গাংনীতে যুবদল নেতাকে কুপিয়ে গলাকেটে হত্যা

প্রযুক্তির সহায়তায় হত্যাকান্ডের রহস্য উন্মোচনের পথে

মাজেদুল হক মানিক: মেহেরপুরের গাংনীতে নিখোঁজ হওয়ার ১২ ঘণ্টা পর আলমগীর হোসেন (৩২) নামের এক যুবদল নেতার মরদেহ উদ্ধার করেছে পুলিশ। তাকে কুপিয়ে গলাকেটে নৃশংসভাবে হত্যা করা হয়েছে। গতকাল বৃহস্পতিবার সকালে সহড়বাড়ীয়া-কামারখালী মাঠ থেকে গলাকাটা অবস্থায় তার মরদেহ উদ্ধার করে গাংনী থানা পুলিশ। মরদেহের পাশ থেকে খুনের কারণ লেখা সম্বলিত হাতে লেখা একটি চিরকুট পাওয়া যায়।
নিহত আলমগীর হোসেন গাংনী পৌরসভার ১নং ওয়ার্ড যুবদলের সভাপতি। তিনি বাঁশবাড়ীয়া গ্রামের মহিউদ্দীন শেখের ছেলে। বুধবার সন্ধ্যায় বাড়ি থেকে গাংনীর উদ্দেশ্যে বের হলেও ফিরেছে লাশ হয়ে। পরিবারের লোকজন অনেক খোঁজাখুঁজি করেও তার সন্ধান পায়নি।
স্থানীয় ও পুলিশ সুত্রে জানা গেছে, সহড়াবাড়ীয়া-কামারখালী মাঠের মধ্যে একটি বাবলা গাছের সাথে রসি দিয়ে বাঁধা অবস্থায় অজ্ঞাত এক ব্যক্তির মরদেহের সন্ধান পান স্থানীয়রা। উপুড় হয়ে পড়ে থাকায় পরিচয় শনাক্ত করতে পারছিলেন না স্থানীয়রা। পরে তার স্বজনরা গিয়ে পরিচয় শনাক্ত করেন। তার শরীরের বিভিন্ন স্থানে ধারালো অস্ত্রের আঘাতের ক্ষত রয়েছে। এছাড়াও গলা কাটা অবস্থায় পাওয়া যায়।
স্থানীয়রা জানান, গাংনী পৌরসভার বাঁশবাড়ীয়া গ্রামে আলমগীরের বাড়ি থেকে মরদেহ উদ্ধারের দূরত্ব আনুমানিক ১০-১২ কিলোমিটার। সন্ধ্যায় নিখোঁজ হওয়ার পর সকালে তার মরদেহ সেখান থেকে উদ্ধার হচ্ছে। খুনের বিষয়টি অবশ্যই রহস্যজনক। তবে খুনি যে হোক এটা যে পরিকল্পিত ঘটনা তা বলার অপেক্ষা রাখে না বলে মন্তব্য করেছেন প্রত্যক্ষদর্শীদের অনেকে।
এদিকে আলমগীরের শরীরে আঘাতের যে পরিমাণ ক্ষত ছিল সেই পরিমাণ রক্ত ঘটনাস্থলে ছিলো না বলে মন্তব্য করেন প্রত্যক্ষদর্শী অনেকে। তবে কী অন্য কোথাও হত্যা করে মরদেহ মাঠে ফেলে রাখা হয়েছে? এমন প্রশ্ন ছিল জনমনে। র‌্যাব-পুলিশের তদন্তে এসব প্রশ্নের উত্তর মিলবে সে অপেক্ষায় রয়েছেন নিহতের স্বজন ও এলাকাবাসী।
চিরকুট উদ্ধার:
মরদেহের পাশেই পড়ে ছিল সাদা কাগজের উপরে হাতে লেখা একটি চিরকুট। চিরকুটে অজ্ঞাত এক নারীর বরাতে লেখা- ৫ বছর পরকীয়া প্রেম আর শারীরিক সম্পর্ক করে বিয়ে না করার প্রতিশোধ হিসেবে তাকে হত্যা করা হয়েছে। তবে প্রকৃত ঘটনা প্রেম পরকীয়া না হত্যাকা-ের বিষয়টি ভিন্নখাতে প্রবাহিত করার জন্য এই চিরকুট তা খতিয়ে দেখছে পুলিশ।
হাতে লেখা চিরকুট দেখে প্রত্যক্ষদর্শীদের ভিন্ন মত লক্ষ্যনীয় ছিল। কেউ চিরকুটের লেখা বিশ^াস করেছেন। আবার কেউ কেউ বলেছেন খুনের মোড় অন্যদিকে ঘুরানোর জন্যও এটা হতে পারে। তবে হত্যাকা-ের সাথে কারা জড়িত থাকতে পারে সে বিষয়ে সুস্পষ্টভাবে কিছুই বুঝতে পারছে না তার পরিবারও স্বজনরা।
নিহতের ভাই আলামিন হোসেন জানান, মাস দেড়েক আগে দুবাই থেকে বাড়ি ফিরে আসে আলমগীর হোসেন। বুধবার সন্ধ্যায় বাড়ি থেকে স্বাভাবিকভাবেই বের হয়। রাতে বাড়ি না ফেরায় পরিবারের লোকজন তার খোঁজাখুঁজি করেও সন্ধান পাইনি। মোবাইল ফোন বন্ধ থাকায় পরিবারের সদস্যদের মনে ছিল আসন্ন বিপদের অশনি সংকেত। সকালে মরদেহ উদ্ধারের খবর পেয়ে সেখানে যায় পরিবারের লোকজন।
যুবদলের প্রতিবাদ:
এদিকে হত্যাকা-ের তীব্র প্রতিবাদ জানিয়ে গাংনী শহরে গতকাল দুপুরে বিক্ষোভ মিছিল করেছে পৌর যুবদল। এছাড়াও কেন্দ্রীয় যুবদল থেকে প্রেস বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে প্রতিবাদ জানানো হয়েছে। বিকেলে বিএনপির জনসভা থেকে খুনীদের গ্রেফতারে আল্টিমেটাম দেয়া হয়েছে।
গাংনী থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) বানি ইসরাইল জানান, মরদেহ উদ্ধার করে ময়নাতদন্তের জন্য মর্গে পাঠানো হয়। ময়নাতদন্ত শেষে গতকাল রাত সাড়ে ৮টার দিকে গ্রাম তার জানাজা শেষ দাফন সম্পন্ন হয়েছে।
নিহতের পারিবারিক পরিচয় :
আলমগীর হোসেন বাঁশবাড়ীয়া গ্রামের মহিউদ্দীন শেখের চার ছেলে মেয়ের মধ্যে আলমগীর হোসেন মেজ। ১০-১২ বছর আগে আলমগীর হোসেন ঢাকার দিকে প্রথম বিয়ে করেন। দাম্পত্য জীবনে বিচ্ছেদ হয়। এ পক্ষে এক মেয়ে রয়েছে। প্রথম বিয়ে বিচ্ছেদের ২ বছর পর বছর পাঁচেক আগে সাহারবাটি গ্রামে দ্বিতীয় বিয়ে করেন তিনি। দাম্পত্য জীবনে ১৭ মাস বয়সী এক কন্যা সন্তান রয়েছেন। দুপক্ষের দুই কন্যাই আলমগীর হোসেনের পরিবারের রয়েছে। বর্তমান স্ত্রীর সাথে ছিলো না কোন দাম্পত্য কলহ। পূর্বের স্ত্রী অন্য জায়গায় বিয়ে করায় ছিল না কোন বিরোধ। পরকীয়ার কোন বিষয়ও নেই বলে নিশ্চিত করেছেন তার স্ত্রী। অন্যদিকে রাজনৈতিক কিংবা সামাজিকভাবেও তার সাথে কারও দৃশ্যমান বিরোধ নেই। কর্মের টানে দুই বছর দুবাই থাকার পর মাস দেড়েক আগে বাড়ি ফিরে এসেছেন। স্বাভাবিকভাবেই যুবদলের রাজনীতিতে সক্রিয় আছেন তিনি। পরিচিত কয়েকজনের সাথেই তার সারাদিনের স্বাভাবিক চলাফেরা ছিল। তাই হত্যাকা-ের বিষয়ে কোন প্রকার সন্দেহ করতে পারছেন না তার পরিবারের সদস্যরা।
র‌্যাব-পুলিশের ব্যাপক তৎপরতা:
মরদেহ উদ্ধারের পর থেকেই জেলা পুলিশের সাইবার ক্রাইম ইনভেস্টিগেশন সেল, গাংনী থানা ও র‌্যাব-১২ গাংনী ক্যাম্পের পৃথক দল ব্যাপক তৎপরতা শুরু করে। ক্লুলেস হত্যাকা-ের রহস্য উন্মোচনে তথ্য প্রযুক্তির সর্বোচ্চ সহযোগিতা গ্রহণ শুরু হয়। যেহেতু ঘটনাস্থল বা পরিবার থেকে কোন প্রকার ক্লু মেলেনি তাই র‌্যাব পুলিশ সদস্যদের পড়তে হয় বিপাকে। তবে তথ্য প্রযুক্তির কল্যাণে গতকাল বিকেলে সন্দেহভাজন কয়েকজনকে হেফাজতে নেয় র‌্যাব। তথ্য গ্রহণের জন্য নিহতের স্ত্রী ও পরিবারের লোকজনকেও নানা প্রকার জিজ্ঞাসা করা হয়। শেষ খবর পাওয়া পর্যন্ত হত্যাকা-ের রহস্য উন্মোচন ও হত্যাকা-ের সাথে জড়িতরা আটক হবে বলে জানা গেছে। অন্যদিকে হত্যাকা-ের মামলা প্রক্রিয়াও চলমান রয়েছে বলেও জানায় পুলিশ।