স্টাফ রিপোর্টার: ‘আমার নিজের ভাই আব্দুল মানিক ও তার বন্ধুরা ছিলেন বীর মুক্তিযোদ্ধা। তাদের অস্ত্র লুকিয়ে রাখা ও সময়মতো গোপনে পৌঁছে দিতাম। মুক্তিযোদ্ধারা যখন বৈঠক করতেন, তখন আমরা তিন বোন পাহারা দিতাম। তাদের জন্য খাওয়া দাওয়ার ব্যবস্থা করতাম। রাজাকারের উপস্থিতি দেখলেই মুক্তিযোদ্ধাদের জানিয়ে দিতাম।’ চুয়াডাঙ্গা জেলা প্রশাসকের সম্মেলনকক্ষে সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে যোগ দিয়ে এভাবেই যুদ্ধদিনের বীরত্বগাথা শোনালেন নারী বীর মুক্তিযোদ্ধা মোমেনা খাতুন। মহান মুক্তিযুদ্ধে নারীরা মুক্তিযোদ্ধাদের আশ্রয় দিয়েছেন, গুপ্তচরের কাজ করেছেন, আবার অস্ত্র হাতে সম্মুখসমরেও অংশ নিয়েছেন। পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর হাতে নির্যাতিতও হয়েছেন কেউ কেউ। মঙ্গলবার চুয়াডাঙ্গা জেলার বাসিন্দা এমন সাত নারী বীর মুক্তিযোদ্ধাকে সংবর্ধনা দেয়া হয়েছে। জেলা প্রশাসনের সহযোগিতায় মহিলাবিষয়ক অধিদপ্তর চুয়াডাঙ্গা বেলা ১১টায় জেলা প্রশাসকের সম্মেলনকক্ষে এ সংবর্ধনার আয়োজন করে। অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথি জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ আমিনুল ইসলাম খান এসব বীর মুক্তিযোদ্ধার প্রত্যেকের হাতে সম্মাননা ক্রেস্ট এবং উত্তরীয় হিসেবে লাল-সবুজের শাল ও শাড়ি তুলে দেন। স্বাধীনতার ৫০ বছর পর এমন সংবর্ধনা পেয়ে মুক্তিযোদ্ধারা আবেগাপ্লুুত হয়ে পড়েন। তাদের বীরত্বগাথা ও সংগ্রামের দিনগুলোর বর্ণনা শুনে অতিথিদের চোখ জলে ভিজে যায়। সংবর্ধিত সাতজন হলেন চুয়াডাঙ্গা শহরের মাঝেরপাড়ার বাসিন্দা মৌসুফা বেগম, দামুড়হুদা উপজেলার দক্ষিণ চাঁদপুরের রাশীদুন নাহার বেগম, আলমডাঙ্গা উপজেলার কালিদাসপুর উত্তরপাড়ার মোছা. ওজিফা খাতুন, পাইকপাড়ার মোছা. রাবিয়া খাতুন, হারদী শেখপাড়ার মোছা. মোমেনা খাতুন, আলমডাঙ্গার বাবুপাড়ার দয়ারানী পরামাণিক ও ক্যানেলপাড়ার মোছা. শুকুরন নেছা। তাদের মধ্যে রাশীদুন নাহার বেগম মুক্তিযোদ্ধা সংগঠক হিসেবে নিয়ন্ত্রণকক্ষের দায়িত্বপালন এবং বাকিরা মুক্তিযোদ্ধাদের আশ্রয়, খাদ্য ও রসদ জোগাতে ভূমিকা রেখেছিলেন। অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) সাজিয়া আফরিনের সভাপতিত্বে সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে স্বাগত বক্তব্য দেন জেলা মহিলাবিষয়ক কর্মকর্তা (অতিরিক্ত দায়িত্ব) মাকসুরা জান্নাত। বিশেষ অতিথির বক্তব্য দেন অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (প্রশাসন) আবু তারেক। অনুষ্ঠানে অন্যানের মধ্যে জেলা পরিষদের মহিলা সদস্য নুরুন্নাহার কাকলী, সদর উপজেলা পরিষদের মহিলা ভাইস চেয়ারম্যান শাহাজাদী মিলি ও জাতীয় মহিলা সংস্থা চুয়াডাঙ্গার সভাপতি নাবিলা রুখছানা উপস্থিত ছিলেন।
স্মৃতিচারণা করতে গিয়ে রাশীদুন নাহার বেগম বলেন, স্বাধীনতার আগে ছাত্র ইউনিয়নের নেত্রী হিসেবে বিভিন্ন আন্দোলন-সংগ্রামে নেতৃত্ব দিয়েছেন। বঙ্গবন্ধুর ডাকে স্বামী কলেজশিক্ষক আনসার আলীর সম্মতিতে মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। তার পরিবারে দুজন নারীসহ ১০ জন মুক্তিযোদ্ধা। মুক্তিযুদ্ধকালীন দর্শনা নিয়ন্ত্রণকক্ষ (কন্ট্রোলরুম) তিনিই নিয়ন্ত্রণ করতেন। রাশীদুন নাহার বলেন, ‘একদিন বৃহত্তর কুষ্টিয়ার ছাত্র ইউনিয়ন, ন্যাপ ও কমিউনিস্ট পার্টির ৪০-৪৫ জন নেতা-কর্মী দর্শনায় এসে আমার শেল্টারে অবস্থান নেন। আমার হাতে তখন নগদ টাকা ছিলো না। নিজের গয়না বিক্রি করে এতগুলো লোকের খাওয়ার ব্যবস্থা করি। যেভাবেই হোক, পাকিস্তানি সেনারা বিষয়টি জেনে যাওয়ার পর মর্টারশেল নিক্ষেপ করে। যেভাবেই হোক, তা লক্ষ্যবস্তুতে না পৌঁছানোর কারণে সবাই সেদিন প্রাণে বেঁচে যান।’ বীর মুক্তিযোদ্ধা মৌসুফা বেগম বলেন, ‘আমরা বাংলাদেশ নামের যে সন্তান উপহার দিয়েছি, বর্তমান প্রজন্ম তাকে সঠিকভাবে লালনপালন করবেন, সেটাই চাওয়া-পাওয়া।’