সংবিধান সংস্কার কমিশনের প্রতিবেদনের সুপারিশ প্রধান উপদেষ্টার কাছে জমা
স্টাফ রিপোর্টার: নির্বাচনকালীন অন্তর্বর্তী সরকারব্যবস্থা রাখা, মোট ৫০৫ আসনের দ্বিকক্ষবিশিষ্ট (উচ্চকক্ষ ও নিম্নকক্ষ) জাতীয় সংসদ এবং সংসদের মেয়াদ পাঁচ বছরের পরিবর্তে চার বছর করার সুপারিশ করেছে সংবিধান সংস্কার কমিশন। বিদ্যমান রাষ্ট্র পরিচালনার চার মূলনীতির মধ্যে ‘ধর্মনিরপেক্ষতা’সহ তিনটিই বাদ দেয়ারও সুপারিশ করেছে। ‘গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ’ পরিবর্তন করে ‘জনগণতন্ত্রী বাংলাদেশ’ করারও সুপারিশ করেছে কমিশন। এছাড়া নাগরিকত্ব হিসেবে ‘বাঙালি’ বাদ দিয়ে ‘বাংলাদেশি’ করার সুপারিশ করেছে কমিশনটি। অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইউনূসের কাছে গতকাল বুধবার সংবিধান সংস্কার কমিশনের জমা দেয়া প্রতিবেদনে এসব সুপারিশ করা হয়েছে। কমিশনের চেয়ারম্যান ড. আলী রীয়াজের নেতৃত্বে কমিশনের সদস্যরা এই প্রতিবেদন প্রধান উপদেষ্টার হাতে তুলে দেন। সংবিধান সংস্কার কমিশনের সুপারিশসমূহের মধ্যে আরো উল্লেখযোগ্য হলো রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর মধ্যে ক্ষমতার ভারসাম্য আনয়নের লক্ষ্যে ‘জাতীয় সাংবিধানিক কাউন্সিল’ গঠন; সংসদে প্রধানমন্ত্রীর বিষয়ে অনাস্থা প্রস্তাব আনার বিধান যুক্ত করা, গণভোট পুনর্বহাল এবং ৭০ অনুচ্ছেদ সংশোধন করা। সুপারিশে বলা হয়েছে, একজন ব্যক্তি দুই বারের বেশি প্রধানমন্ত্রী হতে পারবেন না; প্রধানমন্ত্রী থাকাকালে তিনি কোনো রাজনৈতিক দলের প্রধান ও সংসদ নেতা হতে পারবেন না। একই সঙ্গে রাষ্ট্রপতির মেয়াদও হবে চার বছর; দুই বারের বেশি রাষ্ট্রপতি পদে থাকতে পারবেন না এবং রাষ্ট্রপতি নির্বাচকম-লীর সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোটে নির্বাচিত হবেন। এছাড়া সংসদ নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার ন্যূনতম বয়স বর্তমান ২৫ বছর থেকে কমিয়ে ২১ করার সুপারিশ করেছে কমিশন। গতকাল প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়ে প্রতিবেদন হস্তান্তরের পর সংবিধান সংস্কার কমিশনের প্রধান আলী রীয়াজ তার বক্তব্যে বলেন, ’৭১-এর মুক্তিযুদ্ধের মহান আদর্শ ও ’২৪-এর জনআকাক্সক্ষার ভিত্তিতে কমিশন পাঁচটি মূলনীতির প্রস্তাব করেছে। তিনি বলেন, এই সুপারিশ প্রণয়নে প্রায় এক লাখ লোকের মতামত নেয়া হয়েছে। সেখানে রাজনৈতিক দল, সুশীলসমাজসহ সমাজের বিভিন্ন অংশীজনরা রয়েছেন। কার্যকর গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা এবং মৌলিক মানবাধিকার ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করাই ছিল প্রতিবেদন তৈরির মূল লক্ষ্য। তিনি বলেন, গত ১৬ বছর দেশে একনায়কতন্ত্র ও স্বৈরতন্ত্র কায়েম করা হয়েছিল। রাষ্ট্রক্ষমতা যেন এক ব্যক্তির হাতে কেন্দ্রীভূত হতে না পারে সেলক্ষ্য সামনে রেখেই সুপারিশ প্রণয়ন করা হয়েছে। ধর্মনিরপেক্ষতাসহ রাষ্ট্র পরিচালনার তিন মূলনীতি বাদ, গণতন্ত্র বহাল রেখে নতুন চার মূলনীতির সুপারিশ রাষ্ট্র পরিচালনার চার মূলনীতির মধ্যে তিনটি বাদ দেয়ার সুপারিশ করেছে সংবিধান সংস্কার কমিশন। সেই সঙ্গে গণতন্ত্র বহাল রেখে রাষ্ট্র পরিচালনার নতুন আরো চারটি মূলনীতির সুপারিশ করেছে তারা। বর্তমানে সংবিধানে রাষ্ট্র পরিচালনার যে চার মূলনীতি রয়েছে সেগুলো হলো জাতীয়তাবাদ, সমাজতন্ত্র, গণতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতা। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে দেশ স্বাধীন হওয়ার পর বাহাত্তরে যে সংবিধান প্রণীত হয়েছিল, তাতে রাষ্ট্র পরিচালনার এই চার মূলনীতি গৃহীত হয়েছিলো। বর্তমানের চার মূলনীতির মধ্যে শুধু গণতন্ত্র রাখা হয়েছে প্রস্তাবিত নতুন পাঁচ মূলনীতির মধ্যে। সুপারিশ করা নতুন পাঁচটি মূলনীতি হলো সাম্য, মানবিক মর্যাদা, সামাজিক সুবিচার, বহুত্ববাদ ও গণতন্ত্র। তিন মূলনীতি বাদ দেয়ার বিষয়ে সংস্কার কমিশনের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, কমিশন সংবিধানের মূলনীতি ও রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতি হিসেবে ধর্মনিরপেক্ষতা, সমাজতন্ত্র ও জাতীয়তাবাদ এবং এ সংশ্লিষ্ট সংবিধানের ৮, ৯, ১০ ও ১২ অনুচ্ছেদগুলো বাদ দেয়ার সুপারিশ করছে। নিম্নকক্ষ বিষয়ক সুপারিশ: আইনসভার নিম্নকক্ষ গঠিত হবে সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোটে সরাসরি নির্বাচিত সদস্যদের সমন্বয়ে। ৪০০ আসন নিয়ে নিম্নকক্ষ গঠিত হবে। ৩০০ জন সদস্য একক আঞ্চলিক নির্বাচনি এলাকা থেকে সরাসরি ভোটে নির্বাচিত হবেন। আর ১০০জন নারী সদস্য সারা দেশের সব জেলা থেকে নির্ধারিত ১০০ নির্বাচনি এলাকা থেকে কেবল নারী প্রার্থীদের মধ্যে প্রতিদ্বন্দ্বিতার মাধ্যমে সরাসরি ভোটে নির্বাচিত হবেন। রাজনৈতিক দলগুলো নিম্নকক্ষের মোট আসনের ন্যূনতম ১০ শতাংশ আসনে তরুণ-তরুণীদের মধ্য থেকে প্রার্থী মনোনীত করবে। দুই জন ডেপুটি স্পিকার থাকবেন, যাদের মধ্যে একজন বিরোধী দল থেকে মনোনীত হবেন। একজন সংসদ সদস্য একই সঙ্গে নিম্নলিখিত যে কোনো একটির বেশি পদে অধিষ্ঠিত হবেন না। এগুলো হলো প্রধানমন্ত্রী, সংসদ নেতা এবং রাজনৈতিক দলের প্রধান। অর্থবিল ব্যতীত নিম্নকক্ষের সদস্যরা তাদের মনোনয়নকারী দলের বিপক্ষে ভোট দেয়ার পূর্ণ ক্ষমতা থাকবে। আইনসভার স্থায়ী কমিটিগুলোর সভাপতি সব সময় বিরোধীদলীয় সদস্যদের মধ্য থেকে মনোনীত হবেন। উচ্চকক্ষ যেভাবে হবে: উচ্চকক্ষ মোট ১০৫ জন সদস্যের সমন্বয়ে গঠিত হবে। এর মধ্যে ১০০ জন সদস্য জাতীয় সংসদ নির্বাচনে প্রদত্ত মোট ভোটের সংখ্যানুপাতে নির্ধারিত হবেন। রাজনৈতিক দলগুলো সংখ্যানুপাতিক প্রতিনিধিত্ব পদ্ধতির ভিত্তিতে উচ্চকক্ষের মনোনয়নের জন্য সর্বোচ্চ ১০০ জন প্রার্থী মনোনয়ন দিতে পারবে। এই ১০০ জন প্রার্থীর মধ্যে কমপক্ষে পাঁচ জন আইন দিয়ে নির্ধারিত পদ্ধতিতে সামাজিক ও অর্থনৈতিকভাবে অনগ্রসর সম্প্রদায়ের প্রতিনিধিত্ব করবে। বাকি পাঁচটি আসন পূরণের জন্য রাষ্ট্রপতি নাগরিকদের মধ্য থেকে (যারা কোনো কক্ষেরই সদস্য ও রাজনৈতিক দলের সদস্য নন) প্রার্থী মনোনীত করবেন। কোনো রাজনৈতিক দলকে সংখ্যানুপাতিক প্রতিনিধিত্ব (পিআর) পদ্ধতির ভিত্তিতে উচ্চকক্ষে প্রতিনিধিত্বের যোগ্য হতে হলে জাতীয় সংসদ নির্বাচনে প্রদত্ত ভোটের অন্তত ১ শতাংশ নিশ্চিত করতে হবে। উচ্চকক্ষের স্পিকার সাধারণ সংখ্যাগরিষ্ঠতার ভিত্তিতে উচ্চকক্ষের সদস্যদের মধ্য থেকে নির্বাচিত হবেন। উচ্চকক্ষের একজন ডেপুটি স্পিকার থাকবেন, যিনি সরকারদলীয় সদস্য ব্যতীত উচ্চকক্ষের অন্য সব সদস্যের মধ্য থেকে নির্বাচিত হবেন। রাষ্ট্রপতি নিয়ে যে সুপারিশ: সংবিধান সংস্কার কমিশনের সুপারিশে বলা হয়েছে. রাষ্ট্রপতির মেয়াদ হবে চার বছর। রাষ্ট্রপতি সর্বোচ্চ দুই বারের বেশি অধিষ্ঠিত থাকবেন না। রাষ্ট্রপতি নির্বাচকম-লীর (ইলেকটোরাল কলেজ) সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোটে নির্বাচিত হবেন। যেসব ভোটারের সমন্বয়ে নির্বাচকম-লী (ইলেকটোরাল কলেজ) গঠিত হবে, তারা হলেন আইনসভার উভয় কক্ষের সদস্যপ্রতি একটি করে ভোট; প্রতিটি ‘জেলা সমন্বয় কাউন্সিল’ সামষ্টিকভাবে একটি করে ভোট; প্রতিটি ‘সিটি করপোরেশন সমন্বয় কাউন্সিল’ সামষ্টিকভাবে একটি করে ভোট। রাষ্ট্রদ্রোহ, গুরুতর অসদাচরণ বা সংবিধান লঙ্ঘনের জন্য রাষ্ট্রপতিকে অভিশংসন করা যাবে। নি¤œকক্ষ থেকে অভিশংসন প্রক্রিয়া শুরু হবে। অন্তর্বর্তী সরকার: নির্বাচন করার জন্য সংবিধান সংস্কার কমিশন অন্তর্র্বতী সরকারের বিধান যুক্ত করার সুপারিশ করেছে। এটি মূলত কাজের দিক দিয়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের মতো। এ বিষয়ে কমিশন যে সুপারিশ করেছে, সেগুলো হলো: ১. কমিশন আইনসভার মেয়াদ শেষ হওয়ার পরে কিংবা আইনসভা ভেঙে গেলে পরবর্তী নির্বাচিত সরকার শপথ না নেওয়া পর্যন্ত একটি অন্তর্বর্তী সরকার নিয়োগের সুপারিশ করা হয়। ২. সরকারের প্রধান ‘প্রধান উপদেষ্টা’ বলে অভিহিত হবেন। আইনসভার মেয়াদ শেষ হওয়ার ১৫ দিন আগে অথবা আইনসভা ভেঙে গেলে, পরবর্তী অন্যূন ১৫ দিনের মধ্যে প্রধান উপদেষ্টা নিয়োগের সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত করতে হবে। প্রধান উপদেষ্টা সর্বোচ্চ ১৫ সদস্যবিশিষ্ট একটি উপদেষ্টা পরিষদের মাধ্যমে কার্য পরিচালনা করবেন। বাংলাদেশের সাংবিধানিক নাম পরিবর্তনের সুপারিশ: ‘গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ’ পরিবর্তন করে ‘জনগণতন্ত্রী বাংলাদেশ’ করার সুপারিশ করেছে সংবিধান সংস্কার কমিশন। আর প্রজাতন্ত্রের পরিবর্তে ‘নাগরিকতন্ত্র’ করার প্রস্তাবও করেছে কমিশন। কমিশনের এই সুপারিশ বাস্তবায়িত হলে বাংলাদেশ সরকারের মনোগ্রামেও পরিবর্তন আসবে। বর্তমানে বাংলাদেশের সংবিধানের নাম হিসেবে উল্লেখ আছে, ‘গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধান’। সংবিধান সংস্কার কমিশনের সুপারিশে সংবিধানের প্রস্তাব হিসেবে বলা হয়েছে, ‘জনগণের সম্মতি নিয়ে আমরা এই সংবিধান জনগণতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধান হিসেবে গ্রহণ করছি।’ দেশের বিদ্যমান সংবিধানে আছে বাংলাদেশ একটি একক, স্বাধীন ও সার্বভৌম প্রজাতন্ত্র, যা ‘গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ’ নামে পরিচিত হবে। কমিশন সুপারিশ করেছে, সংবিধানের প্রযোজ্য সব ক্ষেত্রে ‘প্রজাতন্ত্র’ এবং ‘গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ’ শব্দের পরিবর্তে ‘নাগরিকতন্ত্র’ এবং ‘জনগণতন্ত্রী বাংলাদেশ’ শব্দ ব্যবহূত হবে। তবে ইংরেজি সংস্করণে ‘রিপাবলিক’ ও ‘পিপলস রিপাবলিক অব বাংলাদেশ’ শব্দগুলো থাকছে। এছাড়া নাগরিকত্ব হিসেবে ‘বাঙালি’ বাদ দিয়ে ‘বাংলাদেশি’ করার সুপারিশ করেছে সংবিধান সংস্কার কমিশন। কমিশন ‘বাংলাদেশের জনগণ জাতি হিসেবে বাঙালি…’ এই বিধান বিলুপ্ত করার সুপারিশ করেছে। তারা বর্তমান অনুচ্ছেদ ৬ (২) ‘বাংলাদেশের নাগরিকগণ ‘বাংলাদেশি’ বলে পরিচিত হবেন’ হিসেবে প্রতিস্থাপন করার সুপারিশ করেছে।