কয়েকশ কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে এহসান গ্রুপ
স্টাফ রিপোর্টার: শরিয়াভিত্তিতে লভ্যাংশ দেয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়ে কয়েকশ কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে এহসান গ্রুপ। এই গ্রুপের চেয়ারম্যান রাগীব আহসান মানুষের ধর্মীয় অনুভূতিকে পুঁজি করে প্রতারণার আশ্রয় নিয়ে টাকা হাতিয়ে নেন। তিনশ কর্মচারী খাটালেও তাদের বেতন দিতে হতো না। তারাই গ্রাহক জোগাড় করে এনে দিতেন। গ্রাহকের পাশাপাশি এই কর্মচারীরাও প্রতারণার শিকার হয়েছেন। বৃহস্পতিবার রাতে র্যাব সদর দপ্তরের গোয়েন্দা শাখা ও র্যাব-১০ এর একটি আভিযানিক দল রাজধানীর তোপখানা রোড এলাকায় অভিযান চালিয়ে রাগীব আহসান (৪১) ও তার সহযোগী আবুল বাশার খানকে (৩৭) গ্রেফতার করে। এ সময় তাদের কাছ থেকে ভাউচার বই, মোবাইল ফোনসহ বিভিন্ন জিনিসপত্র উদ্ধার করা হয়। এছাড়া পিরোজপুরে গ্রেফতার হয়েছে তার আরও দুই ভাই।
কাওরান বাজারে র্যাবের মিডিয়া সেন্টারে শুক্রবার আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে সংস্থাটির আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন এমন তথ্য জানান। তিনি বলেন, প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে গ্রেফতারকৃত রাগীব আহসান প্রতারণার মাধ্যমে অর্থ হাতিয়ে নেয়ার বিষয়ে বিভিন্ন তথ্য দিয়েছেন। ২০১৮ সাল থেকে তার প্রতিষ্ঠান গ্রাহকদের টাকা দিতে পারছে না। এ কারণে এরই মধ্যে ১৫টির বেশি মামলা হয়েছে। প্রতারণার কারণে রাগীব আহসান ২০১৯ সালে গ্রেফতার হয়ে কারাভোগ করেন।
এভাবে অর্থ জালিয়াতি তদন্তের জন্য দুদক ও সিআইডিকে চিঠি দেয়া হবে বলেও জানান খন্দকার মঈন। তিনি বলেন, জিজ্ঞাসাবাদে র্যা ব জানতে পেরেছে, গ্রেফতারকৃত রাগীব আহসান ১৯৮৬ সালে পিরোজপুরের একটি মাদরাসায় পড়াশোনা শুরু করেন। পরে (১৯৯৬-১৯৯৯) হাটহাজারীর একটি মাদরাসা থেকে দাওরায়ে হাদিস এবং খুলনার একটি মাদরাসা থেকে (১৯৯৯-২০০০) মুফতি কোর্স সম্পন্ন করেন। পরে তিনি পিরোজপুরে একটি মাদরাসায় চাকরি নেন। ২০০৬-২০০৭ সালে ইমামতির পাশাপাশি একটি এমএলএম কোম্পানিতে ৯০০ টাকা বেতনে চাকরি করেন। মূলত ওই প্রতিষ্ঠানে চাকরির সুবাদে এমএলএম কোম্পানির আদ্যোপান্ত রপ্ত করেন। পরে ২০০৮ সালে নিজে ‘এহসান রিয়েল এস্টেট’ নামে একটি এমএলএম কোম্পানি প্রতিষ্ঠা করেন। খোন্দকার মঈন বলেন, রাগীব হাসান মূলত ধর্মীয় আবেগ-অনুভূতিকে অপব্যবহার করে এমএলএম কোম্পানির ফাঁদ তৈরি করেন। তার টার্গেট ছিল দেশের বিভিন্ন প্রান্তের ধর্মপ্রাণ সাধারণ মানুষ, ধর্মীয় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যুক্ত ব্যক্তি ও ইমাম। ‘শরিয়তসম্মত সুদবিহীন বিনিয়োগ’-এর বিষয়টি ব্যাপক প্রচারণা করে গ্রাহকদের আকৃষ্ট করেন তিনি। এছাড়া তিনি ওয়াজ মাহফিল আয়োজনের আড়ালে ব্যবসায়িক প্রচারণা চালান। তিনি লাখ টাকার বিনিয়োগে গ্রাহকদের মাসিক মাত্রাতিরিক্ত টাকা প্রাপ্তির প্রলোভন দেখাতেন। ২০০৮ সালে ১০ হাজার গ্রাহককে যুক্ত করতে সমর্থ হন রাগীব আহসান। এখন গ্রাহকের সংখ্যা প্রায় লক্ষাধিক।
র্যাব জানায়, রাগীব আহসানের প্রায় তিনশ কর্মচারী রয়েছে। তাদের বেতন দিতে হয় না। কর্মচারীরা মাঠ পর্যায় থেকে বিনিয়োগকারী গ্রাহক সংগ্রহ করেন। তাদের গ্রাহকের বিনিয়োগের ২০ শতাংশ অর্থ প্রাপ্তির প্রলোভন দেখানো হয়েছে। ফলে গ্রাহক সংখ্যা দ্রুত বাড়তে থাকে। গ্রাহকদের পাশাপাশি এই কর্মচারীরাও তার প্রতারণার শিকার হয়েছে। রাগীব আহসান র্যাবকে জানান, তিনি ১৭টি প্রতিষ্ঠানের নামে প্রতারণার ফাঁদ তৈরি করেন। এগুলো হলো-এহ্সান গ্রুপ বাংলাদেশ, এহ্সান পিরোজপুর বাংলাদেশ (পাবলিক) লিমিটেড, এহ্সান রিয়েল এস্টেট অ্যান্ড বিল্ডার্স লিমেটেড, নূর-ই মদিনা ইন্টারন্যাশনাল ক্যাডেট একাডেমি, জামিয়া আরাবিয়া নূরজাহান মহিলা মাদরাসা, হোটেল মদিনা ইন্টারন্যাশনাল (আবাসিক), আল্লাহর দান বস্ত্রালয়, পিরোজপুর বস্ত্রালয়-১ ও ২, এহ্সান মাল্টিপারপাস কো-অপারেটিভ সোসাইটি লিমিটেড, মেসার্স বিসমিল্লাহ ট্রেডিং অ্যান্ড কোং, মেসার্স মক্কা এন্টারপ্রাইজ, এহ্সান মাইক অ্যান্ড সাউন্ড সিস্টেম, এহ্সান ট্যুর অ্যান্ড ট্রাভেলস, ইসলাম নিবাস প্রজেক্ট, এহ্সান পিরোজপুর হাসপাতাল, এহ্সান পিরোজপুর গবেষণাগার ও এহ্সান পিরোজপুর বৃদ্ধাশ্রম। এসব প্রতিষ্ঠানের নামে অর্থ সংগ্রহ করে তিনি পরিবারের সদস্য ও নিকট-আত্মীয়দের নামে-বেনামে সম্পত্তি ও জায়গা জমি করেছেন।
জিজ্ঞাসাবাদে রাগীব আহসান র্যাবকে জানান, তিনি তার পরিবারের সদস্যদের নাম যুক্ত করে ব্যবসায়িক কাঠামো তৈরি করেন। তার নিকট-আত্মীয়দের মধ্যে শ্বশুর প্রতিষ্ঠানের সহসভাপতি, বাবা প্রতিষ্ঠানের উপদেষ্টা, ভগ্নিপতি প্রতিষ্ঠানের ম্যানেজার। এছাড়া রাগীব আহসানের ৩ ভাইয়ের মধ্যে গ্রেফতারকৃত আবুল বাশার প্রতিষ্ঠানের সহপরিচালক, বাকি দুই ভাই প্রতিষ্ঠানের সদস্য। এভাবে তিনি ব্যাপক অনিয়ম করেছেন বলে ভুক্তভোগীরা অভিযোগ করেছেন।
র্যাব জানায়, রাগীব হাউজিং, ল্যান্ড প্রজেক্ট, ব্যবসায়িক দোকান, ধর্মীয় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসহ বিভিন্ন সেবামূলক প্রতিষ্ঠানের আড়ালে সাধারণ গ্রাহকদের কষ্টার্জিত অর্থ আত্মসাৎ করেছেন। জিজ্ঞাসাবাদে এখন পর্যন্ত তিনি ১১০ কোটি টাকা সংগ্রহের কথা স্বীকার করেছেন। এ বিষয়ে বিস্তর জিজ্ঞাসাবাদের প্রয়োজন রয়েছে।
র্যাব আরও জানায়, রাগীব আহসান বিভিন্নভাবে গ্রাহকদের প্রতারিত করতেন। এক্ষেত্রে তিনি চেক জালিয়াতি করতেন। অনেকেই পাওনা টাকার চেক নিয়ে ব্যাংকে গিয়ে প্রতারিত হয়েছেন। এছাড়া ভাড়াটে লোকজন দিয়ে অনেক গ্রাহককে ভয়ভীতি, লাঞ্ছিত ও নির্যাতন করেছেন। ওইসব গ্রাহক র্যাবের কাছে অভিযোগ করেছেন। আহসানের বিরুদ্ধে বিভিন্ন থানায় বেশ কয়েকটি মামলাও রয়েছে।
এছাড়া রাগীব আহসানের ৩ ভাইয়ের মধ্যে গ্রেপ্তার আবুল বাশার প্রতিষ্ঠানের সহপরিচালক, বাকি দুই ভাই প্রতিষ্ঠানের সদস্য। তিনি কত টাকা আত্মসাৎ করেছেন এবং এই টাকা জঙ্গি কর্মকা-ে বা বিভিন্ন ইস্যুতে উসকানির কাজে ব্যবহৃত হতো কিনা- এমন প্রশ্নের জবাবে কমান্ডার মঈন বলেন, বিভিন্ন ভুক্তভোগীর তথ্য, সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত খবরের ভিত্তিতে আনুমানিক তিনি ১৭ হাজার কোটি টাকা আত্মসাৎ করেছেন বলে ধারণা করা হচ্ছে। তবে তিনি বলেছেন ১১০ কোটি টাকা। আর আত্মসাৎকৃত টাকা জঙ্গি কর্মকা-ে ব্যবহার হয়েছে কি-না বা উসকানির কাজে ব্যবহৃত হতো কি-না সেটি গোয়েন্দারা খতিয়ে দেখবেন। তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, যেহেতু টাকার বিষয়টি জড়িত তাই এ বিষয়ে দুদক ও সিআইডি ব্যবস্থা নেবে।