স্টাফ রিপোর্টার: খুচরায় বিদ্যুতের দাম বাড়াতে শুনানি শুরুর পর নড়েচড়ে বসছেন শিল্পদোক্তারা; উৎপাদন ব্যয় বাড়ার হিসাব কষার পাশাপাশি উচ্চ মূল্যস্ফীতির চাপ ভোক্তাদের কতটা পেরেসানিতে ফেলবে সেই শঙ্কা ভাবাচ্ছে তাদের মত অনেককেই। যুদ্ধের কারণে দেখা দেয়া বৈশ্বিক মন্দা পরিস্থিতিতে চড়া পণ্যমূল্যের কারণে এমনিতেই ধুঁকছেন দেশের ভোক্তারা। এরমধ্যে নতুন করে প্রতি ইউনিটে প্রায় সাড়ে ১৫ শতাংশ বিদ্যুতের দামবৃদ্ধি জীবনযাত্রায় ব্যয়ের বোঝায় আরও চাপ তৈরি করবে। পণ্য ও সেবার মূল্যকে ঊর্ধ্বমুখী করে উচ্চ মূল্যস্ফীতির পারদকে উসকে দেবে বলে মনে করছেন ব্যবসায়ী নেতা ও ভোক্তা অধিকার নিয়ে সোচ্চার সংগঠনের প্রতিনিধিরা। খুচরায় বিদ্যুতের দাম বাড়লে তা সরাসরি বাসা বাড়িতে বিদ্যুৎবাবদ ব্যয় বাড়াবে সবার। অপরদিকে অফিস ও কারখানায় পণ্য উৎপাদনের ব্যয়ে প্রভাব ফেলবে। এতে সব মিলে আবার একটা ধাক্কার মুখে পড়বেন সবাই বলে সতর্ক করেছেন তারা। সংকটে ডলারের দাম চড়তে থাকার মধ্যে ২০২২ সালের আগস্টে জ্বালানি তেলের দাম বাড়ানোর ধাক্কার রেশ কাটিয়ে ওঠার আগেই এ পদক্ষেপ মানুষকে আরও চাপে ফেলবে, যা ব্যবসা-বাণিজ্য ও অর্থনীতিতে নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে বলে তাদের ভয়। এমন প্রেক্ষাপটে আবার মূল্য বাড়ানোর দিকে না গিয়ে বিদ্যুৎ খাতের কোম্পানিগুলোর স্তরে স্তরে চলা চুরি, অনিয়ম ও দুর্নীতি নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে অপচয় সমন্বয়ের পরামর্শ দিয়েছেন সংক্ষুব্ধদের কেউ কেউ। গত ডিসেম্বরে পাইকারি পর্যায়ে বিদ্যুতের দাম ৫ টাকা ১৭ পয়সা থেকে ১৯ দশমিক ৯২ শতাংশ বাড়িয়ে ৬ টাকা ২০ পয়সা করে বিইআরসি। তখন বিদ্যুৎ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বলেছিলেন, পাইকারিতে বাড়লেও খুচরায় দাম বাড়বে না; ফলে জনজীবনে প্রভাব পড়বে না। তবে ওই ঘোষণার এক মাসের মধ্যে বিতরণ কোম্পানিগুলো খুচরায় দাম বাড়াতে একে একে আবেদন করতে শুরু করে। এসব কোম্পানির প্রস্তাব বিশ্লেষণ করে বিইআরসির কারিগরি কমিটিও দাম বাড়ানোর সুপারিশই করে। রোববার শুনানিতে কারিগরি কমিটি জানায়, বিতরণ ব্যয়ের বাড়তি খরচ পোষাতে কোম্পানিগুলোর খুচরা বিদ্যুতের দাম ভারিত গড়ে চলমান ৭ টাকা ১৩ পয়সা থেকে ১৫ দশমিক ৪৩ শতাংশ বাড়িয়ে ৮ টাকা ২৩ পয়সা করা যেতে পারে। আগামী ৯০ দিনের মধ্যে কমিশন এ বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত দেবে। এদিকে সরকারও ইতোমধ্যে আইন সংশোধন করে গ্যাস-বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর ক্ষমতা জ্বালানি খাতের নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিইআরসির কাছ থেকে নিজেদের কাছে নেয়ার পদক্ষেপ নিয়েছে। সেই প্রক্রিয়া চলমান থাকার মধ্যে ভোক্তা মহলের বিরোধীতা উপেক্ষা করে বিদ্যুতের খুচরা মূল্য বাড়ানোর পথে হাঁটছে কমিশন। গতকাল সোমবার এ বিষয়ে বিদ্যুৎ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ সাংবাদিকদের প্রশ্নের উত্তরে বলেন, রেগুলেটরি কমিশন ভোক্তা, খুচরা বিক্রেতা ও বিদ্যুতের কোম্পানিগুলোকে সঙ্গে নিয়ে শুনানি করেছে; তারাই সিদ্ধান্ত নিচ্ছে। এর সঙ্গে মন্ত্রণালয়ের কোনো সংশ্লিষ্টতা নেই। বিদ্যুতের দাম বাড়াতে রেগুলেটরি কমিশনের উদ্যোগ প্রসঙ্গে পোশাক রপ্তানিকারকদের সংগঠন বিজিএমইএর সভাপতি ফারুক হাসান মনে করছেন এতে রপ্তানি শিল্প যেমন প্রতিযোগিতা সক্ষমতা হারাবে, দেশে শিল্প উৎপাদনও ব্যয়বহুল হয়ে যাবে। তিনি বলেন, এ মুহূর্তে বিশ্ব অর্থনীতিতে মন্দা চলছে। এর সঙ্গে দেশে মূল্যস্ফীতিও বেড়েছে, সে অনুযায়ী ব্যাংক ঋণে সুদহারও বেড়েছে। সুদহার বাড়ার কারণে অভ্যন্তরীণ বাজারেও পণ্যের উৎপাদন খরচ বাড়ছে। এর সঙ্গে নতুন করে বিদ্যুতের দাম বাড়লে তা জনজীবনের সর্বত্র মূল্যস্ফীতিকে উসকে দেবে। “এসব দিক মাথায় রেখে আমি মনে করি বিদ্যুতের দাম না বাড়ানোই সবচেয়ে বেশি যুক্তিযুক্ত হবে। বাড়ালে স্থানীয় জিনিসপত্রের দামও বাড়বে।” বিদ্যুতের দাম না বাড়িয়ে সংশ্লিষ্ট কোম্পানিগুলোর দীর্ঘদিনের ‘দুর্নীতি আর অনিয়ম চর্চা’ কমিয়ে আনার দাবি জানান এ ব্যবসায়ী নেতা। “আমি মনে করি বিদ্যুৎখাতে নানা ধরনের সিস্টেম লস রয়ে গেছে। সিস্টেম লস মানে কিন্তু অনেক কিছু। অনেক ক্ষেত্রে বিদ্যুৎ চুরি হয়, মিটার রিডিং থেকে শুরু করে সর্বত্র চুরির একটা প্রবণতা আছে। এখনও অনেক অবৈধ সংযোগ আছে। যত অবৈধ কানেকশন আছে, সেটা যদি আমারও থাকে, আমি মনে করে সেটা কেটে দেয়া উচিত,” যোগ করেন তিনি। তার মতে, এসব জায়গায় দৃষ্টি দেয়া হলে দাম যতটুকু বাড়ানোর প্রয়োজন হচ্ছে-সেটা সেখান থেকে পুষিয়ে নেয়া যাবে। সরকারকে এ দিকে আরও কঠোর হওয়ার তাগিদ দেন ফারুক হাসান। বিদ্যুতের দাম বাড়াতে হলেও অন্তত ছয় মাস অপেক্ষা করা উচিত মন্তব্য করে তিনি বলেন, আগামী ছয় মাসের মন্দা বিবেচনা করে মানুষের ব্যয় আর যাতে না বাড়ে সে চেষ্টা করা উচিত। জিনিসপত্রের দাম বাড়ার অর্থ হচ্ছে তৃণমূলের ব্যবসায়ী থেকে শুরু করে বড় ব্যবসায়ী সবার ওপরেই সেই প্রভাব পড়বে। গত রোববার শুনানিতে কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) জ্বালানি উপদেষ্টা অধ্যাপক শামসুল আলম বলেন, “পাইকারি বিদ্যুতের দাম বৃদ্ধির পর গ্রাহক পর্যায়ে বিদ্যুতের দাম বাড়লে ২০২৩ সালের মূল্যস্ফীতিকে তা উসকে দেবে। বিদ্যুৎ খাতের সিস্টেম লস, অনিয়ম বন্ধ করলে সরকার বিতরণ কোম্পানিগুলোর ওপর আসা বাড়তি আট হাজার কোটি টাকার চাপ সামাল দিতে পারবে।” সরকার গত কয়েক অর্থবছর ৫ শতাংশের কিছু বেশি হারে মূল্যস্ফীতি হিসাব করে জাতীয় বাজেট প্রণয়ন করছে। অথচ গত চার মাস ধরে ৮ শতাংশের বেশি মূল্যস্ফীতি হচ্ছে। এক দশকের রেকর্ড ভেঙে গত অগাস্টে ৯ দশমিক ৫২ শতাংশ মূল্যস্ফীতি হয়। এরপর তা নিম্নমুখী হলেও ডিসেম্বরে ছিলো ৮ দশমিক ৭১ শতাংশ। বাংলাদেশ চেম্বার অব ইন্ডাস্ট্রিজের (বিসিআই) সভাপতি আনোয়ার উল আলম চৌধুরী পারভেজ বলেন, ২০২২ সালটা সবার জন্য খুব কঠিন সময় গেছে। খাদ্যদ্রব্যের দাম বেড়ে যাওয়াতে সাধারণ মানুষের নাভিশ্বাস উঠে গেছে। এ অবস্থায় বিদ্যুতের দাম বাড়ালে ভোগান্তি বাড়বে; মূল্যস্ফীতি আরও বেড়ে যাবে। তার মতে, “সরকারের উচিত এভাবে মানুষকে কষ্ট না দিয়ে বিদ্যুৎ খাতে চুরি চামারি বন্ধ করার উদ্যোগ নেয়া। বিদ্যুৎ বিভাগের সক্ষমতা বাড়ানোর মাধ্যমে বাড়তি ব্যয় কমিয়ে আনা। বিদ্যুতের উৎপাদন খরচ কীভাবে কমানো যায় সেদিকে নজর দেয়া উচিত। প্রয়োজনে ভ্যাট কমিয়ে দিয়ে হলেও বিদ্যুতের দাম নিয়ন্ত্রণে রাখা উচিত।” বিদ্যুতের দাম না বাড়াতে ব্যবসায়ী সংগঠনের প্রতিনিধি হিসেবে সরকারকে সরাসরি অনুরোধ করবেন কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, এখানে যে শুনানি হয়, সেখানে ব্যবসায়ী, নাগরিক সমাজ যত কথাই বলুক না কেন, কোনো কথাই আমলে নেয়া হয় না। তারা তাদের মত করেই দামটা বাড়ায়। তার ভাষ্য, “এ নিয়ে মানুষের মাঝে একটা হতাশা রয়েছে। শুনানিটা ভোক্তাদের কাছে প্রহসন মনে হয়। এই বিষয়গুলো সরকারের আমলে নেয়া উচিত। কারণ জনগণের যে ভোগান্তি হয়, সেটা পরোক্ষভাবে সরকারেরই ভোগান্তির কারণ হবে।”
বিদ্যুতের দাম বাড়ানো নিয়ে শঙ্কার কথা জানান পোশাক রপ্তানিকারকদের আরেক সংগঠন বিকেএমইএ এর নির্বাহী সভাপতি মোহাম্মদ হাতেমও। তিনি বলেন, “বিদ্যুতের দাম ভোক্তা পর্যায়ে বাড়লে শিল্পখাতে বাড়বে না বলে মন্ত্রী বলেছিলেন। কিন্তু তারপরও যদি বাড়ে আমাদের উৎপাদন খরচ বেড়ে যাবে। তাহলে চলমান সংকটের সঙ্গে আরেকটা যোগ হবে। “কোয়ালিটি বিদ্যুৎ সরকার কখনও আমাদের দিতে পারে নাই। এমনিতেই বিভিন্নভাবে আমাদের উৎপাদন খরচ বেড়ে গেছে।”