স্টাফ রিপোর্টার: লিটারে ১৫ টাকা করে ডিজেল ও কেরোসিনের দাম বাড়িয়েছে সরকার। সেই সঙ্গে তরলিকৃত পেট্রোলিয়াম গ্যাস বা এলপিজির দাম কেজিতে বাড়ানো হয়েছে সাড়ে চার টাকা। পাশাপাশি রেটিকুলেটেড এবং যানবাহনে ব্যবহৃত অটোগ্যাসের দামও বাড়ানো হয়েছে। জ্বালানি তেল ও গ্যাসের দাম বাড়ার ফলে সাধারণ মানুষের দুর্ভোগ বাড়বে বলে মনে করছেন অর্থনীতিবিদ ও বিশ্লেষকরা। তারা বলছেন, সাধারণ মানুষের আয় ও জীবনযাপনে বড় ধরনের নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে মহামারী করোনাভাইরাস। করোনার প্রকোপ কমে এলেও সাধারণ মানুষের জীবনে এখনো এর প্রভাব রয়ে গেছে। অনেকের আয় কমে গেছে। এ পরিস্থিতিতে ডিজেল ও কেরোসিনের দাম বাড়ানোর ফলে সাধারণ মানুষের দুর্ভোগ বেড়ে যাবে। কারণ ডিজেল ও কেরোসিনের দাম বাড়ার কারণে পরিবহন ও উৎপাদন ব্যয় বেড়ে যাবে। ফলে বাড়বে সব ধরনের দ্রব্যের মূল্য। এতে সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতা কমে যাবে। পাশাপাশি মূল্যস্ফীতিও বাড়বে।
ডিজেল ও কেরোসিনের দাম লিটারে ১৫ টাকা করে বাড়িয়ে বুধবার (৩ নভেম্বর) রাতে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ মন্ত্রণালয় থেকে বিজ্ঞপ্তি দেয়া হয়। এ বিষয়ে বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি তেলের দাম ঊর্ধ্বগতির কারণে ভারতসহ বিশ্বের অন্যান্য দেশ তেলের দাম সমন্বয় করছে। গত ১ নভেম্বর ভারতে ডিজেলের বাজারমূল্য লিটারপ্রতি ১২৪ দশমিক ৪১ টাকা বা ১০১ দশমিক ৫৬ রুপি ছিলো। বাংলাদেশে ডিজেলের মূল্য প্রতি লিটার ৬৫ টাকা অর্থাৎ ভারতের চেয়ে ৫৯ দশমিক ৪১ টাকা কম।
বিজ্ঞপ্তিতে আরও বলা হয়, বর্তমান ক্রয়মূল্য বিবেচনা করে বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশন (বিপিসি) ডিজেলে লিটারপ্রতি ১৩ দশমিক ০১ টাকা কমে বিক্রি করছে। অন্যদিকে ফার্নেস অয়েল বিক্রি করছে লিটারপ্রতি ৬ দশমিক ২১ টাকা কমে। এতে প্রতিদিন প্রায় ২০ কোটি টাকা লোকসান দিচ্ছে বিপিসি। অক্টোবরে বিভিন্ন গ্রেডের পেট্রোলিয়াম পণ্য বর্তমান দামে সরবরাহ করায় বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশনের মোট ৭২৬ কোটি ৭১ লাখ টাকা লোকসান হয়েছে।
অন্যদিকে গ্রাহক পর্যায়ে ভ্যাটসহ কেজিতে সাড়ে চার টাকা হারে বাড়িয়ে বৃহস্পতিবার এলপিজির নতুন দাম নির্ধারণ করেছে বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন (বিইআরসি)। এতে ১২ কেজি সিলিন্ডারের দাম ১ হাজার ২৫৯ টাকা থেকে বেড়ে হয়েছে ১ হাজার ৩১৩ টাকা। একই হারে দাম বাড়ানো হয়েছে সাড়ে ৫ কেজি, সাড়ে ১২ কেজি, ১৫ কেজি, ১৬ কেজি, ১৮ কেজি, ২০ কেজি, ২২ কেজি, ২৫ কেজি, ৩০ কেজি, ৩৩ কেজি, ৩৫ কেজি ও ৪৫ কেজি এলপিজি সিলিন্ডারের দাম।
সেই সঙ্গে রেটিকুলেটেড এবং যানবাহনে ব্যবহৃত অটোগ্যাসের দামও বাড়ানো হয়েছে। রেটিকুলেটেড পদ্ধতিতে সরবরাহ করা এলপিজির দাম ভোক্তাপর্যায়ে মূসক ছাড়া প্রতি কেজি ৯৯ টাকা ৩৭ পয়সা এবং মূসকসহ প্রতি কেজি ১০৬ টাকা ১৯ পয়সা ঠিক করা হয়েছে। অক্টোবরে এ গ্যাসের দাম মূসক ছাড়া প্রতি কেজি ছিল ৯৫ টাকা ১৭ পয়সা এবং মূসকসহ প্রতি কেজি ১০১ টাকা ৬৮ পয়সা। যানবাহনে ব্যবহৃত অটোগ্যাসের মূসক ছাড়া দাম প্রতি লিটার ৫৭ টাকা ৬১ পয়সা এবং মূসকসহ ৬১ টাকা ১৮ পয়সা নির্ধারণ করা হয়েছে। অক্টোবরে এ গ্যাসের দাম মূসক ছাড়া দাম প্রতি লিটার ৫৫ টাকা ২৭ পয়সা এবং মূসকসহ ৫৮ টাকা ৬৮ পয়সা ছিলো।
এ বিষয়ে যোগাযোগ করা হলে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ও বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ এ বি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম বলেন, ডিজেল, কেরোসিন এবং এলপিজি গ্যাস বিদেশ থেকে আমদানি করতে হয়। বিশ্ববাজারে দাম বাড়ার পরিপ্রেক্ষিতে আমাদের দেশেও এগুলোর দাম বাড়ানো হয়েছে। তবে এ দাম বাড়ানোর ফলে পরিবহন ও উৎপাদন খরচ বাড়বে। ফলে দ্রব্যমূল্য বেড়ে যাবে। মূল্যস্ফীতিও বাড়বে। তিনি বলেন, দাম বাড়ানো একদিকে অপরিহার্য, অন্যদিকে কিছু কিছু ক্ষতিকর দিক আছে। এতে সাধারণ মানুষের ওপর চাপ বাড়বে। কাজেই তাদের জন্য সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির বরাদ্দ বাড়াতে হবে এবং সেটা যাতে সুষ্ঠুভাবে বিতরণ হয় তার ব্যবস্থা করতে হবে।
বর্তমান পরিস্থিতিতে দাম না বাড়িয়ে সরকার ভর্তুকি বাড়াতে পারতো কি না? এমন এক প্রশ্নের উত্তরে এ অর্থনীতিবিদ বলেন, ভর্তুকির তো একটা মাত্রা থাকে। ভর্তুকির মাত্রা বাড়ানো হলে সরকার অর্থায়ন করবে কীভাবে? পাশাপাশি সরকারকে রাজস্ব আয় বাড়াতে হবে।
বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতির সভাপতি অধ্যাপক ড. আবুল বারকাত বলেন, ডিজেল, কেরোসিন এবং এলপিজির দাম বাড়ার কারণে অন্য সবকিছুর দাম বাড়বে এবং শুধু একটা জিনিসের দাম কমবে। যেটির দাম কমবে সেটি হলো ‘মানুষ’। তিনি বলেন, করোনার কারণে এখন সাধারণ মানুষ এমনিতেই কষ্টের মধ্যে রয়েছে। এখন ডিজেল, কেরোসিন ও এলপিজির দাম বাড়ার কারণে পরিবহনের ব্যয় বাড়বে, কৃষির ব্যয় বাড়বে, ভোক্তার কাছে দ্রব্যমূল্য বাড়বে। কাজেই কৃষকও পয়সা পাবে না, পরিবহনের সাধারণ শ্রমিকও পয়সা পাবে না। মাঝখান দিয়ে যাদের পাওয়ার তারা পাবে। তাদের বলে রেন্ট সিকার। এরা শক্তি দিয়ে কোনো সম্পদ সৃষ্টি করেন না। অন্যের সৃষ্ট সম্পদ জোর দখল করে খান।
কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) প্রেসিডেন্ট গোলাম রহমান বলেন, ডিজেল, কেরোসিন ও এলপিজির দাম বাড়ানোর ফলে পরিবহন ও কৃষিখাতে খরচ বাড়বে। ফলে বাজারের সার্বিক পরিস্থিতির ওপর একটা বিরূপ প্রভাব পড়বে। এমনিতেই মানুষের আয়-রোজগার ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। সাধারণ মানুষ কষ্টে আছে। এই মূল্যবৃদ্ধি সাধারণ মানুষের দুর্ভোগ আরও বাড়াবে। এদিকে, বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও সংগঠন জ্বালানির মূল্যবৃদ্ধির প্রতিবাদ জানিয়েছে।