মাথাভাঙ্গা মনিটর: ইউক্রেনের রাজধানী কিয়েভে যে কোনো মুহ‚র্তে চ‚ড়ান্ত হামলা চালাতে পারে রাশিয়া। রুশ সেনাদের বিশাল বহর কয়েকটি ভাগে বিভক্ত হয়ে কিয়েভের তিনদিক ঘিরে ফেলেছে। কিয়েভসংলগ্ন বনাঞ্চল ও শহরগুলোয় তারা ছড়িয়ে পড়েছেন।
কিয়েভের কেন্দ্রস্থল হিসাবে পরিচিত প্রেসিডেন্ট ভবনের কাছাকাছি তারা অবস্থান নিয়েছেন। ২৪ ঘণ্টায় তারা কিয়েভের আরও তিন মাইল ভেতরে পৌঁছে গেছে। তবে কিয়েভ রক্ষায় ইউক্রেনের সেনারা ব্যাপক প্রস্তুতি নিয়েছেন। গুরুত্বপ‚র্ণ রাস্তার পাশে পরিখা খনন ও সুরক্ষাব্যবস্থা স্থাপন করে তারা দুর্গ গড়ে তুলেছেন। কিয়েভের পশ্চিমাঞ্চলে ইউক্রেন বাহিনীর তীব্র প্রতিরোধের মুখে পড়েছে রুশ বাহিনী। সেখানে তীব্র লড়াইয়ের খবর পাওয়া যাচ্ছে। এছাড়া কিয়েভের চারপাশের শহরগুলোয় রুশ বিমানবাহিনী শুক্রবার রাতভর হামলা চালিয়েছে। রুশ ক্ষেপণাস্ত্র হামলায় মারিউপোল বিধ্বস্ত নগরীতে পরিণত হয়েছে। তিনটি শহরের বিমানবন্দরেও ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালানো হয়েছে। ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কির দাবি, রাশিয়ার সঙ্গে যুদ্ধে তার দেশ কৌশলগতভাবে ঘুরে দাঁড়াতে পেরেছে। আর মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন বলেছেন, ইউক্রেনযুদ্ধে রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন জয়ী অথবা কৌশলগত লক্ষ্য অর্জনে সফল হবেন না। একই সঙ্গে তিনি বলেন, ইউক্রেনযুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্র অংশ নেবে না। এটা হলে তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হয়ে যাবে। খবর বিবিসি, এএফপি, রয়টার্স, দ্য গার্ডিয়ান, আলজাজিরা ও সিএনএনের।
রাশিয়ার বিভিন্ন সাঁজোয়া বহর ক্রমাগত কিয়েভের দিকে অগ্রসর হচ্ছে। শহরটির খুব কাছে তারা পৌঁছে গেছেন। বিভিন্ন আবাসিক এলাকায় তারা গুলি ছুড়ছেন। যুদ্ধের ১৭তম দিনে যুক্তরাষ্ট্রের স্যাটেলাইট কোম্পানি ম্যাক্সার টেকনোলজিসের চিত্রে সাঁজোয়া যান, ট্যাংক ও কামান নিয়ে কিয়েভের পশ্চিম ও দক্ষিণদিকে রুশ সেনাদের অগ্রসর হতে দেখা গেছে। উত্তর-প‚র্বদিক থেকেও একটি বহরকে রাজধানীর দিকে এগিয়ে আসতে দেখা যায়। উত্তরে রুবিয়াঙ্কা শহরের কাছে রুশ সেনাদের দেখা গেছে। ২৪ ফেব্রæয়ারি ইউক্রেনে হামলা শুরুর পর রুশ সেনারা ধীরে ধীরে কিয়েভকে চারদিক থেকে ঘিরে ফেলার চেষ্টা করছেন। শনিবার সকালে কিয়েভ, লাভিভ, খারকিভ, চেরকাসিসহ বিভিন্ন বড় বড় শহরে বিমান হামলার আগাম সতর্কতা সংকেত বাজতে শোনা যায়। শুক্রবার রাতেও কিয়েভে বিস্ফোরণের শব্দ পাওয়া যায়, যা শনিবার ভোর পর্যন্ত চলে। স্যাটেলাইট চিত্রে কোথাও কোথাও সংঘর্ষও চোখে পড়ে। রুশ ক্ষেপণাস্ত্র হামলায় বিধ্বস্ত কিয়েভের উত্তর-পশ্চিমের বেশ কয়েকটি জায়গায় আগুন জ্বলছে। হোস্টোমেলের আন্তোনোভ বিমানবন্দরে আগুন দেখা গেছে। শহরজুড়ে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি চোখে পড়ে। স্থানীয় প্রশাসন জানায়-বুচা, ইরপিন ও হোস্টোমেলের পাশাপাশি কিয়েভের আরও উত্তরে ভিশোরোদ জেলাসহ উত্তরের অঞ্চলগুলো সবচেয়ে বিপজ্জনক অবস্থায় আছে। শহরের প‚র্বে, ডিনিপার নদীর ওপারে ব্রোভারিতেও লড়াই চলছে। কিয়েভ যতটা সহজে নিয়ন্ত্রণে আনবে ভেবেছিল রাশিয়া, এখন ততটা সহজ হবে বলে তাদের মনে হচ্ছে না। কারণ ইউক্রেনের সেনারা প্রতিরোধ করছেই, তাদের নানাভাবে যতটা সম্ভব সাহায্য করছে সাধারণ মানুষও।
ইউক্রেনীয় কর্মকর্তারা জানান, লড়াইয়ের জন্য তারা প্রস্তুত। প্রতিটি রাস্তা ও বাড়িকে দুর্গে পরিণত করা হয়েছে। ইউক্রেনের প্রেসিডেন্টের উপদেষ্টা মিখাইলো পোডোলিয়াক জানান, শহরের চেক পয়েন্টগুলো প্রস্তুত এবং সাপ্লাই লাইন গড়ে তোলা হয়েছে। তিনি বলেন, শেষ পর্যন্ত লড়াই করবে কিয়েভ। মেয়র ভিটালি ক্লিটস্কো জানান, কিয়েভের জনসংখ্যার প্রায় অর্ধেক অর্থাৎ ২০ লাখ মানুষ শহর ছেড়েছেন। তবে যারা রয়ে গেছেন, তারা শহর প্রতিরক্ষার জন্য কাজ করছেন। তিনি আরও বলেন, প্রতিটি রাস্তা, প্রতিটি ঘরকে দুর্গ বানানো হয়েছে। এমনকি যেসব মানুষ কখনো নিজেদের পোশাক পালটানোর কথা ভাবতেন না, তারাও উর্দি পরে মেশিনগান হাতে নিচ্ছেন। কিয়েভে সম্ভাব্য বড় ধরনের রুশ হামলা ঠেকাতে প্রস্তুত ইউক্রেনের সেনাবাহিনী। অনেকদিন ধরে কিয়েভ দখল নেওয়ার চেষ্টা চালাচ্ছে রুশ বাহিনী। বাইরের দিকটা দখল নিতে পারলেও ভেতরে পুরোপুরি ঢুকতে পারেননি তারা। সে প্রচেষ্টা প্রতিহত করেছে ইউক্রেন সেনারা। বাঙ্কার বানিয়ে, পরিখা কেটে পাহারা দিচ্ছে ইউক্রেন বাহিনী। সাধারণ মানুষকে পাশে পেয়ে দ্বিগুণ আত্মবিশ্বাসী ইউক্রেনের সেনাবাহিনী। সেনারা বলছেন, ‘আমরাও প্রস্তুত।’ বাঙ্কার ও পরিখা কাটতে স্থানীয়রা আমাদের সাহায্য করছেন। একজন সৈনিক বলেন, পরিস্থিতি কঠিন, যুদ্ধের সময় যেমন হয়। আমরা জিতব, আমরা তৈরি এবং আমরা অপেক্ষা করছি। পশ্চিমা প্রতিরক্ষা কর্মকর্তারা বলছেন, কিয়েভের আশপাশে শক্তিশালী অবস্থান নিতে শুরু করেছে রাশিয়ার সামরিক বাহিনী। মাইকোলাইভ, নিকোলায়েভ, ক্রোপিনিতস্কি ও ডনিপ্রো শহরে বিকট শব্দে বিস্ফোরণের খবর পাওয়া গেছে। পর্যবেক্ষকরা সতর্ক করে বলছেন, দুই সপ্তাহের বেশি সময় চলমান যুদ্ধে একটি অকল্পনীয় ট্র্যাজেডি শুরু হতে যাচ্ছে।
স্যাটেলাইটে ধরা পড়ল মারিউপোলের ধ্বংসযজ্ঞ: মারিউপোল শহরে ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞ চালাচ্ছে রুশ সেনারা। শহরটিতে এ পর্যন্ত এক হাজারের বেশি বেসামরিক লোক নিহত হয়েছে বলে জানিয়েছে কর্তৃপক্ষ। এছাড়া সেখান থেকে বেসামরিক লোকজন অন্য জায়গায়ও সরে যেতে পারছেন না। রুশ হামলায় অবরুদ্ধ শহরের আবাসিক এলাকা মাটির সঙ্গে মিশে গেছে। শপিং সেন্টার, হাসপাতাল ও উপাসনালয় ধ্বংস হয়ে গেছে। গণকবরে লাশ সমাহিত করার খবরও পাওয়া যাচ্ছে। মারিউপোলে হামলার সময় বেসামরিক নাগরিকরা প্রাণভয়ে যে মসজিদে আশ্রয় নিয়েছিলেন, সেটিতেও রুশ বাহিনী গোলাবর্ষণ করেছে। ইউক্রেনের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের টুইটার অ্যাকাউন্টে বলা হয়, মারিউপোলের সুলতান সুলেমান দ্য ম্যাগনিফিসেন্ট এবং তার স্ত্রী রক্সোলানা (হুররেম সুলতান) মসজিদে রুশ হানাদাররা গোলাবর্ষণ করেছে। মসজিদের শিশু ও তুর্কি নাগরিকসহ ৮০ জনের বেশি বেসামরিক মানুষ আশ্রয় নিয়েছিলেন। তবে কখন এ গোলাবর্ষণ করা হয়েছে, তা বলা হয়নি। তুরস্কের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এ বিষয়ে কোনো মন্তব্য করেনি।
উচ্চপদস্থ রুশ সেনা কর্মকর্তা নিহত : ইউক্রেনের সামরিক বাহিনী বলছে, তাদের সৈন্যদের হাতে একজন উচ্চপদস্থ রাশিয়ান সেনা কর্মকর্তা নিহত হয়েছেন। মেজর জেনারেল আন্দ্রেই কোলেসনিকভ ছিলেন রাশিয়ার প‚র্বাঞ্চলীয় সামরিক বিভাগের ২৯তম বাহিনীর কমান্ডার। ইউক্রেনের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর একজন উপদেষ্টা এ খবর জানান। তবে ঠিক কী পরিস্থিতিতে তার মৃত্যু হয়েছে, তা জানা যায়নি এবং রুশ পক্ষ থেকে এ ব্যাপারে কোনো মন্তব্য করা হয়নি। বাইডেন-জেলেনস্কির ৪৯ মিনিট ফোনালাপ : ইউক্রেন ইস্যুতে প্রেসিডেন্ট জেলেনস্কির সঙ্গে দীর্ঘক্ষণ ফোনে কথা বলেছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন। শুক্রবার দুই নেতার মধ্যে ৪৯ মিনিট ফোনালাপ হয়। ফোনালাপের পর জেলেনস্কি টুইটে জানান, ইউক্রেন যুদ্ধক্ষেত্রের সবশেষ পরিস্থিতি সম্পর্ক বাইডেনকে জানানো হয়েছে। বেসামরিক নাগরিকদের ওপর রাশিয়ার অপরাধ সম্পর্কেও অবগত করা হয়েছে। ইউক্রেনের প্রতি সমর্থন অব্যাহত এবং রাশিয়ার বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা বাড়াতে সম্মত হয়েছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট। হোয়াইট হাউজ জানায়, ইউক্রেনের জনগণের সাহসিকতার প্রশংসা করেছেন জো বাইডেন। জেলেনস্কিকে সহায়তা করে যাওয়ারও তিনি প্রতিশ্রæতি দিয়েছেন। বাইডেন বলেন, ইউক্রেনের জনগণের তাদের দেশরক্ষার সাহসিকতার লড়াইয়ে পাশে দাঁড়িয়েছে যুক্তরাষ্ট্র।
যুদ্ধে পুতিন কখনো জয়ী হবেন না : রুশ প্রেসিডেন্ট পুতিন ইউক্রেন যুদ্ধে জয়ী বা তার কৌশলগত লক্ষ্য অর্জনে সফল হবেন না বলে মন্তব্য করেছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন। তবে একই সঙ্গে আবারও এটা নিশ্চিত করে তিনি বলেন, ইউক্রেনযুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্র অংশ নেবে না। এটা হলে তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হয়ে যাবে। টুইট করে জো বাইডেন বলেন, পুতিন কোনো লড়াই ছাড়া ইউক্রেন দখলের আশা করেছিলেন। ইউরোপীয় ঐক্যে ফাটল ধরানোর আশা করেছিলেন। ন্যাটো জোটকে দুর্বল করার আশা করেছিলেন। আমেরিকাকে দ্বিখণ্ডিত করার আশা করেছিলেন; কিন্তু তিনি (পুতিন) ব্যর্থ হয়েছেন। ইউক্রেনের বিরুদ্ধে যুদ্ধে পুতিন কখনো জয়ী হবেন না। অপর এক টুইট বার্তায় বাইডেন বলেন, আমি এটা স্পষ্ট করতে চাই, আমরা ন্যাটো অঞ্চলের প্রতি ইঞ্চি জায়গা পূর্ণ শক্তি দিয়ে রক্ষা করব। কিন্তু আমরা ইউক্রেনে রাশিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধে অংশ নেব না। রাশিয়া ও ন্যাটোর মুখোমুখি লড়াইয়ে অংশ নেওয়ার মানে হলো তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ। রাশিয়ার সীমান্তে ১২ হাজার মার্কিন সেনা পাঠানোর কথাও জানান বাইডেন। তিনি আরও বলেন, রাশিয়া যদি রাসায়নিক অস্ত্র ব্যবহার করে তবে তাদের ‘চড়া ম‚ল্য’ দিতে হবে। ইউক্রেন?
যুদ্ধের মধ্যেই নরওয়েতে সেনা পাঠাচ্ছে ন্যাটো : ইউক্রেনযুদ্ধের দামামার মধ্যেই সোমবার নরওয়েতে ন্যাটোভুক্ত দেশগুলোর শীতকালীন মহড়া শুরু হতে যাচ্ছে। এতে ন্যাটোভুক্ত ২৭টি দেশের প্রায় ৩০ হাজার সেনা, ২০০টি বিমান এবং ৫০টি জাহাজ নেবে। এ বছর ন্যাটো সৈন্যদের নিয়ে সবচেয়ে বড় মহড়া এটি। পশ্চিমা দেশগুলোর সেনারা নরওয়ের ঠান্ডা জলবায়ুতে, আর্কটিক, মাটিতে, সমুদ্রে এবং আকাশে তাদের যুদ্ধের দক্ষতাকে উন্নত করতে সক্ষম করবে। রাশিয়ার সীমান্ত থেকে কয়েকশ কিলোমিটার দ‚রে এ মহড়া অনুষ্ঠিত হবে। যদিও এটি মস্কোর ইউক্রেন আক্রমণের অনেক আগেই পরিকল্পনা করা হয়েছিল। যুদ্ধের কারণে এটি তাৎপর্য যোগ করেছে।