বিলুপ্ত হতে পারে র‌্যাব : অপরাধে জড়িতদের শাস্তির কী হবে?

স্টাফ রিপোর্টার: বিএনপি জোট ক্ষমতায় থাকাকালে সন্ত্রাস দমনে গঠন করেছিল পুলিশের এলিট ফোর্স র‌্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন-র‌্যাব। ২০০৪ সালে এই বাহিনী গঠনের দুই বছরের মাথায় ক্ষমতা থেকে বিদায় নিতে হয় বিএনপিকে। এর পরের প্রায় দেড় যুগ ক্ষমতার বাইরে থাকা দলটি সবচেয়ে বেশি নিপীড়নের শিকার হয়েছে এই বাহিনী দ্বারা। ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত ফ্যাসিস্ট খেতাব পাওয়া আওয়ামী লীগ সরকার এমন কোনো অপকর্ম নেই যা র‌্যাবকে দিয়ে করায়নি। সরকারের আশ্রয়-প্রশ্রয়ে এই বাহিনীর অনেক সদস্য জড়িয়েছেন নানা অপরাধমূলক কর্মকা-ে।
গত প্রায় ২০ বছরে র‌্যাবের অপরাধের ফিরিস্তি অনেক দীর্ঘ। তাদের মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ বারবার আলোচিত হয়েছে আন্তর্জাতিক অঙ্গনেও। এক পর্যায়ে বাহিনী হিসেবে র‌্যাবের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। সেই নিষেধাজ্ঞা এখনো বহাল রয়েছে বাহিনীটির ওপর। সবশেষ গত জুলাইয়ে ছাত্র-জনতার আন্দোলন ঠেকাতেও বিতর্কিত ভূমিকা পালন করে র্যাব। অভিযোগ উঠে, হেলিকপ্টার থেকে গুলি করে আন্দোলনকারীদের দমানোর চেষ্টা করেছে এই বাহিনী।
গত বছরের ৫ আগস্ট রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর নানা মহল থেকে পুরো র‌্যাব বাহিনী বিলুপ্তির দাবি উঠেছে। অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত গুম কমিশনও র‌্যাব বিলুপ্তির সুপারিশ করেছে। এমনকি র‌্যাবের যে ¯্রষ্টা বিএনপি তারাও আনুষ্ঠানিকভাবে র‌্যাবের বিলুপ্তির দাবি করেছে। দিন দিন সেই দাবি জোরালো হচ্ছে। অন্তর্বর্তী সরকারও র‌্যাব বিলুপ্তির কথা ভাবছে। যেকোনো সময় বিলুপ্ত হয়ে যেতে পারে পুলিশের এই এলিট ফোর্স।
তবে প্রশ্ন উঠেছে, র‌্যাবে বিভিন্ন সময়ে যারা দায়িত্ব পালনকালে নানা অপরাধে জড়িয়েছেন, তাদের শাস্তির কী হবে? তারা কি পেশায় থাকবেন, আগের বাহিনীতে ফিরে যাবেন নাকি চাকরি থেকে স্থায়ীভাবে বরখাস্ত করে তাদের শাস্তির আওতায় আনা হবে।
সম্প্রতি গঠিত গুমসংক্রান্ত কমিশন বিভিন্ন বাহিনীর বিরুদ্ধে অভিযোগ দায়েরের আহ্বান জানায়। এতে সবচেয়ে বেশি অভিযোগ পড়েছে র‌্যাবের বিরুদ্ধে। এর পরিপ্রেক্ষিতেই মূলত বাহিনীটিকে বিলুপ্ত করার সুপারিশ করেছে সেই কমিশন। যদিও সম্প্রতি দায়িত্ব পাওয়ার পর র‌্যাবের মহাপরিচালক অতিরিক্ত আইজিপি এ কে এম শহিদুর রহমান জানিয়েছেন, কারও নির্দেশে র‌্যাব আর গুম-খুনে জড়াবে না। তিনি বলেন, আমি যতদিন দায়িত্ব পালন করব ততদিন র‌্যাব গুম, খুনে জড়িত হবে না এমন নিশ্চয়তা দিচ্ছি।
ঝালকাঠির রাজাপুর উপজেলার সাতুরিয়া গ্রামের তোফাজ্জেল হোসেনের ছেলে লিমন হোসেন। ২০১১ সালের ২৩ মার্চ তিনি বাড়ির পাশে থাকা মাঠে গরু আনতে যান। কিন্তু ওই সময় র‌্যাব সদস্যরা তার পায়ে গুলি করে। এতে লিমন আহত হন। পরে তার গুলিবিদ্ধ পা হাঁটু থেকে কেটে ফেলতে হয়। চিরতরে পঙ্গু হয়ে যান কলেজছাত্র লিমন। বিষয়টি তখন ব্যাপক সমালোচনার জন্ম দেয়। তৎকালীন জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান মিজানুর রহমান এর বিরুদ্ধে সোচ্চার হন। পরে এ ঘটনায় তার মা বাদী হয়ে ২০১১ সালের ১০ এপ্রিল ঝালকাঠি আদালতে একটি হত্যাচেষ্টা মামলাও করেন। কিন্তু সেই মামলায় কারও তেমন কোনো সাজা হয়নি। এখনো ক্ষতিপূরণ চেয়ে সেই লিমন আদালতের বারান্দায় ঘুরছেন।
সম্প্রতি সেই লিমন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে র‌্যাবের বিলুপ্তি ও সেই ঘটনায় থাকার অপরাধে র‌্যাবের আট কর্মকর্তার বিরুদ্ধে অভিযোগ দায়ের করেছেন। গত ১২ নভেম্বর অভিযোগ দায়েরের পর ক্ষতিপূরণ দাবি করে লিমন বলেন, র‌্যাবের বিরুদ্ধে মানবাধিকার লঙ্ঘনের বহু অভিযোগ। ক্ষমতার অপব্যবহার করে গুম, হত্যা, চাঁদাবাজিসহ নানা ধরনের অভিযোগ আছে। তাই আমি র‌্যাব বিলুপ্তির দাবি জানাচ্ছি।
২০১৪ সালের ২৭ এপ্রিল আইনজীবী চন্দন কুমারসহ সাতজনকে অপহরণ করে হত্যা করা হয়। পরে তাদের লাশগুলো শীতলক্ষ্যায় নিয়ে বালুর বস্তা বেঁধে পানিতে তলিয়ে দেয়ার চেষ্টা করা হয়। কিন্তু পরে সেগুলো ভেসে ওঠে। এরপর শুরু হয় এই হত্যাকা-টি কে বা কারা ঘটিয়েছিল তা খোঁজার পালা। মাত্র একটি সিসি ক্যামেরার ফুটেজ এই আলোচিত হত্যাকা-ের জট খুলে দেয়। পরে পুলিশি তদন্তে ওঠে আসে এই হত্যাকা-ের নেপথ্যের ঘটনা।
চাঞ্চল্যকর এই হত্যায় সরাসরি জড়িত থাকায় তৎকালীন র‌্যাব-১১ এর অধিনায়ক লে. ক. (অব.) তারেক সাঈদ, মেজর (অব.) আরিফসহ র‌্যাব সদস্য এমদাদ, এনামুল, কবির, বেলাল, তাজুল, এসআই পুর্নেন্দু বালা, হীরা মিয়া, তৈয়ব, আল আমিন, মহিউদ্দিন, আলীম, শিহাব ও নাসিরের নাম ওঠে আসে। পরে এই আলোচিত ঘটনায় দায়ের করা মামলায় বিচারিক প্রক্রিয়া শেষে ১৫ জনের মৃত্যুদ-াদেশ দেন আদালত। এখনো সেই আদেশ বহাল আছে।
২০১৩ সালের ১৩ ডিসেম্বর রাতের ঘটনা। সেদিন লক্ষ্মীপুরে জেলা জামায়াতে ইসলামীর নায়েবে আমির ডাক্তার ফয়েজ আহম্মদকে ঠান্ডা মাথায় গুলি করে হত্যা করেন র‌্যাবের সদস্যরা। এখানেই শেষ নয়, তাকে গুলি করে ছাদ থেকে ফেলে দিয়ে হত্যা নিশ্চিত করা হয়। এরপর তার লাশ গাড়িতে তুলে যায় র‌্যাব। পরদিন লক্ষীপুর সদর হাসপাতালের মর্গে মেলে তার লাশ। ডাক্তার ফয়েজের স্ত্রী অভিযোগ করেন, র‌্যাব সদস্যরা বাড়িতে ঢুকে গুলি করে হত্যা করে লাশ সেখান থেকে নিয়ে হাসপাতালের কাছে ফেলে রেখে যান।
সেই সময় নিহত ফয়েজের স্ত্রী মার্জিয়া বেগম বলেছিলেন, রাত ১২টার দিকে দু-তিনটি গাড়ি নিয়ে র‌্যাবসহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা তাদের বাসভবনে প্রবেশ করেন। তার আগে তারা গেটের তালা ভেঙে ফেলে। পরে তারা ভেতরে প্রবেশ করেন। তারা ফয়েজকে জোর করে ছাদে নিয়ে মাথায় গুলি করে ছাদ থেকে ফেলে দেন। মার্জিয়া আরও বলেন, র‌্যাব সদস্যরা তার ছেলে বেলালকে খোঁজাখুঁজি করছিলেন এবং বেলালকেও দেখামাত্র গুলি করার হুমকি দিচ্ছিলেন।
সেই ঘটনার প্রায় এক যুগ পরে সম্প্রতি ঢাকায় গুম হওয়া ব্যক্তিদের স্বজনদের নিয়ে অনুষ্ঠিত সমাবেশে তার ছেলে বলছিলেন, শুধু জামায়াত করার কারণে র‌্যাব তার বাবাকে ঠান্ডা মাথায় গুলি করে হত্যা করে। কিন্তু সেই হত্যার বিচার তারা আজও পাননি। এ ঘটনায় আলোচিত সাত খুনের সাজাপ্রাপ্ত মৃত্যুদ-প্রাপ্ত আসামি র‌্যাব অফিসার কর্নেল (অব.) তারেক সাঈদ জড়িত ছিলেন বলেও অভিযোগ রয়েছে এবং তার নির্দেশেই ডাক্তার ফয়েজকে গুলি করে হত্যা করা হয়েছিল। সেই সময়ে র‌্যাব-১১ এর অধীনে অন্তত ১১ জন বিরোধী মতের লোকজনকে তুলে নিয়ে হত্যা করা হয়েছে। তবে সুষ্ঠু তদন্ত হলে এই সংখ্যা আরও বাড়তে পারে বলে মনে করা হচ্ছে।
কক্সবাজারের আওয়ামী লীগপন্থী কাউন্সিলর ইকরামকে বাসা থেকে তুলে নিয়ে রাতের আঁধারে গুলি করে হত্যা করে র‌্যাবের সদস্যরা। এসময় ইকরাম তার পরিবারের সদস্যদের সাথে শেষ কথা বলতে চেয়েছিলেন। কথা বলার সময়ই ঠাস ঠাস করে গুলি করে তাকে হত্যা করা হয়। সেই গুলির শব্দ ও তার নির্মম মৃত্যুর গোঙ্গানি ফোনের অপর প্রান্ত থেকে শুনতে পান তার দুই কন্যা ও স্ত্রী। পরে এ ঘটনা শুধু বাংলাদেশ নয়, সারা বিশ্বে আলোড়ন তোলে। কিন্তু সেই ঘটনায় জড়িতদের তেমন কোনো শাস্তি হয়নি।
গত ২০ বছরে র‌্যাবের অপরাধ দমনে সাফল্যের গল্প অনেক। ঠিক তেমনি তাদের বিরুদ্ধে টাকার বিনিময়ে তুলে নিয়ে হত্যা, বিরোধী মতের লোকজনকে বাসা থেকে তুলে নিয়ে গিয়ে গুম করা এবং চাঁদাবাজি ছাড়াও সড়কে ছিনতাইয়ের মতো অভিযোগও কম নয়। বিশেষ করে বিএনপি ও জামায়াতের নেতাকর্মীদের বাসা থেকে তুলে নিয়ে গুম করার অভিযোগ এখনো পড়ছে গুম সংক্রান্ত কমিশনে।
জানা গেছে, ২০১২ সালে ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের দুই মেধাবী ছাত্রনেতা ওয়ালীউল্লাহ ও আল মুকাদ্দাস, ২০১৩ সালে রাজধানীর আদাবরের হাফেজ জাকির হোসেন, ২০১৬ সালে বেনাপোলের রেজওয়ান হুসাইন, ২০১৭ সালে বান্দরবানের জয়নাল হোসেনকে তুলে নেয় র‌্যাব। তারা সবাই ছাত্রশিবিবের নেতা ছিলেন। এছাড়াও ২০১৩ সালের ৪ ডিসেম্বর সন্ধ্যা থেকে মধ্যরাতের মধ্যে তেজগাঁও এলাকার বিএনপির আট নেতাকর্মীকে বাসা থেকে তুলে নিয়ে যাওয়া হয় র‌্যাব পরিচয়ে। তারা হলেন- তেজগাঁও ৩৮নং ওয়ার্ড বিএনপির সাধারণ সম্পাদক সাজেদুল ইসলাম সুমন, সুমনের খালাতো ভাই জাহিদুর করিম তানভীর, কাওসার হোসেন, আব্দুল কাদের ভুইয়া মাসুম, মাজহারুল ইসলাম রাসেদ, আসাদুজ্জামান রানা, আল আমিন ও এ এম আদনান চৌধুরী। সেদিনের পর থেকে আজও তাদের খোঁজ মেলেনি। এর বাইরে অসংখ্যা মানুষকে গুম করার অভিযোগ রয়েছে র‌্যাবের বিরুদ্ধে।
গত ২০ বছরে র‌্যাবে যারা দায়িত্ব পালন করেছেন তাদের অনেকে খুন গুম এবং বিচারবহির্ভূত হত্যাকা-ের সঙ্গে সরাসরি জড়িত ছিলেন। শুধু সাত খুন নয়, এমন অনেক ঘটনা ঘটেছে নীরবে। সে সময়গুলোতে ভুক্তভোগীরা বিচার চাওয়া তো দূরের কথা অনেকে বাড়ি ছেড়ে পালিয়ে গেছেন। এখনো অনেকের আগের ভয়ে মুখ খুলছেন না। বিভিন্ন নিরপরাধ ব্যক্তিকে ধরে এনে মাসের পর মাস আটকে রেখে মামলায় ফাঁসিয়ে দেয়ার ঘটনা র‌্যাবের বিরুদ্ধে রয়েছে। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, র‌্যাব বিলুপ্ত হলে গত ২০ বছরে বাহিনীটির সঙ্গে যুক্ত থেকে যারা বিভিন্ন অপরাধে জড়িত রয়েছেন তাদের শাস্তি কীভাবে হবে? মানবাধিকার কর্মী এবং বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ওই ব্যক্তিদের প্রচলিত আইনে বিচার সম্ভব। এজন্য ভুক্তভোগীদের মামলা করতে হবে।