স্টাফ রিপোর্টার: গর্ভে যমজ সন্তান রয়েছে বলে আল্ট্রাসনো রিপোর্ট দেয়া হলেও অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে প্রসব হয় একটি সন্তানের। একবার নয়, গর্ভাবস্থায় প্রসূতির তিনবার আল্ট্রাসনোগ্রাম করানো হলে প্রতিবারই যমজ সন্তানের রিপোর্ট পাওয়া যায়। অথচ প্রসূতির অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে ভূমিষ্ঠ হয় একটি সন্তান। ঘটনাটি গতকাল রোববার চুয়াডাঙ্গা সদর হাসপাতালে ঘটে। এ নিয়ে হাসপাতালজুড়ে তোলপাড় শুরু হয়েছে। প্রসূতি রজনী খাতুন চুয়াডাঙ্গা সদর উপজেলার শংকরচন্দ্র ইউনিয়নের ঠাকুরপুর গ্রামের মসজিদপাড়ার রাসেল আলীর স্ত্রী।
প্রসবের পর নবজাতক চুরির অভিযোগ তুলে প্রসূতি রজনী খাতুনের পরিবারের সদস্যরা বলেন, বেসরকারি ও সরকারি প্রতিষ্ঠান থেকে আল্ট্রাসনোগ্রাফি রিপোর্টে জানানো হয় গর্ভে দুটি সন্তানের কথা। ডেলিভারির আগে আমরা জানি আমাদের দুটি সন্তান হবে। অস্ত্রোপাচারের পর মিললো একটি সন্তান। তাহলে আমাদের নবজাতক কি চুরি হয়ে গেছে? বেসরকারি-সরকারি দুটি প্রতিষ্ঠানের রিপোর্টই কি ভুল?
তবে চুয়াডাঙ্গা সদর হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ বলছে, আল্ট্রাসনোগ্রাফির রিপোর্টে ভুল ছিলো। দুটি নয়, প্রসূতির গর্ভে বাচ্চা পাওয়া গেছে একটি। হাসপাতালের রিপোর্টে গর্ভে একটি বাচ্চার কথা উল্লেখ করা হয়েছিলো এবং সম্ভাব্য আরেকটি বাচ্চা থাকতেও পারে, এমনটি জানানো হয়েছিলো। উন্নত যন্ত্রপাতির না থাকার কারণে এমনটি ঘটেছে।
রোববার দুপুরে সরেজমিনে দেখা যায়, চুয়াডাঙ্গা সদর হাসপাতালের গাইণী ওয়ার্ডে চিকিৎসাধীন রজনী খাতুন। তার সদ্যাজাত ছেলেকে শিশু ওয়ার্ডে ভর্তি করা হয়েছে। রজনী কথা বলতে না পারলেও পাশে থাকা তার স্বজনরা বলেন, গত ৯ ফেব্রুয়ারি চুয়াডাঙ্গার জীবননগর উপজেলায় মা নার্সিং হোম অ্যান্ড ডায়াগনস্টিক সেন্টার থেকে আল্ট্রাসনোগ্রাফি করান রজনী খাতুন। সেখান থাকা উপসহকারী কমিউনিটি মেডিকেল অফিসার (সেকমো) নাজমুল স্বাক্ষরিত প্রিন্ট রিপোর্টে মন্তব্যের ঘরে জানানো হয়, ‘গর্ভে দুটি সন্তান রয়েছে’। তারা জানান, গত ৩১ মার্চ আবারও ওই প্রতিষ্ঠান থেকে আল্ট্রাসনোগ্রাফি করা হয়। সেদিন ডা. আফরোজ শারমি একই রিপোর্ট দেন। এতে রজনীর পরিবারের মাঝে আনন্দের বন্যা বয়ে আসে।
রজনী খাতুনের বাবা নবীর হোসেন বলেন, প্রসববেদনা উঠলে গত শনিবার আমার মেয়েকে চুয়াডাঙ্গা সদর হাসপাতালে ভর্তি করি। হাসপাতাল থেকে রজনীকে আল্ট্রাসনোগ্রাফি করা হলে গর্ভে যমজ দুটি সন্তান রয়েছে বলে জানায়। অথচ আজ সকালে সিজার করার পর একটি সন্তান দিচ্ছে আমাদের। তাহলে আরেকটি সন্তানের হদিস নেই কেন?
তিনি আরও বলেন, বেসরকারি ডায়াগনস্টিক সেন্টার ও সরকারি হাসপাতাল থেকে গর্ভে দুটি সন্তানের কথা জানালেও চিকিৎসক একটি সন্তান আমাদের বুঝিয়ে দিয়েছেন। তাহলে আরেকটি সন্তান কোথায়? নিশ্চয়ই চুরি হয়েছে গেছে? আমরা এর সঠিক তদন্ত চাই। আমার নাতিকে আমার কাছে ফিরিয়ে দেয়া হোক। রজনী খাতুনের স্বামী রাসেল বলেন, দুই প্রতিষ্ঠানে তিনবার আল্ট্রাসনোগ্রাফি করে একই রিপোর্ট এসেছে। বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে ভুল হলেও সদর হাসপাতালের রিপোর্ট কীভাবে ভুল হয়? আমার আরেকটি সন্তান গেল কোথায়? সকাল থেকে বিভিন্ন স্থানে ছোটাছুটি করেও কোনো সুরাহা হয়নি। তিনি আরও বলেন, বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের দুটি রিপোর্ট আমাকে বুঝিয়ে দিলেও সদর হাসপাতালের রিপোর্টটি দিচ্ছে না হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। এতেই বোঝা যাচ্ছে আমার বাচ্চাটার সঙ্গে কিছু একটা হয়েছে। আমি এ বিষয়ে প্রশাসনের দারস্থ হবো।
এদিকে জেলা স্বাস্থ্য বিভাগ জানায়, সহকারী কমিউনিটি মেডিকেল অফিসারদের (সেকমো) আল্ট্রাসনোগ্রাফি করার কোনো বৈধতা নেই। এটা সম্পূর্ণ অবৈধ। তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে।
এ বিষয়ে মা নার্সিং হোম অ্যান্ড ডায়াগনস্টিক সেন্টারে আল্ট্রাসনোগ্রাফি করা নাজমুল হক উপসহকারী কমিউনিটি মেডিকেল অফিসার (সেকমো) দাবি করে বলেন, সব জায়গাতেই আমরা আল্ট্রাসনোগ্রাফি করি। এতে অবৈধতার কী আছে? তবে ওই রোগীর রিপোর্ট প্রিন্ট করতে গিয়ে ভুল করতে পারে। এছাড়া আমারও ভুল হতে পারে। মানুষ মাত্রই ভুল করে। এ জন্য আমি দুঃখ প্রকাশ করছি।
চুয়াডাঙ্গা সদর হাসপাতালের গাইণী বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক ডা. আকলিমা খাতুন বলেন, সিজারের পর রজনী খাতুনের গর্ভে একটি ছেলেসন্তান ছিল। তিনটি আল্ট্রাসনোগ্রাফির রিপোর্টে গর্ভে দুটি সন্তানের কথা বলা হয়েছে, এমনটা নয়। বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে সরাসরি বলা হয়েছে দুটি সন্তানের কথা। আর সদর হাসপাতালের রিপোর্টে একটি বাচ্চার কথা সরাসরি বললেও সম্ভাব্য আরেকটির কথা উল্লেখ করা হয়েছে বলে জানান তিনি।
এ বিষয়ে জানতে সদর হাসপাতালের আল্ট্রাসনোগ্রাফি বিভাগে যিনি রজনী খাতুনের বিষয়টি দেখভাল করেছেন, সেই চিকিৎসক ডা. নুরজাহান খাতুন রুমি বলেন, প্রথমে গর্ভে একটি সন্তানের কথা জানিয়েছিলাম। রোগী বারবার আগের বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের রিপোর্টে দুটি বাচ্চার কথা বলা হয়েছে বলে জানায় প্রসূতির পরিবার। পরে আমি আরও ভালো করে পরীক্ষা-নিরীক্ষার করি। পরে রোগীদের বারবার বলার কারণে ‘সম্ভাব্য আরও একটি সন্তান গর্ভে থাকতে পারে’, এমনটা রিপোর্টে উল্লেখ করেছি।
চুয়াডাঙ্গা সদর হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক ডা. আতাউর রহমান বলেন, সদর হাসপাতালে যে চিকিৎসক আল্ট্রাসনোগ্রাফি করেছেন, তার সঙ্গে কথা বলে জেনেছি। তিনি একটি বাচ্চার কথাই উল্লেখ করেছেন এবং শুধু সম্ভাব্য আরেকটি থাকতে পারেন বলে জানান। এ জন্য তাকেও দোষ দেয়া যাচ্ছে না। বিষয়টি মীমাংসা করা হচ্ছে।
চুয়াডাঙ্গা সিভিল সার্জন ডা. সাজ্জাৎ হাসান বলেন, বিষয়টি আমার জানা নেই। বিস্তারিত জানতে আমি খোঁজ নিচ্ছি। ভুক্তভোগীর পরিবার অভিযোগ করলে বিষয়টি তদন্ত করে ব্যবস্থা নেবো। তিনি আরও বলেন, একজন উপসহকারী কমিউনিটি মেডিকেল অফিসার (সেকমো) কখনোই আল্ট্রাসনোগ্রাফি করতে পারবেন না। যদি করে থাকেন, তাহলে তার বিরুদ্ধে আমরা ব্যবস্থা নেবো।