স্টাফ রিপোর্টার: মহামারি করোনা ও ভয়ানক নিউমোনিয়াকেও হার মানিয়েছিলেন। তারপরও শেষ রক্ষা হলো না। চলেই গেলেন উপমহাদেশের সংগীতাকাশের মহাতারকা লতা মুঙ্গেশকর। গতকাল রোববার সকাল ৮টা ১২ মিনিটে ভারতের মুম্বাইয়ের ব্রিচ ক্যান্ডি হাসপাতালে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন এই সুরসম্রাজ্ঞী। তার বয়স হয়েছিল ৯২ বছর। সন্ধ্যা ৭টার দিকে মুম্বাইয়ের শিবাজি পার্কে রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় লতা মুঙ্গেশকরের শেষকৃত্য অনুষ্ঠিত হয়। ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিও যোগ দেন এই শেষকৃত্যে। এ সময় উপস্থিত ছিলেন এনসিপি সুপ্রিমো শরদ পাওয়ার, এম এসএন নেতা রাজ ঠাকরে, কেন্দ্রীয় মন্ত্রী পীযূষ গোয়েল, বলিউড তারকা শাহরুখ খান, সাবেক ক্রিকেটার শচীন টেন্ডুলকারসহ রাজনৈতিক, সংগীত ও চলচ্চিত্রের অগণিত তারকা। মরদেহের পাশে ছিলেন ছোট বোন আশা ভোঁসলেসহ লতার পুরো পরিবার। এছাড়া লতার শেষকৃত্য দেখার জন্য ভিড় জমায় অসংখ্য জনতা; পরিস্থিতি সামাল দিতে বেশ বেগ পেতে হয় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে। কাছের মানুষ আর অনুরাগীদের চোখের জলেই বিদায় নিলেন সুরের সরস্বতী। এর আগে বেলা সাড়ে ১২টার পর এই তারকার মরদেহ নিয়ে যাওয়া হয় প্রভুকুঞ্জের বাসভবনে। সেখান থেকে বিকাল ৫টার দিকে তেড়ঙা পতাকায় মুড়িয়ে শিবাজি পার্কে নিয়ে যাওয়া হয় লতার মরদেহ। কিংবদন্তি এই শিল্পীর মৃত্যুতে ভারতে দুই দিনের রাষ্ট্রীয় শোক ঘোষণা করেছে সরকার। লতা মুঙ্গেশকরের প্রয়াণে ভারতের সংস্কৃতি জগতে অপূরণীয় শূন্যতা সৃষ্টি হয়েছে জানিয়ে গভীর শোক প্রকাশ করেছেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। এই শূন্যতা পূরণ হওয়ার নয় বলেও মন্তব্য করেন তিনি।
এদিকে উপমহাদেশের কিংবদন্তি সংগীতশিল্পী লতা মুঙ্গেশকরের মৃত্যুতে গভীর শোক ও দুঃখ প্রকাশ করেছেন বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। রোববার পৃথক শোক বার্তায় রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রী লতা মুঙ্গেশকরের বিদেহী আত্মার শান্তি কামনা করেন ও শোকসন্তপ্ত পরিবারের প্রতি গভীর সমবেদনা জানান। শোক বার্তায় শেখ হাসিনা বলেন, এই সুরসম্রাজ্ঞীর মৃত্যুতে উপমহাদেশের সংগীতাঙ্গনে এক বিশাল শূন্যতা সৃষ্টি হলো। তিনি তার কর্মের মাধ্যমে চিরদিন এ অঞ্চলের মানুষের হৃদয়ে বেঁচে থাকবেন। কোভিড পরবর্তী জটিলতার কারণে লতার মৃত্যু হয়েছে বলে জানিয়েছে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। প্রায় চার সপ্তাহ ধরে হাসপাতালে ভর্তি থাকার পর সম্প্রতি অবস্থার উন্নতিও হচ্ছিলো। কিন্তু শনিবার আচমকা তার শারীরিক অবস্থার অবনতি হতে শুরু করে। নিতে হয় ভেন্টিলেশনে। সেখান থেকে আর ফেরানো যায়নি লতাকে। করোনা আক্রান্ত হওয়ায় গত ১১ জানুয়ারি তাকে মুম্বাইয়ের ব্রিচ ক্যান্ডি হাসপাতালে ভর্তি করানো হয়। নিউমোনিয়াতেও আক্রান্ত ছিলেন গিনেস বুকে নাম লেখানো এই সংগীতশিল্পী। প্রথম থেকেই তাকে আইসিইউতে রাখা হয়েছিলো। গত ৩০ জানুয়ারি শিল্পীর করোনা নেগেটিভ রিপোর্ট আসে। কিন্তু বয়সজনিত নানা সমস্যার কারণে শেষ পর্যন্ত আর লড়তে পারেননি। এর আগেও সঙ্কটজনক অবস্থায় একাধিকবার হাসপাতালে ভর্তি করাতে হয়েছিলো তাকে। কিন্তু ভক্তদের আশ্বস্ত করে প্রত্যেকবারই সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরে গিয়েছিলেন।
১৯২৯ সালের ২৮ সেপ্টেম্বর ভারতের ইন্দোরে জন্মগ্রহণ করেন লতা মুঙ্গেশকর। বাবা দীননাথ মুঙ্গেশকর মারাঠি, তবে শাস্ত্রীয় সংগীতে পারদর্শী ছিলেন। থিয়েটারও করতেন তিনি। আর মা সেবন্তী ছিলেন কোঙ্কনী গায়িকা। বাবা-মায়ের কাছ থেকেই শৈশবে গানের প্রতি টান তৈরি হয় লতার। মাত্র ১৩ বছর বয়সে বাবাকে হারান লতা। ওই বয়সেই প্রথম মারাঠি সিনেমার গানে কণ্ঠ দেন তিনি। পরিবার থেকেই তার গানে হাতেখড়ি। যদিও বাবার নিষেধাজ্ঞা থাকায় হিন্দি গান শুনতে পারতেন না। অথচ সেই লতাই পরবর্তীতে হয়ে ওঠেন হিন্দি গানের মহারাণী। খুব ছোটবেলায় মঞ্চে গান গাওয়া শুরু করেন লতা মুঙ্গেশকর।
জানা গেছে, গান গেয়ে তার প্রথম আয় ছিল ২৫ রুপি। কৈশোরে বাবাকে হারিয়ে দিশেহারা হয়ে পড়েন লতা। কারণ ছোট ভাই-বোনসহ পরিবারের দায়িত্ব তার কাঁধেই এসে পড়ে। পরিবারের কথা ভেবে বিয়ে করেননি তিনি। গান গেয়ে উপার্জন করছেন, আর পরিবারকে আগলে রেখেছেন। ১৯৪৫ সালে মুম্বাইয়ে পাড়ি দেন লতা। তারপর আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি তাকে। সেখানে ওস্তাদ আমান আলী খানের কাছে ধ্রম্নপদী সঙ্গীতের তালিম নেন। ১৯৪৮ সালে প্রথম হিন্দি সিনেমায় গান করেন তিনি। সিনেমাটির নাম ‘মজবুর’। পাঁচ ভাইবোনের মধ্যে লতাই ছিলেন সবার বড়। চল্লিশের দশকে গায়িকা হিসেবে ক্যারিয়ার শুরু করেন তিনি। তারপর পঞ্চাশ, ষাট-সত্তরের দশক থেকে নব্বইয়ের দশকেও চুটিয়ে প্লে-ব্যাক করেন লতা মুঙ্গেশকর।
১৯৫০ সাল থেকে দীর্ঘ কয়েক দশক ‘কোকিলকণ্ঠী’র গান মুগ্ধ করেছে দেশবাসীকে। আয়েগা আনেওয়ালা, প্যার কিয়া তো ডরনা কেয়া, আল্লা তেরো নাম, কঁহি দীপ জ্বলে-ষাট ও সত্তর দশকে এসব গান জনপ্রিয়তার যে শিখর ছুঁয়েছিলো, তা আজও অমøান। বহু বিখ্যাত সংগীত পরিচালকের সঙ্গে কাজ করেছেন সংগীতের এই উজ্জ্বল নক্ষত্র। এমন কী বর্তমান প্রজন্মের অনেকেই নিজের তৈরি গান লতা মুঙ্গেশকরের কণ্ঠে নতুন করে আবিষ্কার করেছেন। স্বনামধন্য সংগীত পরিচালক এ আর রহমান নব্বইয়ের দশকে ‘দিল সে’ ছবিতে তাকে দিয়ে গান গাওয়ান। ‘জিয়া জ্বলে’ গানটিতে আজও একক এবং অদ্বিতীয় লতা মুঙ্গেশকর। তার সুরে বুঁদ গোটা দেশ। জীবন ভর মনপ্রাণ দিয়ে সুরসাধনার পুরস্কারও তিনি কম পাননি। বিশ্বব্যাপী জনপ্রিয়তা ছাড়াও ঝুলিতে এসেছে সিনে অ্যাওয়ার্ড অফ লাইফটাইম অ্যাচিভমেন্ট থেকে শুরু করে পদ্মভূষণ, পদ্মবিভূষণ, দাদা সাহেব ফালকে, ফিল্ম ফেয়ার লাইফটাইম অ্যাচিভমেন্ট, ভারতরতœসহ একাধিক সম্মাননা। বছর কয়েক ধরে ধীরে ধীরে জনসমক্ষে ফিঁকে হচ্ছিল লতা মুঙ্গেশকরের কণ্ঠ। অসুস্থতার জন্য খুব বেশি কাজ করতে পারতেন না। তবে উরিতে ভারতীয় জওয়ানদের সাফল্য কিংবা পরবর্তী সময়ে দেশে হুলস্থুল ফেলে দেয়া বিভিন্ন বিষয়ে নিয়ে ছোট করেই দিয়েছেন সুরেলা বার্তা। বাংলা ভাষায় মোট ১৮৫টি গান গেয়েছেন তিনি। বাংলায় তার গান গাওয়ার শুরু হেমন্ত কুমারের হাত ধরে। নিজে কখনো গাওয়া গানের রেকর্ড না রাখলেও, বিভিন্ন তথ্যসূত্র থেকে হিসাব বলছে গোটা জীবনে ৫০ হাজারেরও বেশি গান গেয়েছেন কিংবদন্তি এই গায়িকা।