স্টাফ রিপোর্টার: অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের অভিন্ন দাবিতে রাজপথে নামছে সরকারবিরোধীরা। রাজনীতির মাঠে মত-পথ এবং আদর্শিক ভিন্নতা থাকলেও এই অভিন্ন দাবিতে অনেকটাই এখন তারা কাছাকাছি অবস্থানে। দলীয় সরকারের অধীনে আগামী দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশগ্রহণ না করার সিদ্ধান্ত সামনে রেখে যার যার অবস্থান থেকে বিরোধীদলগুলো যুগপৎভাবে রাজপথ উত্তপ্ত রাখার কৌশল গ্রহণ করেছে। এই আন্দোলনকে তারা ক্রমান্বয়ে এক দফা দাবি আদায়ের বৃহত্তর আন্দোলনে পরিণত করতে পর্দার আড়ালে আলাপ-আলোচনাও অব্যাহত রেখেছে। সে অনুযায়ী একটি রোডম্যাপ তৈরি করা হচ্ছে। বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর শীর্ষ নেতাদের মতে, যেকোনো মূল্যে আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ এবং সব মহলের কাছে গ্রহণযোগ্য হওয়া উচিত। দেশের মানুষও চায় একটি অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন। যে নির্বাচন অবাধ, সুষ্ঠু এবং নিরপেক্ষ হবে। নির্বিঘেœ সাধারণ মানুষ তার ভোটাধিকার প্রয়োগ করবে। পছন্দের প্রার্থীকে ভোট দেবে। মানুষের রায়ে যারা ক্ষমতায় আসবে, আসুক। কিন্তু অতীত অভিজ্ঞতা বলছে, দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন হলে মানুষের এই চাওয়া পূরণ হবে না। তাই নির্দলীয়-নিরপেক্ষ এবং তদারকি সরকারের অধীনে নির্বাচন ছাড়া আর কেনো বিকল্প তাদের হাতে নেই।
ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ অতীতের মতো এবারও সংবিধানের ভেতরে থেকেই নির্বাচনকালীন দলীয় সরকারের অধীনে জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশ নেয়ার পক্ষে দৃঢ় অবস্থানের কথা জানান দিয়েছে। তাদের শরিক জোট ১৪ দলের সদস্যরা এবং জাতীয় সংসদের প্রধান বিরোধী দল জাতীয় পার্টিরও দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনে যেতে আপত্তি নেই। তবে জাতীয় পার্টি সাফ জানিয়ে দিয়েছে, তারা যেকোনো মূল্যে আগামীতে একটি অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ এবং সবার কাছে গ্রহণযোগ্য নির্বাচন দেখতে চায়। এই দাবিতে দীর্ঘদিন ধরেই সংসদে এবং সংসদের বাইরে বেশ সোচ্চার এবং সরব জাতীয় পার্টি। গত ডিসেম্বর থেকে সরকারের পদত্যাগ ও তত্ত্বাবধায়কসহ ১০ দফা দাবিতে আন্দোলন শুরু করে মাঠের প্রধান বিরোধী দল বিএনপি। তাদের এই আন্দোলনের সঙ্গে একাত্বতা প্রকাশ করে যুগপৎভাবে মাঠে আছে গণতন্ত্র মঞ্চ, ১২দলীয় জোট, জাতীয়তাবাদী সমমনা জোট, লিবারেল ডেমোক্রেটিক পার্টি-এলডিপি, বাম গণতান্ত্রিক ঐক্য, গণফোরামের একাংশসহ সমমনা আরও কয়েকটি রাজনৈতিক দল। দাবি আদায়ে মাহে রমজানের ভেতরেও বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করে বিএনপিসহ সমমনা দল ও জোট। ঈদের ছুটি শেষে আগামী ১ মে থেকে ধারাবাহিক কর্মসূচি দিয়ে মাঠে নামার ঘোষণা দিয়েছে তারা। জানতে চাইলে এ প্রসঙ্গে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন মঙ্গলবার বলেন, আমাদের দেশে নানা রকমের সংকট আছে। তবে মূল সংকট দেশে গণতন্ত্র নেই, ভোটের অধিকার নেই। জাতীয় সংসদ নির্বাচন বলেন, আর স্থানীয় সরকার নির্বাচন বলেন-মানুষ ভোট দিতে পারে না। সরকার যাকে চায়, তাকেই বিনা ভোটে জয়ী ঘোষণা করা হয়। এ অবস্থার অবসান খুবই জরুরি। দেশের মানুষ মনে করে, আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকলে এবং বর্তমান সরকারের অধীনে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলে তারা আর ভোটের অধিকার ফিরে পাবে না। পছন্দের প্রার্থীকে ভোট দিতে পারবে না। নির্বাচনে তাদের কোনো মতামত থাকবে না। কারণ তারা এই সরকারের অধীনে এর আগে আরও দুটি নির্বাচন দেখেছে। তাই মত ও পথের ভিন্নতা সত্ত্বেও এমনকি আদর্শিক ভিন্নতা সত্ত্বেও সবাই এখন নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের দাবিতে এক মোহনায় মিলিত হতে শুরু করেছে। সাধারণ মানুষও এই দাবি আদায়ে রাজপথে নামতে শুরু করেছে। গণতন্ত্র মঞ্চের অন্যতম শরিক দল ও বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক এ প্রসঙ্গে মঙ্গলবার বলেন, ২০১৪ এবং ২০১৮ সালের মতো আরও একটি ব্যর্থ, অকার্যকর ও জালিয়াতির নির্বাচনের দায়ভার আমরা নিতে পারি না। ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনের মধ্য দিয়ে যদি বর্তমান সরকারকে পিছু হঠাতে না পারি-তাহলে এ দেশে ভোটের অধিকার, গণতান্ত্রিক অধিকারসহ কোনো কিছুই আর আদায় করা যাবে না। তিনি আরও বলেন, আমাদের এই দাবিতে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ এবং তাদের শরিক কয়েকটি সুবিধাভোগী দল ছাড়া বাকি সবাই মত ও পথের এমনকি আদর্শিক ভিন্নতা থাকা সত্ত্বেও যার যার অবস্থান থেকে এক এবং অভিন্ন দাবিতে রাজপথে দাঁড়াচ্ছে। নিকট অতীতে এরকমটা দেখা যায়নি। আমরা মনে করি, এই আন্দোলন ক্রমান্বয়ে এক দফা দাবি আদায়ের বৃহত্তর আন্দোলনে রুপ নেবে। বিএনপিসহ তাদের সমমনাদের বাইরে বাম প্রগতিশীল ঘরানার দলগুলোর মধ্যে ছয়টি দল মিলে গড়ে ওঠা ‘বাম গণতান্ত্রিক জোট’ দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনে অংশ না নেয়ার সিদ্ধান্তের কথা স্পষ্ট করে জানিয়ে দিয়েছে। এই জোটের দলগুলো হচ্ছে-বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিবি), বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দল (বাসদ), বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দল (বাসদ-মার্কসবাদী), বিপ্লবী কমিউনিস্ট লীগ, গণতান্ত্রিক বিপ্লবী পার্টি এবং বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক আন্দোলন। বিএনপি ও তাদের শরিকদের সঙ্গে মত-পথ এবং আদর্শিক ভিন্নতা থাকলেও বাম গণতান্ত্রিক জোট নির্দলীয়-নিরপেক্ষ ও তদারকি সরকারের অধীনে নির্বাচনের পাশাপাশি নির্বাচন কমিশনকে আরও স্বাধীন, শক্তিশালী এবং কার্যকর করার দাবিতে অনেক দিন ধরে রাজপথে আছে। একই দাবিতে রাজপথে সক্রিয় বাংলাদেশের সাম্যবাদী আন্দোলনসহ ছোট ছোট আরও নয়টি বাম ঘরানার রাজনৈতিক দল মিলে গঠিত ‘ফ্যাসিবাদবিরোধী বাম জোট’ও।
এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির (সিপিবি) সাধারণ সম্পাদক রুহিন হোসেন প্রিন্স বলেন, আমরা মনে করি দলীয় সরকারের অধীনে অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ এবং গ্রহণযোগ্য নির্বাচন সম্ভব নয়। এজন্য নির্দলীয়-নিরপেক্ষ এবং তদারকি সরকারের অধীনে নির্বাচন চাই। একই সঙ্গে আমরা মনে করি, নির্বাচন কমিশনকে আরও স্বাধীন, শক্তিশালী ও কার্যকর করার পাশাপাশি নির্বাচন ব্যবস্থারও আমূল সংস্কার প্রয়োজন। তা না হলে ভোটে জনমতের সত্যিকারের প্রতিফলন ঘটবে না। তিনি আরও বলেন, বাম গণতান্ত্রিক জোটের ব্যানারে আমরা ভোট ও ভাতের অধিকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে আছি। এই দাবিতে আমরা আমাদের আন্দোলন অব্যাহত রাখবো। এদের পাশাপাশি ধর্মভিত্তিক ইসলামী দলগুলোরও দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনে অংশ নেয়ার ক্ষেত্রে তীব্র আপত্তি রয়েছে। জামায়াতে ইসলামী বাংলাদেশ প্রথম থেকেই দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনের বিপক্ষে। এই দাবিতে এখনো অনড় অবস্থানে তারা। নির্বাচন কমিশন দলটির নিবন্ধন বাতিল করলেও রাজনীতির মাঠে খুবই সরব ও সক্রিয় এই দলটি। বিএনপিসহ সমমনা দল ও জোটের সঙ্গে তালমিলিয়ে মাঝে মধ্যেই বিভিন্ন কর্মসূচি দিয়ে রাজপথে নিজেদের শক্ত অবস্থান জানান দিচ্ছে জামায়াতে ইসলামী বাংলাদেশ।
জানতে চাইলে দলটির কেন্দ্রীয় নির্বাহী পরিষদ সদস্য ও কেন্দ্রীয় প্রচার বিভাগের সেক্রেটারি অ্যাডভোকেট মতিউর রহমান আকন্দ বলেন, রাজনৈতিক দল হিসাবে তত্ত্বাবধায়ক সরকারে অধীনে নির্বাচনের দাবি আমরাই প্রথম করেছি। আমরা আজও মনে করি এর কোনো বিকল্প নেই। আমাদের দাবির ফসল ছিলো তত্ত্বাবধায়ক সরকার। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ একক সংখ্যাগরিষ্ঠতার জোরে তা বাতিল করে। আমরা অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ এবং গ্রহণযোগ্য ভোট চাই। এর জন্য তত্ত্বাবধায়ক সরকার ছাড়া আর কোনো বিকল্প নেই। আমরা শান্তিপূর্ণ উপায়ে নিয়মতান্ত্রিক এবং গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় দাবি আদায়ে রাজপথে আছি, আগামীতেও থাকবো।
জামায়াতে ইসলামী বাংলাদেশের বাইরে ইসলামী দলগুলোর মধ্যে এই মুহূর্তে ব্যাপক সরব ও সক্রিয় হচ্ছে চরমোনাইর পীর মুফতি সৈয়দ মুহাম্মদ রেজাউল করীমের নেতৃত্বাধীন ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ। হাতপাখা প্রতীকে স্থানীয় সরকার নির্বাচনে অংশ নিয়ে বেশ সাড়া ফেলে দিয়েছে দলটি। আসন্ন পাঁচ সিটি করপোরেশন নির্বাচনেও অংশ নেবে তারা। এই নির্বাচনে ক্ষমতাসীন জোট ও তাদের শরিকদের বাইরে থাকা বাকি বিরোধীদের সমর্থনের প্রত্যাশা তাদের। ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের পক্ষ থেকে দলীয় সরকারের অধীনে জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশগ্রহণ প্রশ্নে আপত্তির কথা জানানো হয়েছে। এ ছাড়াও জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম, বাংলাদেশ খেলাফত আন্দোলন, খেলাফত মজলিশ, বাংলাদেশ খেলাফত মজলিশ, ইসলামী ঐক্যজোটসহ বেশ কয়েকটি ধর্মভিত্তিক ইসলামী দল দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনে অংশ নেবে না বলে জানিয়ে দিয়েছে। অরাজনৈতিক সংগঠন হেফাজতে ইসলামও সুযোগ বুঝে এই দাবিতে মাঠে নামার পরিকল্পনা করছে।
জানতে চাইলে এ প্রসঙ্গে ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব গাজী আতাউর রহমান বলেন, ২০১৪ ও ২০১৮ সালে আমরা তামাশার নির্বাচন দেখেছি। এরকম তামাশার নির্বাচনে আমরা যাবো না। আমাদের দাবি জাতীয় সরকারের অধীনে একটি অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ এবং গ্রহণযোগ্য নির্বাচন। তিনি আরও বলেন, আমরা এবারের সিটি করপোরেশন নির্বাচনে অংশ নিচ্ছি। এই নির্বাচন কেমন হয়, নির্বাচনে সরকার ও নির্বাচন কমিশনের ভূমিকা কেমন থাকে-তা দেখার অপেক্ষায় আছি।