চুয়াডাঙ্গা-ঝিনাইদহ ও কুষ্টিয়ায় আবারো জেগে বসেছে চরমপন্থী আতঙ্ক

ফের চরমপন্থীদের আস্ফালন : পুরনো আতঙ্ক ফিরছে জনমনে

স্টাফ রিপোর্টার: তবে কি দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে আবারও মাথা চাড়া দিচ্ছে চরমপন্থিরা? এই প্রশ্ন এখন ঘুরপাক খাচ্ছে অনেকের মনে। শৈলকুপায় পূর্ব বাংলা কমিউনিস্ট পার্টি তিন জনকে একসঙ্গে গুলি করে হত্যার ঘটনায় দায় স্বীকার করে স্থানীয় গণমাধ্যমে বার্তা পাঠিয়েছে জাসদ গণবাহিনীর পক্ষে কালু পরিচয়দানকারী এক ব্যক্তি। তবে ওই ব্যক্তি আদৌ জাসদ গণবাহিনীর কেউ কি না অথবা আসলেই জাসদ গণবাহিনী ওই হত্যার সঙ্গে জড়িত কি না সে বিষয়ে কোনো নির্ভরযোগ্য সূত্রে তথ্য পাওয়া যায়নি। চুয়াডাঙ্গা ও ঝিনাইদহসহ দক্ষিণ পশ্চিম অঞ্চলের জেলাগুলোতে আবারো জেগে বসেছে চরমপন্থী আতঙ্ক। একই দিনে কুষ্টিয়া ও ঝিনাইদহে একাধিক সন্ত্রাসী কর্মকা-ে আতঙ্কিত সাধারণ মানুষ। দীর্ঘ ১৭ বছর পরে আবার সেই পুরনো আতঙ্ক চরমপন্থী। চরমপন্থীদের আস্ফালনে ভীত সন্ত্রস্ত সাধারণ মানুষ। গত শুক্রবার দিবাগত রাতে কুষ্টিয়ার শেষ সীমান্তে ঝিনাইদহ জেলার শুরুতে তিনজনকে গুলি করে হত্যা করে চরমপন্থীরা। নিহতরা হলেন হরিণাকু-ু উপজেলার আহাদনগর গ্রামের পুর্ববাংলার কমিউনিস্ট পার্টির আঞ্চলিক নেতা হানিফ, তার শ্যালক শ্রীরামপুর গ্রামের লিটন ও কুষ্টিয়া ইবি থানার পিয়ারপুর গ্রামের রাইসুল ইসলাম। হত্যার পর সাংবাদিকদের কাছে খুদে বার্তা দিয়ে এই হত্যার দায় স্বীকার করে জাসদ গণবাহিনীর পক্ষে দলের শীর্ষ নেতা কালু। একই রাতে ভেড়ামারা বালি ঘাটে ব্যাপক গোলাগুলি করে চরমপন্থীরা। ওই রাতেই কুষ্টিয়ার মিরপুরে একাধিক দোকানে গণডাকাতি হয়। এ সকল ঘটনায় নতুন করে আবার চরমপন্থীদের উত্থানের বিষয় নিয়ে ভাবছে প্রশাসন সহ অপরাধ বিশেষজ্ঞরা।

২০০৬ সালে বিএনপি সরকারের পতনের পর চরমপন্থীদের উপদ্রব বেড়ে যায় চুয়াডাঙ্গা, কুষ্টিয়া ও ঝিনাইদহসহ দক্ষিণ পশ্চিম অঞ্চলের জেলায়। গণবাহিনী গণমুক্তিফৌজ, জনযুদ্ধ, পূর্ব বাংলা কমিউনিস্ট পার্টি, বিপ্লবী কমিউনিস্ট পার্টি সহ অসংখ্য চরমপন্থী সংগঠনের আবির্ভাব হয় দক্ষিণ পশ্চিম অঞ্চলের জেলায়। কুষ্টিয়া এবং ঝিনাইদহ এলাকায় সবচেয়ে বেশি প্রভাব বিস্তার করে গণমুক্তি ফৌজ ও জাসদ গণবাহিনী। ২০০৯ সালে তৎকালীন গণবাহিনী নেতা ওবায়দুল ওরফে লাল তিনজনকে জবাই করে তাদের মস্তক রেখে যায় গণপূর্ত বিভাগের গেটে। মস্তকের সাথে রেখে যায় চিরকুট। কয়েকদিনের মধ্যে ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় গেটে আরেকজন গণমুক্তি ফৌজ ক্যাডারের মস্তক রেখে যায় গণবাহিনী। নিজেদের আধিপত্য বিস্তার ও শত শত কোটি টাকার টেন্ডারকে কেন্দ্র করে এ সকল হত্যাকা- সংগঠিত হয়। সূত্র বলছে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর দলীয় অভ্যন্তরীন কোন্দলে চরমপন্থীদের ব্যবহার করে আওয়ামী লীগ নেতারা। চরমপন্থীদের গুলিতে নিহত হয় কয়া ইউপি চেয়ারম্যান আওয়ামী লীগ নেতা জামিল হোসেন বাচ্চু। ২০০৯ সালের ২২ জুন এই হত্যাকা- সংগঠিত হয় কয়া হাতির সাঁকো নামক স্থানে। ১৫ আগস্ট ভেড়ামারায় একটি কাঙ্গালী ভোজ অনুষ্ঠানে ব্রাশ ফায়ারে নিহত হয় ভেড়ামারা আওয়ামী লীগের নেতা মেহেরুল ইসলাম ও তার বন্ধু বান্দা ফাতাহ মোহন। এ সকল হত্যাকা-ের সময় চরমপন্থীরা প্রকাশ্যে ঘুরে বেড়ালেও তৎকালীন প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ সহকারি মাহবুবুল আলম হানিফের নির্দেশে চরমপন্থীদের গ্রেপ্তার করেনি পুলিশ বলে অভিযোগ রয়েছে। আওয়ামী লীগের মাথা ছাড়া দিয়ে ওঠা নেতাদের মৃত্যুর পর শুরু হয় সন্ত্রাস দমন অভিযান। র‌্যাবের মহাপরিচালক ও পুলিশের আইজিপি আসেন কুষ্টিয়ায়, ঘোষণা দেন চরমপন্থী নিধনের। একের পর এক প্রাণ হারায় গণমুক্তি ফৌজ ক্যাডাররা। ২০০৯ সালের সেপ্টেম্বর মাসে গণমুক্তি ফৌজের সকলে নিহত হয়। এরপর গণবাহিনী পূর্ব বাংলা কমিউনিস্ট পার্টিসহ সকল চরমপন্থী সংগঠনের নেতাকর্মীদের গুলি করে মারতে থাকে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। এর আগে তত্ত্বাবধায়ক সরকার আমলে র‌্যাবের সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে নিহত পূর্ব বাংলা কমিউনিস্ট পার্টি জনযুদ্ধের প্রধান আব্দুর রশিদ মালিথা ওরফে দাদা তপন। কুষ্টিয়ার খোকসায় নিহত হন দাদা তপনের আপন ছোট ভাই আকাশ ও চরমপন্থী নেতা টিক্কা। লাগাতার ক্রসফায়ারের মুখে চরমপন্থীরা পালিয়ে আশ্রয় নেয় ভারত সহ বিভিন্ন দেশে। পতিত আওয়ামী লীগ সরকার আমলে টেন্ডারবাজীসহ বিভিন্ন সরকারি দপ্তরে চরমপন্থীদের প্রভাব থাকলেও হত্যাকান্ড নেমে আসে শূন্যের কোঠায়। সম্প্রতি আবার গোলাগুলি হত্যাকা- এইসব নিয়ে নতুন করে জনমনে আতঙ্ক সৃষ্টি হয়েছে। এ ব্যাপারে কথা বলার জন্য কুষ্টিয়া পুলিশের সাথে যোগাযোগ করা হলে পুলিশ সুপার কুষ্টিয়ায় না থাকার কারণে বক্তব্য নেয়া সম্ভব হয়ে ওঠেনি।

পুলিশ ও এলাকাবাসী জানায়, দীর্ঘদিন ধরে কুষ্টিয়া, ঝিনাইদহ ও চুয়াডাঙ্গা আধিপত্য বিস্তার নিয়ে পূর্ববাংলা কমিউনিস্ট পার্টির (জনযুদ্ধ) ও জাসদ গণবাহিনী নামে দুইটি চরমপন্থি দলের মধ্যে বিরোধ চলে আসছে। গত শুক্রবার রাতে রামচন্দ্রপুর শ্মশানঘাট এলাকায় পূর্ব বাংলা কমিউনিস্ট পার্টির নেতাদের গোপন বৈঠকে জাসদ গণবাহিনীর সদস্যরা হামলা চালিয়ে গুলি করে তিন জনকে হত্যা করে। হঠাৎ চরমপন্থি সংগঠনগুলোর বিরোধ প্রকাশ্যে আসায় এলাকায় আতঙ্কের দানা বাঁধছে। চরমপন্থিদের উত্থান আবারও দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চল অশান্ত করে তুলতে পারে বলে শঙ্কা দেখা দিয়েছে। এলাকাবাসী বলছেন, দ্রুত কার্যকর ব্যবস্থা না নিলে নতুন করে আবারও মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে পারে চরমপন্থি সংগঠনগুলো।

এ হত্যাকান্ডের বিষয়ে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব নাসিমুল গণি বলেছেন, ঝিনাইদহ শৈলকুপায় এই তিন জন খুুনের ঘটনায় নিষিদ্ধ ঘোষিত সংগঠন চরমপন্থি দল জড়িত কি না সেটা তদন্ত চলছে। যারাই এই ঘটনা ঘটিয়েছে অচিরেই রহস্য বের করা হবে। উল্লেখ্য, গত শুক্রবার রাতে ঝিনাইদহের শৈলকুপা উপজেলার রমাচন্দ্রপুর গ্রামের শ্মশানঘাট এলাকায় তিন জনকে গুলি করে হত্যা করা হয়। নিহতরা হলেন হানিফ আলী (৫৬), তার শ্যালক লিটন (৩৫) ও রাইসুল ইসলাম রাজু (২৫)। এদের মধ্যে হানেফ আলী নিষিদ্ধ চরমপন্থি সংগঠন পূর্ববাংলা কমিউনিস্ট পার্টির (জনযুদ্ধ) আঞ্চলিক কমান্ডার। নিহত চরমপন্থি নেতা হানিফের বিরুদ্ধে কমপক্ষে ১৩টি হত্যাসহ বিভিন্ন মামলা রয়েছে।

তিন খুনের ব্যাপারে স্থানীয়রা জানান, শুক্রবার ঘটনাস্থলের কাছে রাত ৯টার দিকে তিন থেকে চারটি গুলির শব্দ শুনতে পান এলাকাবাসী। এরপর ভয়ে আর কেউ ঘর থেকে বের হয়নি। পুরো এলাকায় আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। এরপর এলাকাবাসী পুলিশকে খবর দিলে পুলিশ ঘটনাস্থলে গিয়ে তিনটি মরদেহ ও দুইটি মোটরসাইকেল পড়ে থাকতে দেখেন। তিন জনকেই মাথায় গুলি করে হত্যা করা হয়েছে। জাসদ গণবাহিনীর শীর্ষ নেতা কালুর নেতৃত্বে এই হত্যাকান্ডের ঘটনা ঘটেছে বলে ধারণা করছেন পুলিশ ও স্থানীয়রা। কালুর বাড়ি কুষ্টিয়া সদর উপজেলার পশ্চিম আব্দালপুর গ্রামে। জাসদ গণবাহিনীর কথিত নেতা কালু একটি চিরকুট লিখে এই তিন হত্যাকান্ডের দায় স্বীকার করেছেন।

ঝিনাইদহের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার ইমরান জাকারিয়া জানান, শুক্রবার রাতে প্রতিপক্ষ বন্দুকধারীরা দুই সহযোগীসহ পূর্ববাংলার কমিউনিস্ট পার্টির সামরিক কমান্ডার হানিফকে গুলি করে হত্যা করে। খবর পেয়ে রাত সাড়ে ১২টার দিকে শৈলকুপা উপজেলার ত্রিবেনী ইউনিয়নের রামচন্দ্রপুর শ্মশানঘাট এলাকার একটি ক্যানালের পাশ থেকে নিহতদের মৃতদেহ উদ্ধার করা হয়। তিন জনের মাথায় গুলির চিহ্ন রয়েছে। পাশে দুইট মোটরসাইকেল ও নিহতদের ব্যবহৃত হেলমেট পড়েছিল।

তিনি আরো বলেন, হত্যার দায় স্বীকার করে সাংবাদিকদের হোয়াস্টসআপে যে খুদে বার্তা এসেছে তা গুরুত্ব দিয়ে দেখা হচ্ছে। তিন জনকে কীভাবে ঘটনাস্থলে আনা হলো তা তদন্ত করে দেখা হচ্ছে। পুলিশ হত্যাকারীদের দ্রুত গ্রেফতারের চেষ্টা চালাচ্ছে।

কে এই হানিফ আলী: প্রায় ৫৫ বছর বয়সি হানিফ আলী, তার বাড়ি ঝিনাইদহের হরিণাকু-ু উপজেলার আহাদনগর গ্রামে, পিতার নাম রাহাজ উদ্দিন। হানিফ আলী পশ্চিমাঞ্চলের শীর্ষ চরমপন্থি সংগঠন পূর্ববাংলা কমিউনিস্ট পার্টি জনযুদ্ধ (লাল পতাকার) আঞ্চলিক কমান্ডার। ৯০-এর দশকে হত্যা ও ডাকাতির মাধ্যমে এলাকায় অপরাধজগতে একক আধিপত্য বিস্তার করে। হানিফের নামে হরিণাকু-ু, ঝিনাইদহ সদর, চুয়াডাঙ্গা, আলমডাঙ্গাসহ দেশের বিভিন্ন থানায় ১৪টি হত্যা, অপহরণ ও ডাকাতির মামলা আছে। গত সাত-আট বছর ধরে হরিণাকু-ু নারায়ণকান্দি কায়েতপাড়া বাঁওড় দখল করে মৎস্য চাষ করে আসছিল। ২০১৪ সালে জেল থেকে বের হয় হানিফ। পরে ২০১৮ সালে ঐ বাঁওড়ের মৎস্যজীবী সমিতির সভাপতি জিয়াউর রহমান জিয়াকে জবাই করে হত্যা করে বাঁওড়ের দখল নেয় হানিফ। সম্প্রতি বাঁওড় দখলকে কেন্দ্র করে এলাকার কয়েকটি নিষিদ্ধ চরমপন্থি সংগঠনের মধ্যে বিরোধ চলে আসছিল। এ কারণেই প্রতিপক্ষ জাসদ গণবাহিনী তাকে হত্যা করেছে বলে ধারণা এলাকাবাসীর। চরমপন্থি হানিফের এক ভাই হরিণাকু-ু উপজেলা ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি ও আরেক ভাই উপজেলা পরিষদের সাবেক ভাইস চেয়ারম্যান ও উপজেলা সেচ্ছাসেবক লীগের বর্তমান সহসভাপতি। হানিফ নিজে হরিণাকু-ু উপজেলা মৎস্যজীবী লীগের সিনিয়র সহসভাপতি ছিলেন ।

ঝিনাইদহ শৈলকুপায় ত্রিপল মার্ডারে নিষিদ্ধ ঘোষিত সংগঠন চরমপন্থি দল জড়িত কিনা সেটা তদন্ত চলছে বলে জানিয়েছেন স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব নাসিমুল গণি। শনিবার দুপুরে যশোর পিটিআই মিলনায়তনে দেশের পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে মানবাধিকার ও পরিবেশের ওপর গুরুত্বসহ আইন প্রয়োগ বিষয়ক কর্মশালা অনুিষ্ঠিত হয়। কর্মশালা শেষে সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে তিনি এ মন্তব্য করেন। সিনিয়র সচিব নাসিমুল গণি বলেন, ‘ঝিনাইদহের বিষয়টি নিয়ে তদন্ত চলছে। যারাই এই ঘটনা ঘটিয়েছে অচিরেই রহস্য বের করা হবে। তিনি বলেন, দেশে আইনশৃঙ্খলার যে অবস্থা ছিল, সেটা অনেক উন্নতি ঘটেছে। আরো উন্নতি ঘটাতে আমাদের চেষ্টা অব্যাহত রয়েছে। আমরা পুলিশের বিধ্বস্ত বাহিনী পেয়েছিলাম। তারা আস্তে আস্তে মাথা তুলে দাঁড়াচ্ছে। কোমর তুলে দাঁড়াচ্ছে। তাদের সঙ্গে কথা বলে তাদের মনের ভাব বুঝছি, তাদের উন্নয়ন ঘটানোর সকল উদ্যোগ নিচ্ছি। পুলিশ ম্যাজিস্ট্রেট একত্রে আমরা দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নয়ন ঘটাতে কাজ করছি। দেশে অস্থিতিশীল পরিবেশ সৃষ্টি করতে একটি গোষ্ঠী সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে অপতথ্য ছড়াচ্ছে বলে মন্তব্য করে তিনি বলেন, তিলকে তাল করে একটি গোষ্ঠী কল্পনার ফানুস উড়াচ্ছে। পুরোনো কোনো ঘটনার ছবি বা ভিডিও নতুন করে পোস্ট করে অস্থিতিশীল সৃষ্টি করছে বলেও তিনি মন্তব্য করেন।