স্টাফ রিপোর্টার: দুই দফায় প্রতিশ্রুতি রাখতে পারেনি জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড (এনসিটিবি)। এখনো প্রায় ৩ কোটি পাঠ্যবই ছাপানোই হয়নি। ছাপানো শেষ হলেও বাঁধাই, মান যাচাই ও অনুমোদনের অপেক্ষায় আছে আরো ৩ কোটি বই। অনেক শিক্ষার্থী পেয়েছে আংশিক বই। চলছে শিক্ষাবর্ষের তৃতীয় মাস। নতুন শ্রেণির সব বই না পাওয়ায় শিক্ষার্থী ও অভিভাবকরা এমনিতেই দিশেহারা। তার ওপর বই না দিয়েই সব বইয়ের পড়া দিয়ে পবিত্র রমজান, ঈদুল ফিতরসহ কয়েকটি ছুটি মিলিয়ে গত ২৮ ফেব্রুয়ারি থেকে টানা ৪০ দিনের ছুটিতে গেছে স্কুলগুলো। এতে অস্বস্তিতে পড়েছেন শিক্ষার্থী-অভিভাবকরা। এনসিটিবি প্রথমে গত জানুয়ারি মাসের মধ্যে সব পাঠ্যবই সরবরাহ করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল। পরে শিক্ষা মন্ত্রণালয় এবং এনসিটিবি শীর্ষ পর্যায়ের ব্যক্তি থেকে শুরু করে সরকারের বিভিন্ন পর্যায়ের ব্যক্তিরা বলেছিলেন, ফেব্রুয়ারি মাসের মধ্যে সব বই পাবে শিক্ষার্থীরা। শেষ পর্যন্ত সেই প্রতিশ্রুতিও রক্ষা হলো না। বাস্তবতা বলছে, আসন্ন ঈদের আগে সব শিক্ষার্থীর হাতে সব বই দেয়া সম্ভব হবে না। বই পেতে যতই দেরি হচ্ছে, শিক্ষার্থীদের পড়াশোনার ক্ষতিও ততই বাড়ছে। যেহেতু শিক্ষার্থীদের হাতে বই দিতে শিক্ষাবর্ষের তিন মাসের বেশি সময় লেগে যাচ্ছে, তাই শিক্ষাপঞ্জিতে পরিবর্তন এনে বিশেষ সিলেবাস করার পরামর্শ দিয়েছেন শিক্ষাবিদরা। রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পরিপ্রেক্ষিতে এবার শিক্ষাক্রম পরিবর্তন করে পুরোনো শিক্ষাক্রমের আলোকে পাঠ্যবই ছাপিয়ে বিতরণ করা হচ্ছে। মূলত দরপত্র, অনুমোদন, চুক্তির মতো কাজগুলোও যথাসময়ে না করায় এবং কাগজ সংকটের কারণে আরো বেশি দেরি হচ্ছে। জানা গেছে, সব পাঠ্যবই ছাপাতে প্রায় এক লাখ টন কাগজের প্রয়োজন হয়। গত ডিসেম্বর থেকে কোনো কারণ ছাড়াই দেশে কাগজের মিল-মালিকরা টনপ্রতি কাগজের দাম বাড়িয়েছে ৩০ হাজার টাকা। এ কারণে মুদ্রণকারীরা চীন থেকে কাগজ আমদানি করছেন। কিন্তু এখনো সব কাগজ পাওয়া যায়নি। আমদানিতে সময় লাগছে। এ রকম অবস্থায় মুদ্রণকারীরা দেশীয় মিল-মালিকদের থেকে কাগজ কিনতে চাচ্ছেন না। কারণ এতে তাদের লোকসান হবে। এনসিটিবি সূত্রে জানা গেছে, চলতি শিক্ষাবর্ষে ৪ কোটির মতো শিক্ষার্থীর জন্য প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরের সাড়ে ৩৯ কোটির বেশি বই ছাপানো হচ্ছে। মাধ্যমিকে (মাদরাসার ইবতেদায়িসহ) মোট বইয়ের সংখ্যা প্রায় ৩০ কোটি ৪০ লাখ। এর মধ্যে ৩ মার্চ পর্যন্ত মাধ্যমিকের ২৭ কোটি ৯০ লাখ ৯০ হাজার বই ছাপা হয়েছে। তবে উপজেলা পর্যায়ে সরবরাহের অনুমোদন (পিডিআই) দেয়া হয়েছে ২৪ কোটি ১৭ লাখ ৭২ হাজারের মতো পাঠ্যবই। এই হিসাবে ৬ কোটি ২২ লাখ ২৮ হাজারের মতো পাঠ্যবই এখনো সরবরাহই করতে পারেনি এনসিটিবি। প্রাথমিকের মোট পাঠ্যবই ৯ কোটি ১৯ লাখ ৫৪ হাজারের মতো। এর মধ্যে ৯ কোটি ৩ লাখ ৪৪ হাজারের মতো বই সরবরাহের ছাড়পত্র দেয়া হয়েছে। এখনো ১৬ লাখের মতো বই সরবরাহ হয়নি। এই ব্যাপারে এনসিটিবির চেয়ারম্যান অধ্যাপক এ কে এম রিয়াজুল হাসানের মোবাইল ফোনে গতকাল যোগাযোগ করেও পাওয়া যায়নি। তবে এনসিটিবির একজন সদস্য গতকাল বলেন, বিদ্যালয় ছুটি হলেও শিক্ষার্থীদের হাতে বই দেয়া যাবে। তারা উপজেলা পর্যায়ে বই পাঠাচ্ছেন। সেখান থেকে বিদ্যালয়ের শিক্ষকেরা বই সংগ্রহ করে তা শিক্ষার্থীদের মধ্যে বিতরণ করবেন। তিনি বলেন, ইতিমধ্যে মুদ্রণকারীদের নির্ধারিত সময় শেষ হয়ে গেছে। তাই যারা পূর্ণ ও আংশিক সহযোগিতা করেছে, তাদের বিষয়ে একরকম ব্যবস্থা এবং যারা অসহযোগিতা করছে, তাদের বিষয়ে আরেক রকম ব্যবস্থা নেয়া হবে। ৩০০ কোটি টাকা হাতিয়ে নেওয়া কাগজের মিল-মালিকরা ধরাছোঁয়ার বাইরে: এবার পাঠ্যপুস্তক মুদ্রণের জন্য ১১৬টি ছাপাখানা এনসিটিবির কাছ থেকে কার্যাদেশ পায়। এর মধ্যে ৩৩টি মুদ্রণপ্রতিষ্ঠান সঠিক সময়ে পাঠ্যবই দিতে পেরেছে। তাদের মধ্যে সবার আগে পাঠ্যবই বুঝিয়ে দিতে পারা প্রিন্ট মাস্টার প্রিন্টিং এন্ড প্যাকেজিং লিমিটেড স্বত্বাধিকারী মো. শহিদুল ইসলাম বলেন, অধিক মূল্যে কাগজ ক্রয় করে তাকে পাঠ্যবই ছাপাতে হয়েছে। এ কারণে এবার ব্যবসা হয়নি। তবে শিক্ষার্থীদের হাতে সঠিক সময়ে বই দিতে পেরে তিনি খুশি। ভবিষ্যতে এই ধারা অব্যাহত রাখার অঙ্গিকার করেন তিনি। মো. শহিদুল ইসলাম এবার ১ কোটি ৬৮ লাখ পাঠ্যবই ছাপার কাজ পান। এদিকে অপেক্ষাকৃত ছোট ছাপাখানাগুলো পড়েছে মহাবিপদে। বেশি মূল্যে কাগজ কিনে বই ছাপানোর সক্ষমতা তাদের নেই। ‘৩০০ কোটি টাকা হাতিয়ে নিতে কাগজের কৃত্রিম সংকট!’ শিরোনামে গত ২৬ জানুয়ারি দৈনিক ইত্তেফাকে একটি প্রতিবেদন ছাপা হয়েছিল। বিশেষ সিলেবাসে ঘাটতি পূরণ সম্ভব :ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের দুই জন অধ্যাপক ইত্তেফাককে বলেন, ‘বিশেষ পরিস্থিতি বা যে কোনো কারণে এবার পাঠ্যবই উপযুক্ত সময়ে দেয়াটা সম্ভব হয়নি। সেক্ষেত্রে শিক্ষাপঞ্জিতে পরিবর্তন আনা প্রয়োজন। পাশাপাশি বিশেষ সিলেবাস করা উচিত। যে সিলেবাস অনুসারে পড়ানো হলে মৌলিক বিষয়গুলো শিক্ষার্থীদের পাঠ্য থেকে কোনোভাবেই বাদ যাবে না। বিপাকে শিক্ষকরাও : দুটি স্কুলের পাঁচ জন শিক্ষক নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, পড়ালেখা নিয়ে এবার খুব এলোমেলো অবস্থা। বই না থাকলে শিক্ষার্থীদের পড়ানো খুবই কষ্টসাধ্য। ছুটিতে পড়ালেখা নিয়ে ‘মাথাব্যথা’ নেই মাউশির: এবার বই হাতে পেতে দেরি হওয়ায় রমজানের ১৫-২০ তারিখ পর্যন্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলা রেখে ক্লাস নেয়ার দাবি তুলেছিল অভিভাবক ঐক্য ফোরাম। তাদের সেই দাবি নিয়ে কোনো আলোচনায় করেনি শিক্ষা মন্ত্রণালয়। এমনকি বই ছাড়া ছুটিতে শিক্ষার্থীরা কীভাবে পড়বে, তা নিয়েও মাউশি, মাদ্রাসা ও কারিগরি শিক্ষা অধিদপ্তরের কোনো মাথাব্যথা নেই। মাউশির মাধ্যমিক শাখার সংশ্লিষ্ট একজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করে বলেন, ছুটিতে ছাত্রছাত্রীদের পড়ালেখা নিয়ে বিশেষ নির্দেশনার একটি আলোচনা আমরা তুলেছিলাম। কিন্তু মাউশির ডিজি পদ নিয়ে টানাপোড়েন চলায় তা এজেন্ডায় আর থাকেনি। তাছাড়া যেহেতু শিক্ষার্থীদের হাতে বই নেই, তাই স্কুল খোলা রেখেও লাভ নেই বলে মনে করে শিক্ষা মন্ত্রণালয়।