চুয়াডাঙ্গা আইসোলেশনের হলুদ জোনে আরও একজনের মৃত্যু

গাংনীতে ছেলের দুশ্চিন্তায় মারা যাওয়া নারীর শরীরেও মিলেছে করোনার অস্তিত্ব : এক চিকিৎসক আক্রান্ত
স্টাফ রিপোর্টার: চুয়াডাঙ্গায় করোনা উপসর্গ নিয়ে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন আরও একজনের মৃত্যু হয়েছে। গতকাল বুধবার রাত ৮টার দিকে সদর হাসপাতালের আইসোলেশন ওয়ার্ডের হলুদ জোনে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তার মৃত্যু হয়। তিনি জ্বর, কাশি, ঠান্ডা ও শ্বাসকষ্ট নিয়ে ভর্তি হন। রাতেই স্বাস্থ্য বিধি মেনে নিজ গ্রাম দামুড়হুদার কাদিপুরে দাফন সম্পন্ন হয়েছে। এদিকে, চুয়াডাঙ্গায় নতুন করে পুলিশ সদস্য, ব্যাংক কর্মকর্তাসহ আরও ৭ জনের শরীরে করোনাভাইরাস শনাক্ত হয়েছে। জেলায় এ পর্যন্ত করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছেন ২৭৬ জন। পরীক্ষার জন্য ২০টি নতুন নমুনা প্রেরণ করা হয়েছে। গতকাল বুধবার রাতে কুষ্টিয়া মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পিসিআর ল্যাব থেকে চুয়াডাঙ্গা সিভিল সার্জন অফিসে নতুন রিপোর্ট আসে ৫০টি। অপরদিকে, সামাজিকভাবে করোনা ভাইরাস ছড়িয়ে পড়ছে প্রতিদিন। মানুষ সচেতন হয়ে সামাজিকভাবে ছড়িয়ে পড়া প্রতিরোধ করতে না পাড়লে পরিস্থিতি খারাপের দিকে যেতে থাকবে বলে মনে করে স্বাস্থ্য বিভাগ। এছাড়া, দর্শনার রেড জোন হিসেবে চিহ্নিত পৌর এলাকার ৫ নং ওয়ার্ডের পরাণপুর গ্রামের রিফিউজি কলোনী ও ৭ নং ওয়ার্ডের থানাপাড়া এলাকায় সাধারণ ছুটি শেষ হয়েছে। গত ১৭ জুন রেড জোন হিসেবে ঘোষণা করা হয় ওই এলাকাগুলো। পরে ২১ জুন থেকে ৮ জুলাই পর্যন্ত সেখানে ২১ দিনের সাধারণ ছুটি ঘোষণা করে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়। মেহেরপুরের গাংনীতে করোনা আক্রান্ত ছেলের দুশ্চিন্তায় মারা যাওয়া ওই বৃদ্ধা নারীর শরীরেও করোনাভাইরাসের অস্তিÍত্ব পাওয়া গেছে বলে জানিয়েছে স্বাস্থ্য বিভাগ। গতকাল মেহেরপুরে নতুন করে এক চিকিৎসক কোভিড-১৯ পজিটিভ হয়েছেন।
চুয়াডাঙ্গা সদর হাসপাতালের অবাসিক মেডিকেল অফিসার ডা. শামীম কবির বলেন, গত মঙ্গলবার বেলা ১২টার দিকে দামুড়হুদা উপজেলার কাদিপুর গ্রামের গাঙপাড়ার মৃত শুকুর আলীর ছেলে জমসেদ আলী (৬৭) করোনা উপসর্গ নিয়ে সদর হাসপাতালের আইসোলেশন ওয়ার্ডের হলুদ জোনে ভর্তি হন। তিনি জ্বর, শ্বাসকষ্ট, কাশি ও ঠান্ডায় ভুগছিলেন। বুধবার সকালে তার নমুনা সংগ্রহ করা হয়। বিকাল থেকে তার অবস্থার অবনতি হয়। রাত ৮টার দিকে সদর হাসপাতালের আইসোলেশন ওয়ার্ডের হলুদ জোনে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যায়। হাসপাতাল থেকে স্বাস্থ্যবিধি মেনে লাশ গ্রামে নেয়া হয়। রাতে গ্রামের কবর স্থানে দাফন কার্য সম্পর্ণ করা হয়। তার করোনা পরীক্ষার রিপোর্ট এলে বোঝা যাবে পজিটিভ না নেগেটিভ।
সিভিল সার্জন অফিস সূত্রে জানা যায়, বুধবার রাতে চুয়াডাঙ্গা সিভিল সার্জন অফিসে নতুন ৫০টি রিপোর্ট আসে। এর মধ্যে ৭ জনের শরীরে করোনা ভাইরাস শনাক্ত হয়েছে। তার মধ্যে চুয়াডাঙ্গা সদর উপজেলায় ৩ জন, আলমডাঙ্গা উপজেলায় ২ জন, দামুড়হুদার দর্শনায় ১ জন ও জীবননগর উপজেলায় ১ জন। চুয়াডাঙ্গা সদর হাসপাতালের একজন স্বেচ্ছাসেবকের শরীরে করোনা ভাইরাস পজিটিভ হয় ৬ জুলাই। তার সংস্পর্শে আসা ৬ জনের নমুনা নেয়া হয় মঙ্গলবার সকালে। তাদের মধ্যে দুইজনের করোনা পজিটিভ হয়। শহরের কানাপুকুর পাড়া ও কুন্দিপুর গ্রামে নিজ বাড়িতে রয়েছেন তারা। চুয়াডাঙ্গা পুলিশ লাইনের একজন কনেস্টেবল করোনা পজিটিভ হয়েছেন। তিনি বর্তমানে ভাড়াবাড়িতে রয়েছেন। এ পর্যন্ত জেলায় ৩১ জন পুলিশ সদস্য করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছেন। সুস্থ হয়েছেন ৩০ জন। আলমডাঙ্গা উপজেলার এরশাদপুর গ্রামের একজন ৭৫ বছর বয়সীর অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক করোনা পজিটিভ হয়েছেন। তিনি আলমডাঙ্গা কাচারি বাজারে ব্যবসা করেন। তিনি নিজ বাড়িতে রয়েছেন। চুয়াডাঙ্গা ইসলামী ব্যাংক লিমিটেড শাখার একজন জুনিয়র অফিসার করোনা আক্রান্ত হয়েছেন। বেশকয়েক দিন ধরে জ্বরে আক্রান্ত ছিলেন। তিনি বর্তমানে আলমডাঙ্গা শহরের একচেঞ্জপাড়ায় রয়েছেন। ইসলামী ব্যাংক লিমিটেড চুয়াডাঙ্গা শাখার ২ জন সদস্য করোনা পজিটিভ হয়েছে। জীবননগর পৌরসভার একজন টিকাদানকারী নারী কর্মী করোনা পজিটিভ হয়েছেন। তিনি নিজ বাড়ি হাসাদাহ তারিনিবাস গ্রামের বাড়িতে রয়েছেন। দামুড়হুদা দর্শনা কেরুজপাড়ার ৭ বছর বয়সী এক কন্যা শিশু করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছে। শিশুর মা ও বাবা ৫ জুলাই করোনা পজিটিভ হন। তারা নিজ বাড়িতে থেকে চিকিৎসা নিচ্ছেন।
চুয়াডাঙ্গায় এ পর্যন্ত করোনা পজিটিভ হয়েছেন ২৭৬ জন। নতুন সুস্থ হয়েছেন ৫ জন। এ পর্যন্ত ১৭৪ জন সুস্থ হয়েছেন। নতুন নমুনা প্রেরণ করা হয়েছে ২০টি। জেলায় এ পর্যন্ত নমুনা সংগ্রহ করা হয়েছে ২৩৬৯ জনের। রিপোর্ট এসেছে ২২৪৮ জনের। করোনা আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন ৩ জন। সদর হাসপাতালের আইসোলেশন ওয়ার্ডে রয়েছে ১৫ জন ও হোস আইসোলেশনে রয়েছে ৮২ জন।
চুয়াডাঙ্গা স্বাস্থ্য বিভাগ ও জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে সবাইকে স্বাস্থ্য বিধি মেনে চলতে হবে। মাস্ক ব্যবহার সবার জন্য বাধ্যতামূলক। আর সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখতে হবে। কাজ ছাড়া কেউ যেনো ঘরের বাইরে অযথা বের না হয়। কারণ জেলায় সামাজিকভাবে ছড়িয়ে পড়েছে করোনা ভাইরাস। সচেতনতা ছাড়া করোনা ভাইরাস প্রতিরোধ সম্ভব নয়।
গাংনী প্রতিনিধি জানিয়েছেন, মেহেরপুরের গাংনী পশু হাসপাতালপাড়ার মৃত্যুবরণকারী বৃদ্ধা জোবাইদা খাতুন করোনাভাইরাস আক্রান্ত ছিলেন। গতকাল বুধবার তার নমুনা পরীক্ষায় করোনা শনাক্ত হয়েছে বলে জানিয়েছেন সিভিল সার্জন। এর আগে ওই বৃদ্ধার পরিবারের ৩ জন কোভিড-১৯ পজেটিভ হয়েছেন। এছাড়াও গতকাল ২৪টি নমুনা পরীক্ষায় মেহেরপুর জেনারেল হাসপাতালের এক মে মেডিকেল অফিসার করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছেন। এ নিয়ে জেলায় মোট আক্রান্তের সংখ্যা ৯৭। সুস্থ হয়েছেন ৩৮ জন আর মৃতের সংখ্যা ৬।
জানা গেছে, গাংনী পশু হাসপাতাল পাড়ার মৃত আব্দুল গনির স্ত্রী জোবাইদা খাতুন (৭০) মঙ্গলবার সকাল দশটার দিকে হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে নিজ বাড়িতে মৃত্যুবরণ করেন। করোনা আক্রান্ত ছেলের দুঃশ্চিন্তায় তিনি হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন বলে দাবি করেন তার ছেলেরা। তবে মৃত্যুর আগে করোনাভাইরাস উপসর্গ থাকা এবং তার পরিবারের তিনজন সদস্য আক্রান্ত থাকায় নমুনা সংগ্রহ করে স্বাস্থ্য বিভাগ। যদিও ওই বৃদ্ধা আগে থেকেই হৃদরোগে ভুগছিলেন। মরদেহ বিশেষ ব্যবস্থায় দাফন করা হয়।
স্বাস্থ্য বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, গত ৩ জুন ওই বৃদ্ধার বড় ছেলের স্ত্রী করোনা ভাইরাস আক্রান্ত হন। যিনি একজন স্বাস্থ্য সহকারী। তার বাড়ি লকডাউন করে পরিবারের লোকজনের নমুনা সংগ্রহ করে স্বাস্থ্য বিভাগ। নমুনা পরীক্ষায় বৃদ্ধার মেঝ ছেলে ও বড় ছেলের মেয়ে কোভিড-১৯ পজিটিভ হয়। শারীরিক অবস্থা খারাপ থাকায় সেজ ছেলেকে ওই দিন রাতেই মেহেরপুর জেনারেল হাসপাতাল করোনা ইউনিটে ভর্তি করা হয়। আক্রান্ত অপর দুজন বাড়িতে রুম আইসোলেশনে রয়েছেন।
পরিবারের সদস্যদের নমুনা নেয়ার সময় ওই বৃদ্ধার নমুনা নিতে চেয়েছিলেন স্বাস্থ্যকর্মীরা। কিন্তু পরিবারের লোকজনের জোর আপত্তি এবং বাধার কারণে সেটি সম্ভব হয়নি। কোনোমতেই নমুনা সংগ্রহ করতে দেননি তার ছেলেরা। এনিয়ে স্বাস্থ্য বিভাগের কর্মকর্তারা অসন্তোষ প্রকাশ করেন। বৃদ্ধার মৃত্যুর পরে আফসোস প্রকাশ করেন তারা। নমুনা সংগ্রহ পজেটিভ হলে তার চিকিৎসার সুব্যবস্থা করা যেত বলে মন্তব্য চিকিৎসকদের।
এদিকে, এই বুধবার রাত দশটা পূর্ব ২৪ ঘন্টায় মেহেরপুর জেলার ২৪টি নমুনা পরীক্ষার রিপোর্ট পেয়েছেন সিভিল সার্জন। এরমধ্যে মৃত ওই বৃদ্ধা এবং মেহেরপুর জেনারেল হাসপাতালে কর্মরত একজন মেডিকেল অফিসার কোভিড-১৯ পজিটিভ। বাকিগুলো নেগেটিভ বলে জানিয়েছেন সিভিল সার্জন।

Comments (0)
Add Comment