স্টাফ রিপোর্টার: বাংলাদেশের রপ্তানি পণ্যে বড় অঙ্কের শুল্ক বসানোর পর ব্যবসায়ীদের উদ্বেগের মধ্যে সরকার যেসব পদক্ষেপ নিতে যাচ্ছে তা জানিয়ে ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রে দুটি চিঠি যাচ্ছে বলে জানিয়েছেন প্রধান উপদষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম। গতকাল রোববার অর্থমন্ত্রণালয়ে এক জরুরি সভা শেষে তিনি সংবাদমাধ্যমকে বলেন, স্বয়ং প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূসের পক্ষ থেকে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডনাল্ড ট্রাম্পের কাছে একটি চিঠি পাঠানো হবে। আরেকটি চিঠি বাণিজ্য উপদেষ্টার পক্ষ থেকে পাঠানো হবে যুক্তরাষ্ট্রের অফিস অফ ট্রেড রিপ্রেজেন্টেটিভ-ইউএসটিআর কার্যালয়ে। মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডনাল্ড ট্রাম্প বিশ্বের শতাধিক দেশের পণ্যের ওপর নতুন করে শুল্ক আরোপের যে ঘোষণা দিয়েছেন, তাতে বাংলাদেশের রপ্তানি পণ্য যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশের সময় ৩৭ শতাংশ সম্পূরক শুল্কের মুখোমুখি হবে। এতদিন বাংলাদেশের পণ্যের ওপর যুক্তরাষ্ট্রের শুল্কহার ছিল গড়ে ১৫ শতাংশ, যা এখন বেড়ে হল মোট ৫২ শতাংশ। এই পরিপ্রেক্ষিতে সরকারের কয়েকজন উপদেষ্টা, প্রধান উপদেষ্টা কার্যালয়ের উচ্চ পর্যায়ের কর্মকর্তা ও ব্যবসায়ী প্রতিনিধিদের নিয়ে এদিন অর্থমন্ত্রণালয়ে জরুরি সভা হয়। বৈঠক শেষে প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম সাংবাদিকদের বলেন, ‘আমাদের সাথে ইউএসএর কন্টিনিউয়াস যোগাযোগ হচ্ছে। ঢাকায় তাদের দূতাবাস ও সেখানে ইউএসটিআর এর অফিসিয়ালসদের সঙ্গে কথা হচ্ছে। আগামী ৪৮ ঘন্টার মধ্যে আমাদের পক্ষ থেকে যুক্তরাষ্ট্রে দুটা চিঠি যাবে।’ তিনি বলেন, আজকের বৈঠকে এই সিদ্ধান্ত হয়েছে। ‘আমরা কী কী অ্যাকশন প্লানে যাচ্ছি, কী কী ল্যাঙ্গুয়েজ থাকবে সেটা ঠিক করা হচ্ছে। ব্যবসাবান্ধব পদক্ষেপই আমরা নেব। বাংলাদেশের স্বার্থ দেখার পাশাপাশি আমাদের প্রতিযোগী দেশগুলোর চেয়েও ব্যবসা বান্ধব হবে এই পদক্ষেপ। ‘উদ্দেশ্য হচ্ছে ইউএসএর সঙ্গে আমাদের যেন একটা ‘উইন-উইন সিচুয়েশন’ হয় এবং আরও বেশি বাজার সুবিধা (মার্কেট একসেস) পাওয়া যায়। ইউএসএ বিশ্বের সবচেয়ে বড় বাজার, সেখানে আমাদের আরও আরও সুবিধা পাওয়ার সুযোগ আছে। আজকের বৈঠকে এমনটাই আলাপ হয়েছে।’ অর্থ উপদেষ্টা সালেহউদ্দিন আহমেদের সভাপতিত্বে পর্যালোচনা সভাটি বেলা সাড়ে ৩টায় শুরু হয়ে বিকেল ৫টা পর্যন্ত চলে। অর্থ উপদেষ্টা বলেন, ‘আমেরিকা যাতে মনে করে অন্য দেশের তুলনায় বাংলাদেশ তাদের জন্য বেটার, এমন পদক্ষেপই আমরা নেব। ব্যবসায় অনেক বেশি নন-ট্যারিফ বেরিয়ার থাকে। সেগুলি যাতে না থাকে সেই পদক্ষেপ আমরা নেব, যৌক্তিকীকরণ করব।’ পরিকল্পনা উপদেষ্টা ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ বলেন, ‘যুক্তরাষ্ট্র যে পদক্ষেপগুলো নিয়েছে, তাতে করে চীনসহ বড় বড় অর্থনৈতিক শক্তির দেশগুলোও পাল্টা পদক্ষেপ নিচ্ছে। পুরো বিশ্ব অর্থনীতি বড় ধরনের নাড়াচাড়া খাবে কোনো সন্দেহ নেই। আমরা সবকিছুই মাথায় রাখছি। ‘আপাতত আমরা প্রধান রপ্তানি খাত তৈরি পোশাক রপ্তানি যাতে যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে রক্ষা পায়, প্রতিযোগিতা সক্ষমতা যাতে আরও বাড়ানো যায় সেটা আমরা করবো। আমার মনে হয় সেটা সম্ভব হবে।’ পরিস্থিতির পর্যালোচনা করে নিজের উপলব্ধি জানিয়ে এই অর্থনীতিবিদ বলেন, ‘ভ্যালু চেইনে যে করটা বাড়ানো হল এর প্রভাব যুক্তরাষ্ট্রের ভেতরে তাদের ভোক্তাদের ওপর পড়বে। বায়িং হাউজের ওপর পড়বে। আমাদের ওপর কতটুকু পড়বে সেটা আরেকটু বোঝাপড়া হতে হবে। আমরা শ্রমিকের মজুরির ক্ষেত্রে সর্বনি¤œ জায়গায় আছি, এর থেকে আর কমানো যাবে না।’ যুক্তরাষ্ট্রের বাড়তি করের চাপ অন্য জায়গায় পড়বে মন্তব্য করে তিনি বলেন, ‘আমরা উৎপাদনশীলতা বাড়ানোর চেষ্টা করবো। আমাদের অনেক তৈরি পোশাক আছে যেটা বিশ্বমানের। এসব পণ্যে অন্যদের সাথে প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে পারবো বলে আমরা মনে করি।’ প্রধান উপদেষ্টার হাই রিপ্রেজেন্টেটিভ খলিলুর রহমান বলেন, ‘আমরা একমত হয়েছি যে, আমাদের স্বার্থ বজায় রেখে যুক্তরাষ্ট্র থেকে আমাদের আমদানি বাড়ানো সম্ভব। বিষয়টি অতিসত্বর নিষ্পত্তি করতে আমরা সর্বাত্বক চেষ্টা করবো। ব্যবসায়ী প্রতিনিধিদের সঙ্গে আলোচনায় আমরা একই সমতলে আছি।’ তিনি বলেন, যুক্তরাষ্ট্রে আমাদের অ্যাম্বাসেডর ইউএসটিআরের কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলেছেন। সেখান থেকে আমরা যে সংকেত পাচ্ছি তা আমাদের চিন্তাধারার সঙ্গে সাজুয্য আছে। আগামী এক দুই দিনের মধ্যে আমাদের পজিশনগুলো আমরা চূড়ান্ত করে ফেলতে পারবো।’ ব্যবসায়ী প্রতিনিধিদের মধ্যে তপন চৌধুরী বলেন, ‘আমরা যতটা চিন্তিত ছিলাম, আজকের আলোচনা থেকে একটা পথনির্দেশনা পেয়েছি। এটা ব্যবসার জন্য একটা সুখবর। যেই কৌশলগুলো ঠিক করা হয়েছে তাতে আমাদের অনেক সুযোগ রয়েছে।’ বাংলাদেশ থেকে যুক্তরাষ্ট্রে যে কেবল তৈরি পোশাকই রপ্তানি হয় না সে বিষয়টি তুলে ধরে তিনি বলেন, ‘অনেক পণ্যই ওই দেশে রপ্তানি হচ্ছে। চারিদিক থেকে সুযোগ আসছে। এখন নীতি নির্ধারকদের মাধ্যমে এই চ্যালেঞ্জটা মোকাবেলা করতে পারবো।’ ব্যবসায়ী প্রতিনিধি সৈয়দ নাসিম মঞ্জুর বলেন, ‘আমাদের ব্যবসায়ী সম্প্রদায়ের মধ্যে একটা স্বস্তির জায়গা তৈরি হয়েছে। সরকারের পক্ষ থেকে একটা সুনির্দিষ্ট টাইম বাউন্ড পরিকল্পনা রয়েছে। দেশের স্বার্থ আগে। বাংলাদেশের স্বার্থ মাথায় রেখে সুযোগগুলো খুঁজে বের করার সিদ্ধান্ত হয়েছে।’ বাংলাদেশের প্রতিযোগিতা সক্ষমতা যেন না কমে, ব্যবসায়ীরা সেই আশ্বাস পেয়েছেন তুলে ধরে তিনি বলেন, ‘বেসরকারি খাত থেকে আমরা কনফিডেন্ট যে, লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড থাকলে আমরা পারবো। এই লেভেল প্লেয়িং ফিল্ডটা তৈরি করার দায়িত্ব হচ্ছে সরকারের।’ সৈয়দ নাসিম মঞ্জুর বলেন, তিনি আশা করছেন যে ২৪ ঘন্টা থেকে ৪৮ ঘন্টার মধ্যে তাদের ক্রেতাদের একটা ভালো খবর দিতে পারবেন।