স্টাফ রিপোর্টার: দরজায় কড়া নাড়ছে খুশির ঈদ। একদিন পর রোববার ঈদুল আজহা। প্রাণের উৎসবে যোগ দিতে শেকড়ের টানে ঢাকা ছাড়ছে নানা বয়সি মানুষ। গন্তব্যে পৌঁছাতে শত দুর্ভোগ তুচ্ছ করে আনন্দমুখর ঈদযাত্রায় শামিল হচ্ছেন ঘরমুখোরা। ঢাকা থেকে বাস, ট্রেন, লঞ্চ, বিমান, ব্যক্তিগত গাড়ি, ভাড়ায় মাঝারি গাড়িতে দলে দলে ছুটছেন। ট্রেনের শিডিউল বিপর্যয়, সড়ক দুর্ঘটনার করণে কয়েক কিলোমিটার লম্বা যানজট যাত্রীদের দুর্ভোগ বাড়িয়েছে। তবে সব বাহনেই উপেক্ষিত করোনার স্বাস্থ্যবিধি। প্রায় কারও মুখেই মাস্ক দেখা যায়নি। সামাজিক দূরত্ব তো নয়ই। অথচ করোনার নতুন সংক্রমণ ফের চোখ রাঙাচ্ছে। প্রায় ঘরেই সর্দি-জ্বর কাশির রোগী আছে। এরপরও কেউ মানছেন না সরকারের স্বাস্থ্যবিধি সংক্রান্ত বার্তা।
ডাক ও টেলিযোগাযোগ বিভাগের মন্ত্রী মোস্তাফা জব্বার তার ফেসবুক পেজে লিখেছেন, এবার ঈদে রাজধানী ছাড়বে ১ কোটিরও বেশি মানুষ। মুঠোফোনের সিমকার্ড বার্তায় এমন তথ্যই পাওয়া যাচ্ছে। আর যাত্রী কল্যাণ সমিতির তথ্য বলছে, এবার ঈদে ২ কোটির বেশি মানুষ রাজধানী ছাড়বে।
ট্রেন: ১ থেকে ৫ জুলাই পর্যন্ত ট্রেনের অগ্রিম টিকিট কেটে রাখা যাত্রীরা রাজধানী ছাড়ছেন। বৃহস্পতিবার ৪ জুলাই টিকিট নেওয়া যাত্রীরা ঢাকা ছেড়ে গেছেন। ঈদের আগের দিন ঢাকা ছাড়বেন ৫ জুলাইর টিকিটের যাত্রীরা। কমলাপুর ও বিমানবন্দর রেলওয়ে স্টেশন ঘুরে দেখা গেছে, প্রতিটি প্লাটফরমেই যাত্রীদের উপচে পড়া ভিড়। এক একটি ট্রেন স্টেশনে পৌঁছুলেই হুড়মুড় করে ট্রেনে উঠছেন যাত্রীরা। কেউ দরজা দিয়ে কেউ জানালা দিয়ে। অনেক নারী যাত্রীকেও জানালা দিয়ে উঠতে দেখা গেছে। কমলাপুর থেকেই ট্রেনে ছাদে উঠার চেষ্টা করে বিনা টিকিটের যাত্রীরা। কিন্তু নিরাপত্তারক্ষী তাদের ছাদ থেকে নামিয়ে দেন। কিন্তু কমলাপুরের পরের স্টেশনে ছাদের দখল নেয় তারা। কামরার ভেতর টিকিট ছাড়া অনেক যাত্রীকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা গেছে। সিল্কসিটি এক্সপ্রেস ট্রেনে যাত্রী আমিনুল ইসলাম বলেন, তিন সদস্যের পরিবার নিয়ে তিনি বাড়ি যাচ্ছেন। ট্রেন প্রায় ৩০ মিনিট বিলম্ব স্টেশন ছেড়ে যাবে বলে জেনেছেন। এতে তিনি বিরক্ত হননি, বরং বললেন-ওটা ব্যাপার না। আমরা ট্রেনে করে গ্রামে যাচ্ছি ওটাই বড়। সড়ক পথে নির্ধারিত সময়ের চেয়ে প্রায় ১২-১৫ ঘণ্টা পর্যন্ত বেশি সময় লাগে। এমন অভিজ্ঞতা বেশ কয়েকবার হয়েছে বলেও জানান তিনি।
রেল সংশ্লিষ্টরা জানান, এবার ঈদে প্রতিদিন ৩৯ জোড়া আন্তঃনগর ট্রেন ঢাকা ছেড়ে যাচ্ছে। আন্তঃনগর ট্রেনসহ মেইল, লোকাল ও কমিউটার মিলে মোট ১০৭টি যাত্রীবাহী ট্রেন চলাচল করছে। এগুলোতে প্রতিদিন আসনসংখ্যার বিপরীতে কমলাপুর ও বিমানবন্দর রেলওয়ে স্টেশন থেকে প্রায় ৬৫ হাজার যাত্রী গন্তব্যে পৌঁছুবে। তবে খোদ রেলওয়ের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলছেন, ঈদে আসন সংখ্যার চেয়ে প্রায় দেড় থেকে ২ গুণ বেশি যাত্রী যাতায়াত করছে। এতে অতিরিক্তি যাত্রী বহন করতে গিয়ে বেশ কিছু ট্রেন সিডিউল রক্ষা করতে পারছে না।
এ বিষয়ে ঢাকা রেলওয়ে বিভাগীয় ব্যবস্থাপক (ডিআরএম) মোহাম্মদ সফিকুর রহমান বলেন, রাজধানীর কমলাপুর ও বিমানবন্দর রেলওয়ে স্টেশনে যাত্রীদের তিল ধারণের ঠাঁই নেই। প্রতিটি ট্রেনেই অতিরিক্ত যাত্রী চলাচল করছে। তাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতেই কিছু ট্রেন গতি কমিয়ে চালাতে হচ্ছে। কিছু কিছু ট্রেন বিলম্বে চলাচল করছে, তবে ওটাকে আমরা শিডিউল বিপর্যয় বলতে চাই না। এটা যাত্রীদের কল্যাণেই হচ্ছে, যাত্রীরাও ট্রেনে ভ্রমণ করে বেশ আনন্দিত। এবার অধিকাংশ ট্রেনই যথাযথ সময়ে রাজধানী ছেড়ে যাচ্ছে।
এদিকে উত্তর ও দক্ষিণাঞ্চলে চলাচলকারী অন্তত ৭টি ট্রেন রাজধানী প্রবেশের সময় বিমানবন্দর রেলওয়ে স্টেশনে বিরতি বাতিল করা হয়েছে। মঙ্গলবার থেকে নির্দিষ্ট সাতটি ট্রেন বিমানবন্দর রেলওয়ে স্টেশনে থামছে না। এক রেল কর্মকর্তা বলেন, ঈদ উপলক্ষ্যে প্রতি বছরই রাজধানী প্রবেশ করা পশ্চিমাঞ্চলে চলাচলকারী অধিকাংশ ট্রেন বিমানবন্দর রেলওয়ে স্টেশনে বিরতি দেয়ার পরপরই আগেভাগেই বিনাটিকিট যাত্রীরা ট্রেনে উঠে সিট দখল করে বসে পড়েন। পরে কমলাপুর স্টেশনে ওই সব ট্রেন পৌঁছুলে টিকিটধারী যাত্রীরা যথাযথ সিটি বসতে পারেন না। সৃষ্টি হয় হট্টগোল, এতে টিকিটধারী যাত্রীদের দুর্ভোগ চরমে উঠে।
সড়কে যাত্রা: পরিসংখ্যান বলছে ঈদে সড়ক পথেই সবচেয়ে বেশি মানুষ ঢাকা ছাড়ে। ঢাকা থেকে বের হওয়ার মুখ থেকেই শুরু হয় দুর্ভোগ। দীর্ঘ যাত্রায় বিভিন্ন স্থানে এটা বাড়তে থাকে। এসব মেনেই সড়ক পথে রওয়ানা দিচ্ছেন মানুষ। দূরপাল্লার বাসগুলোতে ছিল বাড়তি ভিড়। কেউ বাসের ভেতর দাঁড়িয়ে, কেউ বা ছাদে চড়ে যেতেও দেখা গেছে।
বাসের টিকিট কাউন্টার থেকে জানিয়েছে, তারা যাত্রীদের চাহিদা মেটাতে হিমশিম খাচ্ছেন। গাবতলী, সায়েদাবাদ, কমলাপুর বাস টার্মিনাল ঘুরে দেখা গেছে, এসব স্থান লোকে লোকারণ্য। যাত্রীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, অনেকে ট্রেনের টিকিট চেষ্টা করেও পাননি। তাই নিরুপায় হয়ে বাসে যাচ্ছেন। অধিকাংশ মানুষ বলছেন, তাদের জন্য সড়কপথই উত্তম। বছরের পর বছর ধরে সড়কপথেই ঈদে বাড়ি যান।
রাজধানীর বিভিন্ন সড়কে দেখা যায়, দূরপাল্লার লোকাল বাস টার্মিনাল ছাড়াও রাস্তা থেকে যাত্রী উঠাচ্ছে। একাধিক চালক জানান, বাধ্য হয়েই রাস্তা থেকে যাত্রী উঠাতে হচ্ছে। ভেতরে থাকা যাত্রীদের অসুবিধা হলেও, ঈদের সময় অধিকাংশই বিষয়টিকে স্বাভাবিক ভাবে নেন। চলন্ত পথেই ঈদের আমেজ সৃষ্টি হয়। কেউ আবার বাসের ছাদে উঠে পড়ছে। যাত্রীদের নামিয়েও দেয়া যাচ্ছে না।
এদিকে রাজধানী থেকে ছাড়া বাসগুলোর বেশিরভাগই যাত্রাবাড়ী, সায়েদাবাদ, উত্তরা, আব্দুল্লাহপুর এলাকায় যানজটে পড়ছে। আবার টঙ্গী এবং চট্টগ্রাম রোড বরাবর যানজটে পড়ছে। যাত্রী এবং চালকদের ভাষ্য, সকালের দিকে রাজধানী ছাড়ার প্রধান সড়কগুলোতে তেমন যানজট হচ্ছে না। কিন্তু দুপুরের পর থেকে যানজটের সৃষ্টি হচ্ছে। কখনও কখনও ৩০ মিনিটের রাস্তা ১ থেকে ২ ঘণ্টা পর্যন্ত লেগে যাচ্ছে। টঙ্গী এলাকায় যানজটে পড়তে হচ্ছে।
পদ্মা সেতু হয়ে ঘরমুখো যাত্রীদের যানজট দেখতে হচ্ছে। সেতু দিয়ে মোটরসাইকেল চলাচল সাময়িকভাবে বন্ধ থাকায় ফেরিতে চাপ বেড়েছে। এক একটি ফেরিতে প্রায় অর্ধেকের বেশি জায়গায় মোটরসাইকেল উঠছে। বাইকারদের অভিযোগ, সেতুতে দুর্ঘটনা ঘটছে একটি দুটি মোটরসাইকেল। কিন্তু, হাজার হাজার মোটরসাইকেল তো দুর্ঘটনা ঘটাচ্ছে না। যারা নানাভাবে চেষ্টা করেও লঞ্চ, ট্রেন, বাসের টিকিট সংগ্রহ করতে পারেনি, এদের ভরসাই ছিল মোটরসাইকেল। অনেকেই মোটরসাইকেলে গ্রামে ছুটছেন। কিন্তু, সেতুতে মোটরসাইকেল উঠা বারণ থাকায়, দুর্ভোগে পড়ছেন বাইকাররাও। এদিকে যমুনা সেতুর আগে বৃহস্পতিবার কয়েক কিলোমিটারজুড়ে যানজট ছিলো। পরে একপর্যায়ে চলাচল স্বাভাবিক হয়।