স্টাফ রিপোর্টার: বাংলাদেশের সঙ্গে প্রতিরক্ষা সংক্রান্ত আকসা ও জিসোমিয়া নামের দুটি চুক্তি সই করতে চায় যুক্তরাষ্ট্র। আকসার (অ্যাকুজিশান অ্যান্ড ক্রস-সার্ভিসিং এগ্রিমেন্ট) অধীনে মার্কিন বাহিনী খাদ্য, জ্বালানি, গোলাবারুদ ও সরঞ্জামাদি বিনিময় হয়ে থাকে। জিসোমিয়া (জেনারেল সিকিউরিটি অব মিলিটারি ইনফরমেশন এগ্রিমেন্ট) চুক্তির অধীনে হয় সামরিক গোয়েন্দা তথ্যের বিনিময়। অপরদিকে, র্যাবের বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করায় উদ্বেগের কথা জানিয়েছে বাংলাদেশ। এ সময় র্যাবের মানবাধিকার সুরক্ষা সংক্রান্ত বিভিন্ন পদক্ষেপের একটি নথি যুক্তরাষ্ট্রের কাছে হস্তান্তর করা হয়। রোববার ঢাকায় বাংলাদেশ ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে অষ্টম অংশীদারি সংলাপে এই নথি হস্তান্তর হয়। পররাষ্ট্র সচিব মাসুদ বিন মোমেন সংলাপে বাংলাদেশ প্রতিনিধি দলের নেতৃত্ব দেন। যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিনিধি দলের নেতৃত্ব দেন মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের রাজনীতি সংক্রান্ত আন্ডার সেক্রেটারি ভিক্টোরিয়া নুল্যান্ড।
ঢাকা-ওয়াশিংটন সম্পর্ক নতুন আবর্তে প্রবেশ করছে। নিরাপত্তা, অর্থনীতি ও রাজনৈতিক ক্ষেত্রে বাইডেন প্রশাসনের সঙ্গে সম্পৃক্ততার বিস্তৃতি ঘটছে। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের পরিপ্রেক্ষিতে নতুন বিশ্ব পরিস্থিতি, ইন্দো-প্যাসিফিক সহযোগিতার বিস্তার, বর্তমান ভ‚-রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে নতুন মাত্রার সমীকরণের মধ্যে এবারের অংশীদারি সংলাপ হচ্ছে। এটাকে খুবই তাৎপর্যময় বলে মনে করা হচ্ছে। এছাড়া বাইডেন প্রশাসনের আমলে এটাই প্রথম অংশীদারি সংলাপ। বিশেষ করে র্যাবের বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা দেয়ার পর ঢাকা-ওয়াশিংটন সম্পর্কের অস্বস্তি কাটাতে সংলাপের প্রতি সবার নজর। আগামী কয়েক মাসে সিরিজ বৈঠকের মাধ্যমে চূড়ান্ত হবে সম্পর্কের নতুন মাত্রার রূপরেখা। বৈঠকের পর এক যৌথ সংবাদ ব্রিফিংয়ে পররাষ্ট্র সচিব মাসুদ বিন মোমেন অংশীদারি সংলাপের আলোচনায় সন্তোষ প্রকাশ করেছেন। তিনি বলেন, র্যাবের বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা দেয়ায় আমরা উদ্বিগ্ন। সন্ত্রাস দমন ও আন্তঃদেশীয় অপরাধ দমনে র্যাব ভ‚মিকা পালন করেছে। আমরা এ বিষয়ে আরও আলাপ-আলোচনা করবো। যদিও মার্কিন আন্ডার সেক্রেটারি ভিক্টোরিয়া নুল্যান্ড, র্যাবের বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞাকে জটিল বিষয় বলে অভিহিত করেন। তিনি বলেন, বিচারবহির্ভ‚ত হত্যাকাণ্ডের মতো ঘটনায় আমরা উদ্বিগ্ন। বাংলাদেশের তরফে এ ব্যাপারে জিরো টলারেন্সের অঙ্গীকার করা হচ্ছে। গত কয়েক মাসে পরিস্থিতির উন্নতি হয়েছে বলে জানানো হয়েছে। তবে নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার একটি জটিল বিষয়। ওয়াশিংটনে ফিরে গিয়ে বিষয়টি নিয়ে করণীয় কী সে বিষয়ে দেখবো। বাংলাদেশ ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে সম্পর্ক আরও অনেক বেশি বিস্তৃত হচ্ছে জানিয়ে ভিক্টোরিয়া নুল্যান্ড বলেন, ‘এটা হলো বড় ভোজের আগে এপিটাইজার মাত্র।’ নুল্যান্ড আগামী কয়েক মাসে বিভিন্ন পর্যায়ে আলোচনায় সম্পর্কের গতি-প্রকৃতির সংকেত মিলবে বলে ইঙ্গিত দিচ্ছেন। তিনি বলেন, বিনা উসকানিতে ইউক্রেনের ওপর আগ্রাসন চালিয়েছে রাশিয়া। সেখানে ভয়ঙ্কর কাণ্ড ঘটাচ্ছে। আশা করি, ইউক্রেনের সার্বভৌমত্ব ও অখণ্ডতার পক্ষে বাংলাদেশ সমর্থন জানাবে।
বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন এমন এক কর্মকর্তা বলেছেন, র্যাবের ইস্যুতে যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিনিধি দলকে কিছুটা নমনীয় বলে তার কাছে মনে হয়েছে। যদিও নিরাপত্তা ক্ষেত্রে চুক্তিসহ বিভিন্ন ধরনের সহযোগিতার প্রস্তাবে বাংলাদেশের মধ্যে স্পর্শকাতরতা দেখা যাচ্ছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের তরফে ‘অ্যাকুজিশান অ্যান্ড ক্রস-সার্ভিসিং এগ্রিমেন্ট’ (আকসা) চুক্তির প্রস্তাব বাংলাদেশকে আগেই দেয়া হয়েছিলো। এই চুক্তি যুক্তরাষ্ট্র সাধারণত ন্যাটো কিংবা তার কোয়ালিশন পার্টনারদের সঙ্গে করে থাকে। চুক্তির অধীনে মার্কিন বাহিনী খাদ্য, জ্বালানি, গোলাবারুদ এবং সরঞ্জামাদি বিনিময় করে। এই চুক্তি কোনো দেশের সামরিক অভিযান পরিচালনার কোনো অঙ্গীকার নয়। তৃতীয় দেশের মধ্যেও আকসা হতে পারে। যুক্তরাষ্ট্র ছাড়া অন্য অনেক দেশের সঙ্গে আকসা করেছে জাপান ও দক্ষিণ কোরিয়া। অপরদিকে, জেনারেল সিকিউরিটি অব মিলিটারি ইনফরমেশন এগ্রিমেন্ট (জিসোমিয়া) সই করার জন্যও প্রস্তাব করা হয়েছে। বাংলাদেশ ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে সামরিক গোয়েন্দা তথ্য বিনিময়ের লক্ষ্যে এই চুক্তি করা হয়ে থাকে।
অংশীদারি সংলাপে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের তরফে আকসা এবং জিসোমিয়া চুক্তির ব্যাপারে বাংলাদেশের অগ্রগতি জানতে চাওয়া হয়। বাংলাদেশ বিষয়টি নিয়ে আগামী ৬ এপ্রিল ওয়াশিংটনে বাংলাদেশ ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে অনুষ্ঠেয় প্রতিরক্ষা ও নিরাপত্তা সংলাপে আলোচনা করার অনুরোধ জানিয়েছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের আকসা ও জিসোমিয়া চুক্তির প্রস্তাব পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তরফ থেকে সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও দপ্তরে মতামতের জন্য পাঠানো হয়েছে। এসব মন্ত্রণালয়ের মতামত পাওয়ার পর সিদ্ধান্ত নেয়া হবে। তবে বাংলাদেশ সরকার এসব চুক্তির বিষয়ে ইতিবাচক মনোভাব পোষণ করে। ফলে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ভবিষ্যতে এই দুটি চুক্তি সই হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। তবে প্রতিরক্ষা ও নিরাপত্তা সংলাপের আগে তা হচ্ছে না।
বাইডেন প্রশাসনের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক প্রথম হোঁচট খায় গণতন্ত্র সম্মেলনে বাংলাদেশকে আমন্ত্রণ না জানানোয়। তবে র্যাবের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করলে তীব্র প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়। তার ওপর যুক্তরাষ্ট্রের তরফে লেহি আইনে সই করার জন্য প্রস্তাব পাঠানো হয়। লেহি আইনে সই না করলে যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক সহায়তা বন্ধ থাকবে বলে জানানো হয়। লেহি আইনে সই করলে নিরাপত্তা সংস্থাগুলো মানবাধিকার লক্সঘন করলে সহায়তা বন্ধ হবে বলে শর্ত দেয়া হয়। বাংলাদেশ বলছে, বিষয়টি দেশের সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক কিনা তা খতিয়ে দেখা হচ্ছে। তবে অংশীদারি সংলাপে এ বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রের তরফে তেমন কিছু বলা হয়নি।
এদিকে, বাংলাদেশ ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে কূটনৈতিক সম্পর্কের ৫০ বছর উদযাপন উপলক্ষ্যে পররাষ্ট্রমন্ত্রী একে আব্দুল মোমেন এপ্রিলে যুক্তরাষ্ট্র সফরে যাচ্ছেন। ওই সফরকালে ৪ এপ্রিল ওয়াশিংটনে মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্থনি বিঙ্কেনের সঙ্গে তার দ্বিপক্ষীয় বৈঠক অনুষ্ঠিত হবে। সেখানে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের প্রবণতা সম্পর্কে আরও বেশি জানা যাবে। যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্ক মেরামতে বাংলাদেশ উদগ্রীব। সরকারের তরফে লবিস্টও নিয়োগ করা হচ্ছে।
ভিক্টোরিয়া নুল্যান্ড আজ ঢাকা থেকে দিল্লি যাচ্ছেন। সেখানে তিনি ভারতের সঙ্গে ফরেন অফিস কনসালটেশনে অংশ নেবেন। মার্কিন কর্মকর্তারা সাধারণত দিল্লি হয়ে ঢাকা সফরে আসেন। নুল্যান্ডকে ঢাকা থেকে দিল্লি যেতে দেখা যাচ্ছে। নুল্যান্ড পররাষ্ট্র সচিব মাসুদ বিন মোমেনের সঙ্গে আনুষ্ঠানিক বৈঠকের আগে একান্ত বৈঠকও করেছেন। তিন দেশ সফরের শেষ দিকে শ্রীলঙ্কা যাবেন মার্কিন এই কর্মকর্তা।