স্টাফ রিপোর্টার: রাজধানীর অস্থায়ী হাটগুলোতে রোববার থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে কোরবানির পশু বেচাকেনা শুরু হয়েছে। তবে প্রথম দিন প্রতিটি হাট গবাদিপশুতে কানায় কানায় পূর্ণ থাকলেও ক্রেতা সমাগম ছিল নগণ্য। হাটে আসা বেশিরভাগ মানুষ দরদাম যাচাই করে সময় কাটিয়েছেন। বিক্রেতারাও চড়া দর হেঁকে বাজার বোঝার চেষ্টা করেছেন। ফলে ঢাকার ১৯টি হাটের কোনোটিতেই এদিন বেচাকেনা তেমন জমেনি।
এদিকে বেচা-বিক্রির শুরুতে বিক্রেতারা হাটে আনা গবাদিপশুর আকাশচুম্বি দাম হাঁকলেও শেষ পর্যন্ত মোটামুটি লাভে তা বিক্রি করতে পারবেন কিনা, তা নিয়ে চরম দুশ্চিন্তায় রয়েছেন। তাদের ধারণা, ঢাকার হাটগুলোতে স্বাভাবিক চাহিদার তুলনায় অনেক বেশি কোরবানির পশু এসেছে। আরও বিপুলসংখ্যক পশুবাহী ট্রাক ঢাকামুখী রাস্তায় রয়েছে। অথচ আর্থিক দুরবস্থার কারণে অনেকেই এবার ৫-৭ জনে মিলে ভাগে কোরবানি দেওয়ার প্রস্তুতি নিয়েছেন। এ ছাড়া বেশ কয়েক বছর বন্ধ থাকলেও এবার ভারতীয় গরু দেশে ঢুকেছে। চোরাপথে মিয়ানমার থেকেও বিপুলসংখ্যক গরু আসছে। ফলে সব মিলিয়ে শেষ সময় গরু-মহিষের দামে বড় পতন হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।
অন্যদিকে গো-খাদ্যের দাম বাড়ার অযুহাতে গরু ব্যবসায়ীরা যেভাবে দাম হাঁকছে, এতে অনেকের পক্ষেই এবার কোরবানি দেওয়া বেশ দুষ্কর হবে বলে মনে করছেন ক্রেতারা। তাদের শঙ্কা, গরু-মহিষের দাম এতটা চড়া থাকলে যারা এককভাবে পশু কোরবানি দিতেন, তাদের একাধিক ভাগিদার খুঁজতে হবে। আর যারা ৩-৪ জন মিলে ভাগে পশু কোরবানি করতেন, তারা বাধ্য হয়ে আরও শরিকদার বাড়াবেন। গত ৬-৭ মাস ধরে গরুর মাংস কেজিতে ২০০ টাকা বাড়ায় কোরবানির পশুর হাটে তিন মণ ওজনের মাংসের গরুর দাম আগের তুলনায় ন্যূনতম ২০-২৫ হাজার টাকা বাড়বে বলে মনে করেন ক্রেতারা।
এদিকে এবার গরুর দাম কতটা চড়া হবে? না-কি ক্রেতা সংকটে শেষ সময় বড় ধরনের দরের পতন ঘটবে? হাটে ওঠা কত পশু অবিক্রিত থাকবে? এ নিয়ে দুশ্চিন্তায় রয়েছেন হাট ইজারাদাররাও। তাদের শঙ্কা, এবার বিপুলসংখ্যক গরু-মহিষ উদ্বৃত্ত থাকবে। ফলে হতাশ বেপারী-খামারি ও গৃহস্থরা শেষ সময় কোরবানির পশু সস্তা দরে বেচে দেওয়ার চেষ্টা করবেন। এতে হাসিল কম সংগ্রহ হওয়ায় লোকসান হতে পারে বলে আশঙ্কা করছেন ইজারাদাররা।
বাজার-সংশ্লিষ্টরা জানান, দীর্ঘদিন ধরে গবাদিপশু আমদানি ও পাচার বন্ধ থাকার পরও গত কয়েক বছর কোরবানির ঈদে ২০-২২ লাখ পশু উদ্বৃত্ত থাকছে। এবারও চাহিদার চেয়ে ২১ লাখ ৪১ হাজার বেশি পশু প্রস্তুত আছে। অথচ ঈদুল আজহাকে সামনে রেখে বেশকিছু দিন ধরে নানা কৌশলে ভারত ও মিয়ানমার সীমান্ত দিয়ে বিপুলসংখ্যক গরু-মহিষ দেশে ঢুকছে। কখনো আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর চোখ ফাঁকি দিয়ে, আবার কখনো প্রশাসনের সঙ্গে আঁতাত করে গরু আনা হচ্ছে। স্থানীয় প্রভাবশালী ও রাজনৈতিক নেতাকর্মীদের সংঘবদ্ধ চক্র এর সঙ্গে জড়িত থাকায় চোরাপথে আসা এসব পশু সীমান্ত এলাকার বিভিন্ন হাটে প্রকাশ্যে বিক্রি হচ্ছে। যার একটি বড় অংশ এরই মধ্যে রাজধানীর বিভিন্ন হাটে তোলা হয়েছে।
সীমান্ত এলাকার জনপ্রতিনিধিরাও অনেকে ভারত ও মিয়ানমার থেকে গরু পাচার হয়ে দেশে ঢোকার কথা স্বীকার করেছেন। তাদের অভিযোগ, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সঙ্গে যোগসাজসেই কালোবাজারিরা অনেকটা প্রকাশ্যেই এই অপতৎপরতা চালিয়েছে। প্রশাসনের বিভিন্ন পর্যায়ে বিষয়টি অবহিত করেও কোনো লাভ হয়নি।
তাদের ভাষ্য, কক্সবাজারের টেকনাফ, উখিয়া, রামু, বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়িসহ একাধিক উপজেলায় বিপুলসংখ্যক মিয়ানমারের পশু ঢুকেছে। এসব পশু প্রথমে রামুর গর্জনিয়া ও কচ্ছপিয়া ইউনিয়ন এবং চকরিয়ার বিভিন্ন স্থানে রাখা হয়েছে। পরে তা বিভিন্ন এলাকায় সরবরাহ করা হয়েছে। এমনকি ওই এলাকায় মিয়ানমার থেকে আসা পশুর হাটও বসছে। প্রতিটি গরু ও মহিষ মিয়ানমার থেকে ৬০ থেকে ৭৫ হাজার টাকায় কিনে তা এক লাখ থেকে এক লাখ ৩০ হাজার টাকায় বিক্রি করা হয়েছে। মিয়ানমার থেকে আসার কারণে দেশীয় পশুর চাহিদা ও দাম কমে গেছে। এতে খামারিরা চোখে অন্ধকার দেখছেন।
এদিকে কুমিল্লার বড় এলাকাজুড়ে ভারতীয় সীমান্ত। এ ছাড়া পাশের জেলাগুলোর সঙ্গেও ভারতের সীমান্ত রয়েছে। এই সীমান্ত দিয়ে গত কয়েক সপ্তাহ ধরে অবৈধভাবে পশু ঢুকছে। ফলে সেখানকার খামারিরা ভীষণ হতাশ হয়ে পড়েছেন। তাদের আশঙ্কা, গো-খাদ্যের দাম বাড়ায় এমনিতেই তাদের গরু লালন-পালনে বাড়তি খরচ হয়েছে। এর ওপর ভারতীয় গরু আসায় এবার কম দামে গরু বেচতে হলে তাদের পুঁজি নিয়ে টানাটানি পড়বে।
লালমনিরহাটের হাতীবান্ধা ও পাটগ্রামের বিভিন্ন সীমান্ত দিয়েও প্রতিদিন শত শত ভারতীয় গরু চোরাপথে বাংলাদেশে ঢুকছে বলে স্থানীয় খামারিরা অভিযোগ করেছেন। তাদের ভাষ্য, অর্থনৈতিক মন্দার এই দুঃসময় এভাবে গরু পাচার হওয়ায় খামারিদের স্বপ্ন ভেঙে চুরমার হয়ে গেছে।
বাংলাদেশ ডেইরি ফারমার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি মোহাম্মদ ইমরান হোসেন বলেন, ৯২ হাজার খামারি এই সংগঠনের সদস্য। কয়েক দিন ধরে তাদের অনেকে তথ্য দিয়ে বলছেন, সিলেট, চকরিয়া, উখিয়া, কুমিলস্না, আখাউড়া, শেরপুর, দিনাজপুর ও চাঁপাইনবাগঞ্জ সীমান্ত দিয়ে গরু ঢুকছে। এতে বড় খামারিরা ক্ষতিগ্রস্ত না হলেও ক্ষুদ্র খামারিরা বড় ক্ষতির মুখে পড়বে।
রাজধানীর আফতাব নগর হাটে গরু নিয়ে আসা মাদারীপুরের গৃহস্থ জয়নাল মিয়া বলেন, রোববার থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে বেচাবিক্রি শুরু হলেও হাটে চরম ক্রেতা সংকট। দুপুরের পর কয়েকশ’ ক্রেতা হাটে ঢু মারলেও তাদের বেশিরভাগই গরুর দরদাম করে চলে গেছেন। এক লাখ টাকার গরু অনেকে ৭৫-৮০ হাজার টাকায় কিনতে চেয়েছেন। এ অবস্থায় এবারের হাট কতটা জমবে, দাম কেমন হবে, কতটা লাভ করতে পারবেন- তা নিয়ে দুশ্চিন্তায় রয়েছেন।
একই হাটে আসা চুয়াডাঙ্গার খামারি খোকন শেখ বলেন, ভারত-মিয়ানমার থেকে যেভাবে গরু এসেছে বলে শুনেছি, এতে আশানুরূপ দামে কোরবানির পশু বেচা কঠিন হবে। গো-খাদ্যের চড়া দাম ও শ্রমিকের মজুরি বৃদ্ধি পাওয়ায় গরু-মহিষ গত বছরের তুলনায় ন্যূনতম ২০ শতাংশ বেশি দামে বিক্রি করতে না পারলে খামারিদের লোকসান হবে।
আফতাব নগর পশুর হাটে কথা হয় গরুর বেপারী মিজানুরের সঙ্গে। তিনি কুষ্টিয়া ও পাবনাসহ উত্তরাঞ্চলের বিভিন্ন এলাকা থেকে ২৮টি গরু নিয়ে শুক্রবার ঢাকায় এসেছেন। তার লোকজন এরই মধ্যে আরও ৩২টি গরু সংগ্রহ করে রেখেছেন। সেগুলোও সোমবার ঢাকায় ঢুকবে। মিজানুরের আশঙ্কা, চাহিদার তুলনায় জোগান বেশি হওয়ায় শেষ সময় গরুর দামে বড় পতন হবে। এ জন্য কিছুটা লাভ পেলেই আগভাগেই গরু বিক্রি করে দিবেন বলে জানান এই গরুর বেপারী।
এ হাটে আসা ব্যাংক কর্মকর্তা সালেহ উর রতন বলেন, প্রান্তিকভাবে খামার পর্যায়েই যখন গরুর দাম বাড়তি, তখন শেষ পর্যন্ত সেই দাম মধ্যস্বত্বভোগীদের হাত ঘুরে কোরবানির হাটগুলোতে কোন পর্যায়ে গিয়ে ঠেকে, সেটি এখন বড় প্রশ্ন। তিনি মনে করেন, এবার চড়া দরেই গরু বিক্রি হবে এবং বিপুলসংখ্যক গবাদিপশু অবিক্রিত থাকবে।
এদিকে এবার যে কোরবানির পশুর দাম বাড়বে, সেটি প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরও স্বীকার করছে। অধিদপ্তরের মহাপরিচালক ডাক্তার মো. এমদাদুল হক তালুকদার বলছেন, দাম যেন অযৌক্তিকভাবে না বেড়ে যায়, সে বিষয়ে তারা ‘প্রচেষ্টা’ চালাবেন। তিনি বলেন, ‘দাম নির্ধারণ তো আমরা করে দিতে পারি না। কিন্তু আমরা বলতে পারি, উৎপাদন খরচ কত, সেটা। যেমন গবাদিপশুর উৎপাদন খরচ কেজিপ্রতি প্রায় সাড়ে পাঁচশত টাকা। মাঝখানে মধ্যস্বত্বভোগী আছে। তাদেরও খরচ আছে, লাভ ধরতে হয়। সে ক্ষেত্রে তারা যৌক্তিক পর্যায়ে একটা দাম নিতে পারে।’
তবে এবার খামার থেকে গরু কিনতেই বেশি দাম দিতে হয়েছে বলে জানিয়েছেন গরুর বেপারীরা। কমলাপুর হাটে দুই ট্রাক গরু নিয়ে আসা কবিরুল ইসলাম জানান, গত বছরের তুলনায় প্রায় ২০ শতাংশ বেশি দরে এবার খামার থেকে গরু কিনেছেন। খরচ বাদ দিয়ে তিনি ৫ শতাংশ লাভ করলেও ৩০ শতাংশ বেশি দামে প্রতিটি গরু বিক্রি করতে হবে। যা আর্থিক মন্দার এ সময় ক্রেতার জন্য কঠিন হবে। অথচ এর চেয়ে কম লাভে গরু বেচলে তারা ক্ষতির মুখে পড়বে।