২০০২-এর পর থেকে এ পর্যন্ত জামুকার সুপারিশ ছাড়া গেজেটভুক্তদের যাচাই-বাছাইয়ের সিদ্ধান্ত
স্টাফ রিপোর্টার: জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিলের (জামুকা) সুপারিশ ছাড়া যাদের নাম বীর মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে ‘বেসামরিক গেজেটে’ অন্তর্ভুক্ত হয়েছে, তাদের মধ্য থেকে ৩৯ হাজার ৯৬১ জন মুক্তিযোদ্ধার তালিকা মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইটে প্রকাশ করা হয়েছে।
মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক বিষয়টি নিশ্চিত করে বলেন, প্রায় ৪২ হাজার মুক্তিযোদ্ধার তালিকা যাচাই-বাছাই করার কথা থাকলেও গত দুইদিন যাচাই-বাছাই করে দেখা গেছে, প্রায় তিন হাজার মুক্তিযোদ্ধার নাম আগেই বাদ দেয়া হয়েছে। তাই তারা ৩৯ হাজার ৯৬১ জন মুক্তিযোদ্ধার তালিকা প্রকাশ করেছেন। এখান থেকেই মুক্তিযোদ্ধারা জানতে পারবেন কাদের নাম যাচাই-বাছাই হবে। মন্ত্রী জানান, ২০০২-এর পর থেকে এ পর্যন্ত জামুকার সুপারিশ ছাড়া যারা গেজেটভুক্ত হয়েছেন, তাদের যাচাই-বাছাই করার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। যদিও জামুকা আইন অনুসারে বীর মুক্তিযোদ্ধার তালিকায় নাম অন্তর্ভুক্ত করতে অবশ্যই তাঁদের সুপারিশ নিতে হবে।
গত বৃহস্পতিবার জামুকার ৭১তম সভায় বীর মুক্তিযোদ্ধাদের সনদ যাচাই-বাছাইয়ে নির্দেশিকা অনুমোদন করা হয়। ইতোমধ্যে বীর মুক্তিযোদ্ধাদের এমআইএসের ভিত্তিতে সম্মানী ভাতা প্রদান সংক্রান্ত নির্দেশনা ও উপজেলা কমিটি গঠনের চিঠিপত্রও ওয়েবসাইটে দেয়া হয়েছে। ৩১ ডিসেম্বরের মধ্যে যাচাইয়ের কাজটি শেষ করতে চায় জামুকা। তবে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত না আসা পর্যন্ত কারও ভাতা বন্ধ হবে না।
মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয় বলছে, দেশের ভেতরে প্রশিক্ষণ নেয়া মুক্তিযোদ্ধাকে অবশ্যই পাকিস্তানি বাহিনীর বিরুদ্ধে সম্মুখযুদ্ধ করার সপক্ষে তিনজন সহযোদ্ধার (ভারতে প্রশিক্ষণ নেয়া) সাক্ষ্য জোগাড় করতে হবে। ১৯৭১ সালের ৩ ডিসেম্বরের পর যুদ্ধে অংশগ্রহণকারী ব্যক্তিদের এ ক্ষেত্রে বিবেচনায় নেয়া হবে না। বীর মুক্তিযোদ্ধা যাচাই-বাছাইয়ের জন্য গঠিত কমিটির প্রতিবেদনের ভিত্তিতে গেজেট প্রকাশ বা বাতিল বা এর আগে প্রকাশিত বেসামরিক গেজেট বহাল রাখার জন্য সরকারের কাছে সুপারিশ করা হবে।
একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা মাসে ১২ হাজার টাকা ভাতা পান। ঈদ বোনাসসহ বছরে সব মিলিয়ে একজন ভাতা পান ১ লাখ ৭১ হাজার টাকা। মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, বছরের পর বছর ধরে জেলা প্রশাসনের তালিকার ভিত্তিতেই ১ লাখ ৯২ হাজার বীর মুক্তিযোদ্ধাকে ভাতা পাঠানো হতো। কিন্তু এমআইএস সফটওয়্যারে বীর মুক্তিযোদ্ধাদের নামের তথ্য অন্তর্ভুক্ত করার পর সংখ্যাটি ২১ হাজার কমে গেছে। গত অক্টোবর ও নভেম্বর মাসে ১ লাখ ৭১ হাজার জনকে ভাতা পাঠানো হয়েছে।
২০০২ সাল পর্যন্ত আইন না মেনে সনদ দেয়া হয়েছে, যা নিয়ে অনেক প্রশ্ন রয়েছে। এসব তালিকা যাচাই-বাছাই না করলেও প্রশ্ন রয়েই যাবে। জামুকা আইন অনুযায়ী, জামুকার বৈঠক বা অনুমোদন ছাড়া তালিকা প্রকাশ বা তালিকা থেকে কাউকে বাদ দেয়া যাবে না। তাই ৪২ হাজার বীর মুক্তিযোদ্ধার তালিকা যাচাই-বাছাইয়ের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে
মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ সমুন্নত রাখতে এবং বীর মুক্তিযোদ্ধা ও তাদের পরিবারের কল্যাণ নিশ্চিত করতে ২০০২ সালে জাতীয় মুক্তিযুদ্ধ কাউন্সিল আইন করা হয়। এ আইনে বলা আছে, ‘প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা প্রণয়ন, সনদ ও প্রত্যয়নপত্র প্রদানে এবং জাল ও ভুয়া সনদ ও প্রত্যয়নপত্র বাতিলের জন্য সরকারের কাছে সুপারিশ পাঠাবে জামুকা।’
জামুকার প্রতিষ্ঠার পর থেকে ভারতীয় তালিকা বা লাল মুক্তিবার্তায় (চূড়ান্ত লাল বই) বীর মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে নাম অন্তর্ভুক্ত থাকার পরও এবং জামুকার সুপারিশ ছাড়া যাদের নাম ‘বেসামরিক গেজেটে’ প্রকাশিত হয়েছে, তারা প্রকৃত বীর মুক্তিযোদ্ধা কি না, তার যথার্থতা নির্ধারণের জন্য যাচাই-বাছাইয়ের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়েছে।
উল্লেখ্য, বেসামরিক গেজেট বলতে ‘বাংলাদেশ গেজেট’ আকারে প্রকাশিত ‘বেসামরিক গেজেট’, যা মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইটে প্রকাশিত বীর মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতিস্বরূপ ৩৩ ধরনের প্রমাণকের মধ্যে একটি।
জীবিত এবং দেশে অবস্থানরত ব্যক্তিকে নির্ধারিত ফরম পূরণ করে প্রয়োজনীয় তথ্য প্রদান করে সহযোদ্ধা সাক্ষী উপস্থাপন এবং দালিলিক প্রমাণসহ সংশ্লিষ্ট কমিটির সামনে যাচাই-বাছাইয়ে অংশগ্রহণ করতে হবে। একইভাবে, যাচাই-বাছাইয়ের আওতাভুক্ত মৃত ব্যক্তিদের ক্ষেত্রেও তার ওয়ারিশদের একই তথ্য-প্রমাণসহ সংশ্লিষ্ট কমিটির সামনে যাচাই-বাছাইয়ে অংশগ্রহণ করতে হবে। কমিটির সদস্যরা যাচাই-বাছাইয়ের আওতাভুক্ত ব্যক্তি বা মৃত ব্যক্তির ওয়ারিশদের মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ সম্পর্কে যেকোনো ধরনের প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করতে পারবেন। একইভাবে, ওই ব্যক্তির সমর্থনে তথ্য-প্রমাণ পরীক্ষা করা বা আগত সহযোদ্ধা বা সহপ্রশিক্ষণ গ্রহীতাকে প্রয়োজনীয় জিজ্ঞাসাবাদ করা যাবে। তবে যাচাই-বাছাই কমিটির আওতাভুক্ত ব্যক্তির সমর্থনে ‘জানি’ বা ‘শুনেছি’ জাতীয় কোনো বক্তব্য গ্রহণযোগ্য হবে না।
কমিটি যাচাই-বাছাই শেষ করে তিন ধরনের প্রতিবেদন প্রস্তুত করবে। একটি হচ্ছে সর্বসম্মতিক্রমে প্রস্তুত করা তালিকা, আরেকটি দ্বিধাবিভক্ত তালিকা এবং অন্যটি অগ্রহণযোগ্য তালিকা। ‘দ্বিধাবিভক্ত তালিকা’র ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির পক্ষে মতামত প্রদানকারী সদস্য শুধু একটি বাক্যের মাধ্যমে তার যুক্তি উল্লেখ করে স্বাক্ষর করবেন। একইভাবে, বিপক্ষে মতামত প্রদানকারী সদস্য একটি বাক্যের মাধ্যমে তার যুক্তি বা কারণ উল্লেখ করে স্বাক্ষর করবেন। যাচাই-বাছাই সম্পন্ন করার সময়ই কমিটি তিন ধরনের খসড়া তালিকা প্রস্তুত ও পরবর্তী তিন কর্মদিবসের মধ্যে সংশ্লিষ্ট উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা বা জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে এবং উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা কমপ্লেক্স বা জেলা মুক্তিযোদ্ধা কমপ্লেক্সে ফলাফল টানিয়ে প্রকাশ করবে।
একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির সভাপতি শাহরিয়ার কবির প্রথম আলোকে বলেন, ‘আশা রাখি এ প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে অমুক্তিযোদ্ধারা তালিকা থেকে বাদ যাবে।’