মেহেরপুর প্রতিনিধি;
বদি ও তার ছেলে সোনা ডাকাতের নামের ভয় দেখিয়ে এক সময় কোলের শিশুটিকে ঘুম পাড়াতেন তার মা। দুধর্ষ ডাকাতদের কথা মনে পড়লেই আতকে উঠতেন মানুষ। ভারতীয় সীমান্তের এপার-ওপারের গ্রামগুলোতে বোমা আর অস্ত্রের মহড়া দিয়ে ডাকাতি ছিল যাদের একমাত্র পেশা। পিতা বদির উত্তরসুরী হিসেবে ছেলে সোনা ডাকাতও ছিলেন মুর্তিমান আতংক। বংশ পরমপরায় ‘ডাকাতি’ পেশা হয়ে উঠলেও সোনা ডাকাতের সাত ছেলের কেউ ই অপরাধ জগতে প্রবেশ করেননি। ডাকাত পরিবারের নাম ঘুচিয়ে আজ তারা সমাজে প্রতিষ্ঠিত হয়ে অনন্য অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন।
মেহেরপুর গাংনী উপজেলার কাজিপুর গ্রামের সোনা ডাকাতের দুই স্ত্রীর সাত ছেলেই পরিশ্রম আর মেধা দিয়ে পূর্বসুরীদের পরিচয় ঘুচিয়ে দিয়েছেন।
জানা গেছে, বদি ও তার ছেলে সোনা ডাকাতের লোমহর্ষক কাহীনি সবার মুখে মুখে ছিল স্বাধীনের আগে থেকেই। শুধু দেশেই নয় ডাকাতি করতেন প¦ার্শবর্তি দেশ ভারতেও। যদিও ১৯৬৮ সালে ভারতে ডাকাতি করতে গিয়ে নিহত হন বদি। তারপরও তার ছেলে সোনা ডাকাত ছাড়েননি বাবার পথ। সাধরণ মানুষের কাছে মূর্তমান আতঙ্ক হয়ে ধরা দেয় সে। সম্পদশালী কোন পরিবার সোনা ডাকাতের ডাকাতির নজর থেকে রেহাই পাইনি। বোমা তৈরী করতে গিয়ে ডান হাতের কব্জি পর্যন্ত উড়ে গেলেও ডাকাতি থামেনি। ওই হাতের ছুরি বেঁধে ডাকাতি করতেন। খেলতেন হা-ডু-ডু। ১৯৮৭ সালের দিকে কাজিপুর সীমান্তে তখনকার সময়ে স্থানীয় মানুষ ও বিজিবির সাথে ভারতীয় বিএসএফ’র সংঘর্ষ শুরু হয়। সেখানে সোনা ডাকাত একই তিন বিএসএফকে কুপিয়ে হত্যা করেছিল বলে জনশ্রুতি রয়েছে।
সোনা ডাকাত শারীরিকভাবে যেমনি ছিলেন শক্তিশালী তেমনি ছিল তার সাঙ্গপাঙ্গ। ১৯৮৯ সালে গাংনী থানা পুলিশ তাকে গ্রেফতার করে মেহেরপুরে পাঠায়। কয়েকজন কনস্টেবল বাসযোগে তাকে মেহেরপুর নিয়ে যাওয়ার সময় দিন দুপুরে তার শিষ্যরা মদনাডাঙ্গায় বাস থাকায়। পুলিশকে মারধর করে ছিনিয়ে নেয় সোনা ডাকাতকে। ১৯৯২ সালে অভ্যন্তরীণ কোন্দলে করমদি গ্রামে সোনাকে হত্যা করে মরদেহ সীমান্ত এলাকায় ফেলে রাখে তার শিষ্যরা। তারপর থেকেই অভাব অনটনের বিরুদ্ধে প্রতিনয়তই সংগ্রাম করতে হয়েছে তার দুই স্ত্রীকে। ছোট ছোট বাচ্চাদের মুখের খাবার জোগাড় করতে গিয়ে নামতে হয় এক অসম যুদ্ধে। এর মধ্য দিয়েই সন্তানদের সমাজে মাথা উচু করে বাঁচার স্বপ্ন দেখিয়েছিলেন মা।
মা সোহাগী খাতুন জানান, ২০০০ সালে নিজেদের এক টুকরো জমি বিক্রি করে বড় ছেলে কালুকে পাঠান সৌদি আরবে। তার কয়েক বছর পরই সৌদিতে নিয়ে যান তার আরোও দুই ভাই রবি, কাবেল ও শিপনকে। আর এক ভাই জাহিদ আছেন বাহারাইনে। ছোট ভাই হাবিবুর রহমান করছেন সরকারী চাকুরী। আরেক ভাই সুমন চালান অটোরিক্সা। সবাই দাড়িয়েছেন নিজের পায়ে। কিনেছেন জমি। করেছেন গাড়ি বাড়ি।
সোনা ডাকাতের ছেলে শিপন জানান, মা সব সময় উপদেশ সৎ পথে কিছু করার। যে কোনভাবেই ঘোচাতে হবে বাবার খারাপ নাম। কারণ বাবা ডাকাত হওয়ায় অনেকের কাছে কটু কথা শুনতে হয়েছে তাদের। বন্দি ছিলেন অভাবের সংসারে। কোনদিন বিছানাই শান্তির ঘুম ঘুামাতে পারেননি। সব সময় আতঙ্কে থাকতে হয়েছে তাদের। তবে এখন সমাজের সবাই তাদের সম্মান করেন।
আরেক ভাই হাবিবুর রহমান জানান, ছোট একটি সরকারি চাকুরি করেন তিনি। সেখান থেকে তার সংসার ভালই চলছে। পরিশ্র করে বাবার খারাপ নাম ঘোচাতে সক্ষম হয়েছেন সবাই। এখন সমাজের বুকে মাথা উচু করে বসবাস করছেন।
এলাকার ইউপি সদস্য খবির উদ্দীন জানান, বাবা ও দাদা ডাকাত থাকার কারণে সমাজের চোখে ঘৃনিত ছিলেন পুরো পরিবার। পুলিশের কারণে বেশিরভাগ সময়ই পরিবারের সদস্যদের রাত কাটাতে হতো অন্যের বাড়িতে। এখন সেই সন্তানেরাই সমাজে অনুকরনীয়। মাথা উচু করে দাড়িয়েছেন সমাজে।
সুশীল সমাজের প্রতিনিধি অ্যাড. এ.কে.এম শহিদুল আলম জানান, চোর ডাকাত হয়ে কেউ জন্ম নেননা। সৎ ইচ্ছে আর চেষ্টা থাকলে খারাপ পরিবেশে জন্মেও যে ভাল থাকা সম্ভব এই পরিবারটি তারই উদাহরন। মনের জোরে তারা বাবার পেশা বেছে না নিয়ে পুরো পরিবার সমাজে একটি দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন। দৃঢ় মনোবল থাকলে যে কোন পরিস্থিতি থেকে মানুষ ভাল পথে আসতে পারে। যা তরুণ সামাজের জন্য অনুকরনীয়।