স্টাফ রিপোর্টার: সংলাপ, সমঝোতা ও আন্দোলন-প্রতিটি ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ সতর্কতার সঙ্গে পথ চলছে বিএনপি। হুট করে কোনো সিদ্ধান্ত নিয়ে আন্দোলনে যেমনি ব্যর্থ হতে চায় না, তেমনি জাতীয় বা আন্তর্জাতিক পর্যায়ের কোনো আশ্বাসের ভিত্তিতে সংলাপে অংশ নিয়ে বিগত সময়ের মতো ফাঁদে পড়তে চায় না দলটি। সতর্কতার অংশ হিসেবে নিজ ও মিত্র দলে কয়েকজনকে ইতোমধ্যে নজরদারিতেও রাখা হয়েছে।
বিএনপিসূত্র মতে, তিনটি বিষয়ের ক্ষেত্রে বিএনপি এখন খুব সতর্ক। এক, আন্দোলনের কর্মসূচি নির্ধারণে হঠকারী সিদ্ধান্ত নয়। দুই, দল ও জোটের সন্দেহভাজনদের বিষয়ে নজরদারি করে কার্যকরী সিদ্ধান্ত গ্রহণ এবং তিন, জাতীয় ও আর্ন্তর্জাতিক সমঝোতার প্রস্তাবের কার্যকারিতা নিশ্চিত করে অগ্রসর হওয়া।
আলাপকালে বিএনপির একাধিক সিনিয়র নেতা বলেন, আন্দোলনের কর্মসূচি নির্ধারণে হঠকারী সিদ্ধান্তের কারণে দলকে অনেক বেকায়দায় পড়তে হয়েছে। ২০১৪ ও ‘১৫ সালের অপরিকল্পিত আন্দোলনের খেসারত এখনো বিএনপিকে দিতে হচ্ছে। ওই আন্দোলনে বিএনপি কোনো সহিংসতার পরিকল্পনা না করলেও এর দায় দলকে নিতে হয়েছে। এজন্য শান্তিপূর্ণ আন্দোলনের মাধ্যমে সংকটের সমাধান খুঁজছে দলটি। আর পরিকল্পনা মাফিক আন্দোলনে জনগণের সম্পৃক্ততা নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে অনেক দূর এগিয়েছে বলে মনে করছে তারা। এমনি অবস্থায় সর্বোচ্চ সতর্কভাবে একের পর এক জনসম্পৃক্ত কর্মসূচি দিয়ে সফলতার মুখ দেখতে শুরু করেছে বলে ধারণা শীর্ষ নেতাদের। মূলত একাদশ সংসদ নির্বাচনের পর থেকে বিএনপির এই পদ্ধতি অনুসরণ করছে।
সূত্র মতে, আন্দোলন ছাড়াও দল ও জোটের সন্দেহভাজনদের বিষয়ে সতর্ক বিএনপি। এর কারণ হচ্ছে, বিএনপির কাছে তথ্য আছে, ব্যক্তি স্বার্থে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের সঙ্গে আঁতাত করছে দল ও জোটের কিছু নেতা। নির্বাচনের সময় যতই ঘনিয়ে আসবে ততই তারা দলের জন্য কাল হবে। সন্দেহভাজন এমন কিছু নেতার একটি তালিকাও করা হয়েছে। ২/১ জনকে মৌখিকভাবে সতর্কও করা হয়েছে। কাউকে কাউকে বহিষ্কারও করা হয়েছে। তালিকায় বেশকিছু নেতা থাকলেও তাদেরকে কৌশলগত কারণেই সামনে আনতে চায় না বিএনপি। দল বিরোধী কর্মকা-ের সঙ্গে যারা প্রকাশ্যে অবস্থান নেবে শুধু তাদের ব্যাপারে প্রকাশ্যে ব্যবস্থা নেয়া হবে। এর বাইরে যাদের বিষয়গুলো প্রকাশ্যে আসেনি তাদেরকে বিপথগামী হওয়া থেকে ফেরানোর চেষ্টা করার পাশাপাশি দলের গুরুত্বপূর্ণ কার্মকা-ে সম্পৃক্ত না করা চিন্তা-ভাবনা রয়েছে।
অন্যদিকে, দলের বাইরে মিত্র অন্য দলগুলোর কিছু নেতাদের নিয়েও সতর্ক বিএনপি। মিত্র বেশ কয়েকটি রাজনৈতিক দলের নেতা আছেন বিএনপির নজরদারিতে। দলের অনেকে মনে করেন, একাদশ সংসদ নির্বাচনে যাদের সঙ্গে জোট করা হয়েছিল তাদের অনেকে গোপনে বেঈমানি করেছে। আর নির্বাচনের পরে জোটের সিদ্ধান্তের বাইরে গিয়ে সংসদে যোগদানের মধ্য দিয়ে তা প্রমাণিত হয়েছে। সঙ্গত কারণে আন্দোলন ও নির্বাচনসহ রাজনৈতিক মাঠের নেতৃত্ব এবার বিএনপির কাছেই রাখার সিদ্ধান্ত হয়েছে। কোনো অবস্থাতেই অন্য দলের নেতৃত্বে অগ্রসর হওয়ার পরিকল্পনা নেই।
সূত্রমতে, রাজনৈতিক সংকট সমাধানে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক মধ্যস্থতাকারীদের বিষয়ে এবার বেশ সতর্ক বিএনপি। দশম ও একাদশ সংসদ নির্বাচনের আগে সমঝোতার সব পদক্ষেপে বিএনপিকে ফাঁদে ফেলা হয়েছিল দলে এমন আলোচনাও আছে। দলের সিনিয়র এক নেতার মতে, বাংলাদেশে বিরোধপূর্ণ রাজনৈতিক দলগুলোকে সমঝোতায় আনতে ২০১৩ সালে জাতিসংঘের তৎকালীন মহাসচিবের উদ্যোগে ঢাকায় এসেছিলেন তৎকালীন সহকারী মহাসচিব অস্কার ফার্নান্দেজ তারানকো। তিনি কয়েক দফায় বৈঠক করলেও ব্যর্থ হয়ে তাকে ফিরে যেতে হয়। এরপর বিএনপির বর্জনের মধ্যে নির্বাচন করে ক্ষমতায় থেকে যায় আওয়ামী লীগ। ওই বৈঠক এবং পরবর্তীতে ক্ষমতাসীনদের পক্ষ থেকে যা বলা হয়েছিল তা বাস্তবায়িত হয়নি।
ওই বিষয়ে পরবর্তী সময়ে সংবাদ মাধ্যমে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছিলেন, ‘সাংবিধানিক ধারাবাহিকতা রক্ষার কথা বলে আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করে যত দ্রুত সম্ভব সবার অংশগ্রহণে জাতীয় নির্বাচনের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল। আওয়ামী লীগের ওই অঙ্গীকার লিখিত ছিল না, কিন্তু সাধারণ মানুষও বিষয়টি জানত।’
আন্তর্জাতিক ওই সমঝোতার বৈঠক ছাড়াও জাতীয় পর্যায়ের সংলাপেও বিএনপিকে ধোঁকা দেয়া হয়েছিল বলে মনে করে দলটি। সঙ্গত কারণে এবার কোনো ধরনের সংলাপে না বসার সিদ্ধান্ত নিয়েছে বিএনপি। তবে তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠন নিয়ে আলোচনার জন্য কোনো বৈঠক হলে-তাতে সাড়া দেবে বিএনপি। সম্প্রতি প্রধান নির্বাচন কমিশনার কাজী হাবিবুল আউয়াল সংলাপের জন্য আমন্ত্রণ জানালেও তা প্রত্যাখ্যান করে দলটি। পাশাপাশি তত্ত্বাবধায়ক সরকার ছাড়া সব ধরনের সংলাপ বর্জনের আভাস দেয়া হয়।
২০১৮ সালের নির্বাচনের আগে সংলাপ ও এর ফলাফল এবং পরবর্তীতে সংলাপের ভাবনা প্রসঙ্গে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, একাদশ সংসদ নির্বাচনের আগে সংলাপে দেয়া ওয়াদা রাখা হয়নি। সংলাপে ক্ষমতাসীনদের পক্ষ থেকে প্রতিজ্ঞা করা হয়েছিল যে, নির্বাচনে সরকার কোনো হস্তক্ষেপ করবে না। পুলিশ আর গ্রেপ্তার করবে না, কোনো মামলা দেবে না, নির্বাচন পর্যন্ত পুলিশি নির্যাতন হবে না। কিন্তু এর তিনদিন পর থেকে পুলিশি নির্যাতনে বিএনপিসহ বিরোধী দলের নেতাকর্মী সব পালিয়ে গেছেন। ঘরে থাকতে পারেননি। ২১ প্রার্থীকে নির্বাচনের আগে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। এমন তিক্ত অভিজ্ঞতার পর শুধু তত্ত্বাবধয়াক সরকারের বিষয়ে আলোচনার জন্য বিএনপিকে আমন্ত্রণ জানানো হলে দল বিবেচনা করবে। অন্য কিছুর জন্য নয়।