভীতি দেখিয়ে হাসপাতাল চত্বর ত্যাগ করতে বাধ্য করা হয় বলে রোগীর স্বজনরা জানান। ওয়ার্ডে চিকিৎসকের সঙ্গে দালালদেরও রাউন্ড দিতে দেখা যায়। রোগীদের ব্যবস্থাপত্রে কোন পরিক্ষা নিরীক্ষা দিলে তাৎক্ষনিক দালালেরা নির্দিষ্ট ডায়াগনস্টিক সেন্টারে ভাগিয়ে নেয়। যেখানে বেশিরভাগ পরীক্ষা-নিরীক্ষা সদর হাসপাতালে থেকেই কম খরচে করা যায়। শুধু এসবই নয়, প্রকল্পে নিয়োগপ্রাপ্তসহ একাধিক সেচ্ছাসেবকের বিরুদ্ধে হাসপাতালের কক্ষেই অনৈতিক কার্যকলাপের অভিযোগ রয়েছে। এ ধরনের একাধিক খবর প্রকাশ্যে এলেও অজানা কারণে কর্তৃপক্ষের ব্যবস্থা নিতে দেখা যায়নি অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে। এছাড়াও রোগী বহনের ট্রলি নেয়ার জন্যও গুনতে হয় টাকা। তালাবদ্ধ ট্রলি নেয়ার সময় কথিত ট্রলিম্যানকে ১০০ টাকা দিতে হবে। পরে ট্রলি ফেরত দেয়ার সময় ওই টাকাও ফেরত দেয়া হয়। তবে কতজনের টাকা ফেরত দেয়া হয় তা নিয়েও রয়েছে প্রশ্ন। সম্প্রতি ট্রলি নিতে গেলে টাকা চাওয়ার কারণে এক রোগির স্বজনের সাথে ওই ট্রলিম্যানের ধাক্কাধাক্কির ঘটনাও ঘটে।
সরেজমিনে দেখা যায়, হাসপাতালের জরুরি বিভাগ, বহির্বিভাগ, ইসিজি, এক্সরে, প্যাথলজি বিভাগ, পুরুষ ও নারী ওয়ার্ডের আশপাশে এসব দালাল চক্রের সদস্যরা ঘুরঘুর করে। বিশেষ করে দূরের এবং গ্রামএলাকা থেকে আসা রোগী ও তাদের স্বজনদের সঙ্গে নানা ফন্দি-ফিকিরে আলাপ জমিরে ভাগিয়ে নেয়ার অপচেষ্টায় লিপ্ত। সম্প্রতি হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে গিয়ে ভোগান্তির শিকার একাধিক রোগী ও স্বজনদের অভিযোগসূত্রে জানা গেছে, গত কয়েদিন আগে এক কিশোরী বিষপান করলে পরিবারের সদস্যরা সদর হাসপাতালে নিয়ে আসেন। দুজন স্বেচ্ছাসেবক এগিয়ে এসে পাকস্থলি ওয়াশ বাবদ নল কিনতে ১ হাজার ৫০০ টাকা দাবি করেন। ৫০০ টাকা দিতে চাইলে অসম্মতি জানান দুই স্বেচ্ছাসেবক। পরে কিশোরীর অবস্থা আশঙ্কাজনক হওয়ায় পরিবারের সদস্যরাও টাকা দিতে বাধ্য হয়। এরপরই পাকস্থলি ওয়াশের কার্যক্রম শুরু হয়। সড়ক দুর্ঘটনায় আহত হন সোহেল নামে এক ব্যক্তি। জরুরি বিভাগের চিকিৎসকের পরামর্শে এক্সরে করলে বাম হাত ভেঙে গেছে বলে জানানো হয়। হাত ব্যান্ডেজের জন্য চাওয়া হয় ৮০০ টাকা। অনেকে আকুতি মিনতির পর ৪০০ টাকা দিলে কাজ শুরু করে স্বেচ্ছাসেবকেরা। গতকাল ভর্তি হয়েছেন হামিদুল ইসলাম নামে এক রোগী। জরুরি বিভাগ থেকেই এক দালাল রোগীকে ভাগিয়ে নিয়ে যায় সদর হাসপাতালের পাশেই আনারুল মেডিকেল সেন্টারে। সেখানে তিনটা পরীক্ষার জন্য চাওয়া হয় ১ হাজার ৮০০ টাকা। পরে রোগীর লোকজন অন্য একটি প্রতিষ্ঠান থেকে ১ হাজার ২০০ টাকায় ওই পরীক্ষা করান। এমন অভিযোগ করেছেন রোগীর স্বজন বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর সদস্য। এছাড়াও অভিযোগ রয়েছে, জেলা সদর হাসপাতালের জরুরি বিভাগেও অধিকাংশ সময় মেলেনা এমবিবিএস চিকিৎসকের সেবা। চিকিৎসকের স্বাক্ষর করা ব্যবস্থাপত্রে দেদারছে চিকিৎসা প্রদান করেন শিক্ষানবিস স্বাস্থ্য সহকারীরা।
বিএমএ চুয়াডাঙ্গা জেলা শাখার সভাপতি ডা. মার্টিন হীরক চৌধুরী বলেন, হাসপাতালের নামধারী কিছু স্বেচ্ছাসেবকরা রোগী ভাগিয়ে নিয়ে বিভিন্ন ডায়াগনস্টিক সেন্টারে নিয়ে যায়। এতে গ্রাম-গঞ্জ থেকে আসা রোগীরা প্রতারিত হয়ে সর্বশান্ত হয়ে ফিরে যায়। সদর হাসপাতালের চিকিৎসক, স্টাফসহ কর্মকর্তারা দালাল নিধনে সবার সহযোগীতা প্রয়োজন। তিনি আরও বলেন, নামধারী স্বেচ্ছাসেবকদের ছাটাই করার জন্য হাসপাতালের বাস্তবায়ন কমিটির সভায় একাধিকবার এসব বলা হয়েছে। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ কোন ব্যবস্থা নেয়নি। যারা স্বেচ্ছাসেবক না তারাও স্বেচ্ছাসেবকদের সাথে কাজ করে দালালি করে রোগীদের সঙ্গে প্রতারণা করছে। এদের অপতৎপরতার শিকার হচ্ছেন চিকিৎসকরাও। বাস্তবায়ন কমিটি যেগুলো সিদ্ধান্ত দেয়া হয়েছিলো তা হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ যথাযত পালন করেনি। একমাত্র হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ ব্যবস্থা নিলেই দালাল নির্মূল করা সম্ভব।
এ বিষয়ে জানতে চুয়াডাঙ্গা সদর হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক ডা. আতাউর রহমান ও আবাসিক মেডিকেল অফিসার (আরএমও) ডা. এএসএম ফাতেহ আকরামের মোবাইলে একাধিকবার কল করা হলেও তারা ফোন রিসিভ করেননি।
চুয়াডাঙ্গা জেলা প্রশাসক আমিনুল ইসলাম খান দৈনিক মাথাভাঙ্গাকে বলেন, দালাল নির্মূলের লক্ষ্যে গত রোববারও আলোচনা করা হয়েছে। তাদের দৌরাত্ম্য বন্ধ করতে হবে বলে বারবার বলা হচ্ছে। দালালদের তথ্য আমাদের জানানোর জন্য হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক ও আবাসিক মেডিকেল অফিসারকে বলা হয়েছে। এখন থেকে হাসপাতালে নিয়মিত জেলা প্রশাসন ও উপজেলা প্রশাসন মোবাইল কোর্ট পরিচালনা করবে। স্বেচ্ছাসেবকদের বিষয়ে তিনি বলেন, হাসপাতালে তত্ত্বাবধায়ককে বলা হয়েছে। স্বেচ্ছাসেবকদের পরিচয়পত্র, আচরণবিধিমালাসহ শৃঙ্খলার আওতায় নিতে তারা কাজ করছে। খুব দ্রতই এসব সমস্যার সমাধান করা হবে।